চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

হিজরী নববর্ষ

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

২৯ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব জাহানের প্রত্যেকটি কিছুর সময়পঞ্জী হিসেবে দিন-রাত ঘূর্ণায়মান আছে। এতে সংঘটিত হয় সপ্তাহ, সংঘটিত হয় মাস। এভাবে সৃষ্টি হয় বছরের। সৃষ্টির শুরু থেকে কোন না কোন সূত্র অবলম্বন করে মানুষ এ গণনা বর্ষপঞ্জীকে নিজেদের জীবনের জন্য একটি প্রয়োজনীয় ও অত্যাবশকীয় বিষয় হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে আসছে।

খোদাতায়ালার এ বিশাল গ্রহে রাত যায় দিন আসে, মাস ঘুরে বছর আসে। এর এক একটি দিন, এক একটি মাস, একেকটি বছর ভিন্ন প্রকৃতির, ভিন্ন রূপ-রঙের। আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালার অগণিত-অসংখ্য কুদরত ও কিরিশমার মধ্যে সময়ের এ অপরূপ বিবর্তনও একটি। এজন্য হাদীসে কুদসির মধ্যে রয়েছে: আল্লাহ তায়ালা বলেন আদম সন্তানগণ সময় বা কালকে গালি দেয়। অথচ এখানে আমি স্বয়ং নিহিত।

আগেই বলেছি, সকল যুগে কাল ও বর্ষগণনার জন্য বিভিন্ন সনের প্রবর্তন ছিল। কুরআনুল করীমও সে বিষয়টি বর্ণনা করেছে। সূরা ইউনুসে বলা হয়েছে: তোমরা যাতে বছরের সংখ্যা ও কাল গণনা করতে সমর্থ হও, সে জন্য তিনি (আল্লাহ) চন্দ্র ও সূর্যকে আলোকপ্রদ ও এগুলোর কক্ষপথ সুনিয়ন্ত্রিত করেছেন।

সে হিসেবে বিশ্বের মধ্যে এ যাবৎ যে ক’টি ‘সন’ ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে তন্মধ্যে হিজরী সন একটি। বর্তমান বিশ্বের ঈসায়ী বা ইংরেজী সালের পর এর স্থান ও প্রভাব। আমাদের দেশের অফিস আদালতের সময় ঠিক রাখার জন্য ইংরেজী সাল, সামাজিক পালা পার্বণের জন্য বাংলা সাল এবং ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য আরবী বা হিজরী সাল গুরুত্বের সাথে অনুসরণ করা হয়। বর্তমানে এ তিনটি সনের মধ্যে কোনটিই উপেক্ষার নয়। এক এক দিক দিয়ে একেকটির গুরুত্ব অপরিমেয় ও অলংঘনীয়। আমাদের মনে আছে, গত ঈদুল ফিতরের বিলম্বিত চাঁদ দেখা সংবাদের কথা। সেদিন দেরিতে চাঁদ দেখার সংবাদ প্রচার হওয়াতে গোটা দেশে ঈদ উৎসব নিয়ে বিশৃংখলতাপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ঈদপূর্ব রাতে প্রায় মসজিদে তারাবির নামাজ আদায় করা হয়। যা ছিল সম্পূর্ণ দুঃখজনক ও অনাকাঙ্খিত।

এ নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের সূত্রপাত ঘটেছিল। আসলে মুসলিম দর্শন অনুযায়ী, হিজরী সন শুধু বর্ষ গণনার বিষয় নয়, এ’টি মুসলমানদের অনুসরণের জন্য কুরআন হাদীসে ব্যাপক তাগিদ রয়েছে। সবচে’ বড় কথা হলো, এর অনুসরণে যদি কোন রকম গাফেলতি বা গরমিল হয় তাহলে উম্মাহ’র গোটা ঐতিহ্য ও স্বকীয়তাই ধ্বংসের মুখোমুখি হতে বাধ্য।
আর ক’দিন পর আমরা ১৪৪১ হিজরী সনে অনুপ্রবেশ করব। বিদায় জানাব ১৪৪০ সাল। এর মাধ্যমে আমরা একটি বছরকে ইতিহাসে সংরক্ষণ করছি আবার একটি বছরকে হাতে নিয়ে ইতিহাস রচনা ও জীবন সংগ্রামে মনোনিবেশ করেছি। গেল বছরটি মিল্লাতের জন্য কতটুকু সফলতা বয়ে এনেছে বা কি পরিমাণ আমাদের ব্যর্থতার দলিল হয়ে আছে, তা মূল্যায়নের অবকাশ যথেষ্ট।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, হিজরী সন মুসলমানদের ব্যাপক সফলতা, কৃতিত্ব ও বীরত্বের পবিত্র স্মারক। এ সন জাহেলিপনাকে নির্মূল করে এক নয়া জিন্দাগানী রচনার ইতিহাস। এ সন ইসলাম নামের এক নতুন ধর্ম আর মুসলিম নামের এক নতুন জাতির উত্থানের ইতিহাস। ইসলাম মুসলমানদের আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সাথে হিজরী সনের প্রবর্তন ও প্রচলনের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। তাই সঙ্গত কারণে বছর ঘুরে এ সনের আগমন ঘটলে আমাদের চিন্তা-চেতনা আর উপলব্ধিতেও নবতর উদ্দীপনা ও নতুন আত্নজিজ্ঞাসার সূচনা হওয়া উচিৎ।

স্মর্তব্য যে, আরবী বা হিজরী সন প্রবর্তনের পূর্বে আ’মূল ফীল’ বা হস্তী সন ছিল প্রসিদ্ধ। আখেরী জামানার মহান নবী হযরত রাসূলে করীম (স.) এর পবিত্র জন্মের মাত্র কয়েকদিন (পঞ্চাশ দিন, মতান্তরে বায়ান্ন দিন) পূর্বে আবিসিনিয়ার (বর্তমান দেশটির নাম ইরিত্রিয়া) খৃস্টান স¤্রাটের ইয়েমেনস্থ গভর্নর আবরাহা পবিত্র কা’বা ঘর ধ্বংস করার জন্য এক বিরাট হস্তীবাহিনী নিয়ে আসে মক্কানগরীতে। এর আগে আবরাহা তার দেশে বহু টাকা ব্যয় করে পবিত্র কা’বা ঘরের বিকল্প হিসেবে একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেন। তাদের পরিকল্পনা ছিল, তাদের নির্মিত ঘরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে তীর্থযাত্রীরা এসে ভীড় করবে এবং ক্রমাগত সে অঞ্চল হবে ব্যবসা-বাণিজ্যে উর্বর ভূমি আর গুরুত্ব কমতে থাকবে মক্কা শহরের।
কিন্তু অচিরেই তাদের পরিকল্পনা ও আশা ভেস্তে গেল। কা’বার টানে দিক বিদিকের মানুষ যেমন পাগলপারা, তাদের নির্মিত সে ঘরের দিকে কারো তেমন কোন আগ্রহ সৃষ্টি হল না। আর কেনই বা হবে? কা’বা যে মহান ¯্রষ্টা আল্লাহ তায়ালারই আদি এবং বরকতময় পবিত্র ঘর। এ’টি তামাম দুনিয়াতে মানুষের জন্য এবং এক রকম বিশ্বের মাঝামাঝি প্রাণকেন্দ্রে এর অবস্থান। এটিকে আল্লাহ মনোনীত করেছেন পথহারা মানুষের নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের পুত: স্থান হিসেবে। এ’টি কোন ব্যয়বহুল প্রাসাদ না হলেও এর আবেদন, শক্তি ও বরকত অপরিমেয়।

কিন্তু এ বাস্তব উপলব্ধিটুকুন হারিয়ে উন্মাদ আবরাহা কাবা-শরীফে হামলা ও ধ্বংস সাধনে অগ্রসর হয়। আরবের কোন শক্তি তাকে রুখার সাহস পেল না। আল্লাহতায়ালা তার এ পবিত্র ঘর রক্ষা করলেন বিস্ময়কর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তিনি বিশাল সুসজ্জিত হস্তিবাহিনীর মোকাবেলায় প্রেরণ করলেন আবাবিল নামের অতি ছোট প্রকৃতির এক ঝাঁক পাখি। এ প্রজাতির পাখি এখনো আমরা সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে (মাগরিবের সময়) আকাশে উড়তে দেখি। সেদিন এগুলোর চঞ্চুতে বহন করে আনা কঙ্করের আঘাতে হস্তি-বাহিনীর সমূহ ধ্বংস সাধিত হয়। পবিত্র কা’বা থেকে যায় অক্ষত অবস্থায়। কুরআনুল করীমের সূরা ফীল-এর পটভূমিকায় এ ঘটনাটি বিস্তারিত রয়েছে। হস্তিবাহিনীর ন্যাক্কারজনক ঘটনা গোটা আরবমূলুকে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয় এবং কুখ্যাত আবরাহার দাম্ভিকতার স্মারক হিসেবে ‘হস্তীসন’ বা আমূল ফীলের উদ্ভব ঘটে। এর প্রায় সাত দশক পরে হিজরী সন প্রবর্তনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। হযরত উমর (রাদি.) এর শাসনামলে এ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।

৬২২ খৃষ্টাব্দে মক্কা থেকে মদীনায় মহানবীর (স.) পবিত্র হিজরত ছিল ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এর মাধ্যমে পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী জীবনব্যবস্থা অতি দ্রুত সম্প্রসারণ লাভ করে। মুসলমানদের সে গৌরবদীপ্ত ঘটনার স্মারক হিসেবে প্রবর্তিত হয় হিজরী সন। ক্রমাগত তা ব্যাপকভাবে উম্মাহর পরবর্তী জীবন, কালচার, যুদ্ধ-বিগ্রহ বিজয় ও স্মৃতি গাঁথার স্মরণের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। একদিকে রয়েছে কুরআন হাদীসে এ চান্দ্রিক সালের ব্যাপক গুরুত্বরোপ, অন্যদিকে, এর দর্পণে গ্রথিত রয়েছে উম্মাহর অনুসরণের এবং অনুপ্রেরণার যাবতীয় সন তারিখ। তাই এ হিজরী সন ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য একটি অলংঘনীয় বর্ষপঞ্জী।

লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট