চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

নতুন করে ফণা তুলছে উগ্র জাতীয়তাবাদ

প্রকাশ ঘোষ

৩১ আগস্ট, ২০১৯ | ১:০৪ পূর্বাহ্ণ

চড়ষরঃরপং রং ধষংড় ঃযব ড়ৎমধহরুবফ ধপঃরারঃরবং ঃড় ংঢ়ৎবধফ ঃযব ারহফরপঃরাবহবংং- ঐবহৎু অফধসং . রাজনীতিকে যারা বর্ণবাদের হাতিয়ার করছেন, তাদের উদ্দ্যেশ্যে এডামসের এই উক্তি। রোনাল্ড রিগ্যান, ট্রাম্পদের চিন্তা-পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে ইদানিং গঠিত হয়েছে ‘ঘধঃরড়হধষ পড়হংবৎাধঃরাব পড়হভবৎবহপব. আমেরিকায়-ব্রিটেনে উস্কে দেয়া হচ্ছে অ্যাংলো-আমেরিকান, ব্রিটিশ উগ্রবাদ জাতীয়তাবাদকে। বর্ণবাদকে জাতীয় ঐতিহ্য ও অধিকার রক্ষার কথা বলে পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। ফলত আমেরিকা-ইউরোপ জুড়ে অভিবাসন বিরোধী শক্তি মাথা চাড়া দিচ্ছে। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। আইনি হয়রানি, হত্যা, খুনসহ নানা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে অভিবাসীরা। ন্যাশানাল কনজারভেটিভ কনফারেন্স বলছে, “ধর্ম এবং বর্ণগত পরিচয়ভিত্তিক গোষ্ঠীবদ্ধতার ভাবনা থেকে মানবজাতিকে আলাদা করা কঠিন।”

আত্মপরিচয়ের অহঙবোধ এখন উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে ফ্যাসিবাদে রূপ নিচ্ছে। ধর্মের আড়ালে নিজ ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠতম দাবী, আত্মপরিচয়ের আড়ালে বর্ণবাদকে লালন-পালন ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর।

মিলোসেভিচ ছিলেন আধুনিক বর্ণবাদের উৎকৃষ্ট উত্তরাধিকার। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে কসোভোর ব্ল্যাকবার্ড ময়দানে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সার্বিয় মুসলমানদের হাতে খ্রিস্টানরা পরাজিত হয়। সে ময়দানে দাঁড়িয়ে ১৯৮৯ সালে খ্রিস্টানদের অধিকার পুনরুদ্ধারের কথা বলে সার্বিয়ায় মুসলিম গণহত্যায় নেতৃত্ব দেন তিনি। জেনেভা আদালত তাকে যুদ্ধপরাধ দায়ে অভিযুক্ত করে।
ট্রাম্প নতুন করে “ঐতিহ্য রক্ষার অধিকারের কথা বলে অতীতের গৃহযুদ্ধের ক্ষত উস্কে দিয়ে বর্ণভিত্তিক শত্রুতাকে জাগিয়ে তুলেছেন।” এরদোগান ধর্মীয় জাতিয়তাবাদকে ব্যবহার করে তুরস্কের প্রগতিশীল দলসমূহের কর্মীদের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছেন ।

জেরুযালেমে ইসরাইলের জায়নবাদী আচরণ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে। প্রতিদিন কোনা না কোনো ফিলিস্তিনির রক্ত ঝরছে গাজা উপত্যকায়। উগ্র জায়নবাদ মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে গণহত্যায় মেতে উঠেছে।

আমাদের উপমহাদেশ ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হলেও ভারত এবং বাংলাদেশ নানা টানাপড়েন-এর মধ্য দিয়েও মোটামুটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ধারায় চলছিল। পাকিস্তান ধর্মীয় লেবাসে উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারায় চলছে ’৪৭ সালের পর থেকেই।
‘৭৫-এর বিয়োগান্তক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়, সাথে সংবিধানের মাথায় বিসমিল্লাহ্-এর সংযোজন ঘটে। নানা রঙ বেরঙের দলছুট নেতাদের সমাবেশ ঘটে জিয়ার ছাতার নিচে। মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা পদদলিত হয়, ক্ষত-বিক্ষত হয় সংবিধান। বিভিন্ন সময়ে উপমহাদেশের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুদের দেশ ত্যাগ ঘটেছে আশংকাজনক হারে।

এরই মধ্যে ভারতে ২য় বারের মতো ক্ষমতায় আরোহণ করেছে মোদী সরকার। যার নেতৃত্বে উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি। তারা হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দূরবর্তী লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ঘজঈ-র মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরীর চেষ্টা চলছে। গো-রক্ষার নামে মুসলমানদের খাদ্যাভ্যাসের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ এবং হত্যার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। অথচ ভারতের বহু রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে গো-মাংস খাওয়া হয় এবং ভারত পৃথিবীর অন্যতম গোমাংস রপ্তানীকারী দেশ। প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সাংবাদিক হত্যা হয়েছে, তাদের বইসমূহকে পাঠ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এমন কি রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরসহ অসাম্প্রদায়িক কবি-সাহিত্যিকদের অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে আরএসএস, যা বিজেপির ঞযরহশ ঃধহশ নামে পরিচিত।

কাশ্মীর ছিল রাজা শাসিত অঞ্চল। রাজা হরি সিংহ-এর আমলেও ছিল জম্মু ও কাশ্মীর মিলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। জম্মু ছিল হিন্দু প-িত অধ্যুষিত অঞ্চল । পাকিস্তানপন্থী জঙ্গিদের হামলা-নিপীড়নের শিকার হয়ে অনেক হিন্দু প-িত কাশ্মীর থেকে উত্তর প্রদেশে এবং দিল্লিতে নির্বাসিত হয়। ভূস্বর্গ কাশ্মীরে বামপন্থী দলগুলোর প্রভাবে ভূমি সংষ্কার হয়। কাশ্মীরের পতাকা তার সাক্ষ্য বহন করে। প-িতদের যখন নিধন চলছিল সিপিআই (এম) সহ প্রগতিশীল দলসমূহ কাশ্মীর বিধান সভায় এবং স্বয়ং জ্যোতিবসু রাজ্যসভায় জোরালো প্রতিবাদ করেছিল। যা, কর্পোরেট মিডিয়াগুলো তখনো এই সংবাদগুলো ছেপে কাশ্মীরে একটি অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণ সৃষ্টিতে সহায়তা করেনি, এখনো করছে না। বরং কংগ্রেস এবং শেখ আবদুল্লাহর দলের দুর্বলতা এবং দোদুল্যমানতার কারণেই প-িত নিধনের বিরুদ্ধে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় নি। আর আজকে ৩৭০ ধারা বিলোপকারী বিজেপি দল হিসাবে সেদিন মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল। বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ও প-িত পুনর্বাসনের ব্যাপারে কাশ্মীর বিধানসভায় বামপন্থীদের দাবী সত্ত্বেও কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নি।

নিকট অতীতে রাজনাথ সিং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময়েও সীতারাম ইয়েচুরীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় দল উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছে। কাশ্মীর বিধানসভায় নির্বাচিত বিধায়ক, কাশ্মীর সিপিআই (এম)- এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড ইউসুফ তারিগামী এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে অজ্ঞাত স্থানে বন্দী। তাকে রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে কোর্টে সোপর্দ করা হয় নি। কমরেড তারিগামী কাশ্মীর উপত্যকার সংগ্রামী অসাম্প্রদায়িক মুখ। ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে জঙ্গীদের কায়দায় কাশ্মীরে হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন মোদী-শাহ্-এর সফল হবে মনে হয় না। উল্টো পুরো রাজ্য একটি স্থায়ী অস্থিতিশীলতা ও রক্তপাতের মধ্যে নিপতিত হবে। কিছু পাকিস্থানপন্থী ও ভারতপন্থী কাশ্মীরি (যারা সংখ্যায় নগণ্য) তারা ব্যাতীত সাধারণ কাশ্মীরিরা ভারতীয় শাসনের অধীনে বিশেষ কিছু সুবিধা ও নিজস্বতা বজায় রেখে থাকতে চায়। তারা “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য” এই নীতি নিয়েই চলতে চায়। হিন্দু-মুসলিমের মিলিত এক মিশ্র বৈচিত্র্যময় সংষ্কৃতি নিয়েই চলতে চায়। ফলে ওখানে শেষ বিচার মুসলিম বা হিন্দু কোন জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা সফল হবে না, কাশ্মীরীয়ৎ ছাড়া। কাশ্মীরীইয়ৎ-ই হলো কাশ্মীরীদের আসল জাতীয়তাবাদ।

এতো অস্থিতিশীলতা, অস্থিরতার মধ্যে কোন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। আসামে-মনিপুরে-বাংলায়, কাশ্মীরে নতুন করে অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের উন্নয়নের নিরিখে সামগ্রিক দেশীয় উন্নয়ন’। ভারত দীর্ঘদিন এই ফিলোসফিতেই ছিল। মোদীর আমল থেকেই পুরো অর্থনীতিকে কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া হয়। আর জনগণকে হিন্দু বনাম অন্য জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত করার প্রয়াস চলছে। দলিত বনাম উচ্চ বর্ণ এভাবে জাত-পাত প্রথাকে ভারতীয় সংষ্কৃতির কেন্দ্রে নিয়ে আনা হচ্ছে। পুরো ভারত জুড়ে হিন্দু বনাম অন্য জনগোষ্ঠী এভাবে বিভক্ত করে ব্রিটিশদের মতো ঔপনিবেশিক কায়দায় দেশ শাসনের চেষ্টা চলছে। ফলে, ভারতের অর্থনীতি তলানিতে। বেকারত্ব সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। নোট বাতিল, জিএসটিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ধ্বংসের মুখে। ভারতীয় অর্থনীতিবিদরা বার বার সতর্কবাণী আওড়াচ্ছে। মোদী-শাহ্ কর্পোরেটের সাথে মধুচন্দ্রমিয়ায় ব্যস্ত। আর জনগণের জন্য বরাদ্দ রইল হিন্দুত্ববাদের আফিম।

একটি বহু ধর্ম, ভাষাভাষির দেশে জাতিকে যথার্থ জাতি হয়ে উঠতে গেলে তার নাগরিকদের নিজের মননকে জাতিগত ভিন্নতা ধারণ করার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হয়। একটি জাতির সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেক মিল থাকে আবার অনেক অমিলও থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলাটাই হল আসল কাজ। কোন একটা সম্প্রদায়ের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নয়।”

বিশ্বমানবতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, দুনিয়ার নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সব ধর্মের প্রতি সম-সম্মান প্রদর্শন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা। এই আদর্শগুলোকে সাধারণ উপাদান হিসাবে মেনে কি নতুন কোনো জাতীয়তাবাদের কথা ভাবা যায়?
পরিশেষে বলি, স্বধর্ম, স্বজাতিদের উন্নতি ও অগ্রগতিকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে আমরা যাতে বিভেদাত্মক, বিদ্বেষমূলক জাতীয়তাবাদের জন্ম না দিই।

লেখক : প্রকৌশলী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট