চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শান্তিময় বিশ্বগড়ার প্রত্যয়ে পালিত হোক হিজরি নববর্ষ ১৪৪১

মুহাম্মদ এনামুল হক ছিদ্দিকী

১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:১১ পূর্বাহ্ণ

১৪৪০ হিজরি সনের বিদায়ের সাথে সাথে কালপরিক্রমায় এলো আরেকটি নতুন বছর। স্বাগত হিজরি নববর্ষ ১৪৪১। বিশ্বের কোটি মুসলমানের মাঝে আজ বয়ে যাচ্ছে খুশির আনন্দধারা। বছর ঘুরে ফিরে এসেছে হিজরি সন। বিশ্বের কোটি মুসলমানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জীবনধারার সাথে মিশে আছে হিজরি সন। অতীতে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায় নানা উপলক্ষ ঘিরে সন তারিখ গণনার সুবিধার্থে বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করে তা অনুসরণ করে এসেছে। যেমন খ্রিস্টান সম্প্রদায় তাদের ধর্মগুরু হযরত ঈসা (আ) এর জন্মবার্ষিকীর দিনক্ষণ ধরে ঈসায়ি বা খ্রিস্টাব্দ সন প্রবর্তন করে এবং নিজেদের জীবনধারায় খ্রিস্টাব্দ সন মেনে চলে। একইভাবে বঙ্গাব্দ, শকাব্দ, মঘী সনসহ নানা বর্ষপঞ্জি পৃথিবীতে নানা ধর্ম সম্প্রদায়ের মাঝে চালু আছে।

মুসলমানরা ফরজ বিধান পালনে নানা আচার-উৎসব উদ্যাপনের ক্ষেত্রে হিজরি সন তথা চান্দ্রমাসকে অনুসরণ করে থাকে। চাঁদের উদয়ের ভিত্তিতে দিনক্ষণ নির্ধারিত হয় ১০ মহররম আশুরা, ১ মহররম হিজরি নববর্ষ, ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ), ১৪ শাবান শবেবরাত ইত্যাদি ইসলামী তাৎপর্যম-িত দিবসসমূহ। তাই হিজরি সনের উদ্ভব পটভূমিকা ও এর আবেদন বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ইসলামের সোনালি যুগে আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর ফারুক (রা) এর বিশেষ আগ্রহ ও ভূমিকায় হিজরি সন প্রবর্তিত হয়। খোলাফায়ে রাশেদার শাসনকালে মদিনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হলে অফিসিয়াল তথ্যাদির নথি ও দিনক্ষণের হিসাব রাখতে গিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরগণ বিপাকে ও অসুবিধায় পড়েন। যেহেতু তখন ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো বর্ষপঞ্জি বা একক সন চালু ছিল না। রাষ্ট্রীয় অফিসিয়াল কার্যাদি নির্বিঘেœ ও যথানিয়মে সম্পন্ন করার প্রয়োজনে নতুন সন প্রবর্তন তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর এই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বিভিন্ন প্রদেশের দায়িত্বশীল পদস্থ ব্যক্তিরা একের পর এক তাগাদা ও পরামর্শ দিতে থাকেন খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.) কে। মদিনা রাষ্ট্রের আওতা তখন দিন দিন বৃিদ্ধ পাচ্ছিল। আরবের গন্ডি পেরিয়ে মদিনাকেন্দ্রিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র রোম ও পারস্য পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। বিজিত প্রদেশসমূহের প্রশাসক ও পদস্থ দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সন-তারিখ না থাকায় নিজেদের সমস্যার কথা জানাতে থাকেন হযরত ওমর ফারুক (রা) কে। এ ব্যাপারে তাঁরা খলিফার দিক নির্দেশনা কামনা করেন। সে সময়ের কুফার গভর্নর হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা.) খলিফা হযরত ওমর ফারুকের (রা.) কাছে একটি চিঠিতে লিখলেন নির্দিষ্ট সন তারিখ না থাকায় প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের নানা অসুবিধা হচ্ছে।

অন্যদিকে রাষ্ট্রের কেন্দ্র হতে খলিফা কর্তৃক যে সব নির্দেশনা ও পরামর্শ প্রদান করা হয় তাতে কোনো তারিখ ও সন উল্লেখ না থাকায় সময় ও কাল নির্ধারণে বিঘœ ঘটছে। বিভিন্নভাবে এ ধরনের অভিযোগ ও সমস্যার কথা শুনে খলিফা হযরত ওমর (রা.) শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যক্তিদের সাথে বিশেষ বৈঠকে মিলিত হন। আলাপ আলোচনায় একটি বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের ওপর সকলে মতৈক্যে পৌঁছালেও কখন থেকে কি নামে বর্ষপঞ্জি করা হবে তা নিয়ে নানা মত ব্যক্ত করেন সাহাবায়ে কেরাম। কেউ বললেন মহানবীর (দ.) জন্ম দিবসের দিন ধরে বর্ষগণনা শুরু করতে, কেউ অভিমত দিলেন প্রিয় নবীর (দ.) নবুয়ত প্রকাশের বছর থেকে, আবার কেউ পরামর্শ দিলেন মহানবীর (দ.) মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরতের দিন থেকে বর্ষ গণনা শুরু করা যায়। গণতান্ত্রিক উপায়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা এবং যুক্তি তর্ক উপস্থাপন শেষে অবশেষে মহানবীর (দ.) হিজরতের ঘটনাকে মহিমান্বিত করার জন্য মহররম মাস থেকে হিজরি নামে একটি স্বতন্ত্র সন চালু করার ঘোষণা দেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমেনীন হযরত ওমর ফারুক (রা.)। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে হিজরি সন মুসলমানদের জীবনধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। হিজরি সন হয়ে উঠেছে তাদের গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতীকরূপে। বাংলা ও খ্রিষ্ট্রীয় সন যেমন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনধারার বড় অনুষঙ্গ, তেমনি হিজরি সনকে আমরা অনুসরণ করে থাকি ইসলামী নানা দিবস ও আচার অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে। অথচ দুঃখজনক যে, বাংলা ও খ্রিষ্ট্রীয় নববর্ষ আমাদের দেশে নানা মহল থেকে বেশ ঘটা করে বড় আয়োজনে পালন করা হলেও হিজরি নববর্ষ উদযাপন করা হচ্ছে না। ২০১০ সনে ৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ডিসি হিলে দেশে প্রথমবারের মতো বৃহত্তর আয়োজনে হিজরি নববর্ষ উদযাপন করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ইসলামী ফ্রন্ট। পরবর্তী বছর ২০১১ সনে ওই সংগঠনের দায়িত্বশীলরাসহ সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিদের নিয়ে হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ গঠন করে এবারসহ দশ বছর ধরে হিজরি নববর্ষ পালিত হতে যাচ্ছে।

১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ (১ মহররম ১৪৪১ হিজরি) রবিবার চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘী ময়দানে অনুষ্ঠেয় হিজরি নববর্ষ বরণানুষ্ঠানে হামদ, নাতে রাসূল (দ.), গজল, মাইজভান্ডারী, কাউয়ালী, মরমী, জারী ও পুঁথিপাঠ, দেশাত্মবোধক, উজ্জীবনধর্মী ও ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনায় থাকবেন দেশের বিভিন্ন স্বনামখ্যাত ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠনের শায়ের ও শিল্পীবৃন্দ।
চট্টগ্রাম থেকে সূচিত হিজরি নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠান আজ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে পথিকৃৎ হচ্ছে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম ইতিহাসে নানা কারণে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। হিজরি নববর্ষের সূচনার জন্য চট্টগ্রাম আবারও ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকল।
হিজরি নববর্ষ সবার জীবনে অশেষ শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনুক। ১৪৪১ হিজরি নতুন বছরে সংঘাতমুক্ত শান্তিময় বাসযোগ্য পৃথিবীর স্বপ্ন পূরণ হোক।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট