চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

ও মানুষ, নিশ্চয় এ বিশ্ব একদিন মানবিক হবে

হোমশিখা দত্ত

২৯ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ

আন্দরকিল্লা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অফিসের বাউন্ডারি লাগোয়া ফুটপাথে একজন বয়স্ক ভিক্ষুক বসে থাকে। যাওয়া-আসার পথে কতো ভিক্ষুকই দেখা যায়, কাউকেই চোখ মেলে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না কেউ। কিন্তু ঐ লোকটাকে আমার চোখে পড়েছিলো একটা অদ্ভূত কারণে। বাউন্ডারি ওয়ালে হেলান দিয়ে বসে ময়লা আর পুরানো হয়ে যাওয়া বিশাল বোঁচকার উপর এক কনুই রেখে সে আনিসুল হকের ‘মা’ পড়ছে! লাল টকটকে মলাটটাই দৃষ্টি টেনে নিয়েছিলো আমার। থমকে দাঁড়িয়ে যাইনি, হাঁটার গতি কমে এসেছিলো। সে কি আসলেই পড়ছে বইটা? শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদ আর তাঁর মায়ের গল্প পড়ে সে কি আবেগে আপ্লুত হচ্ছে? নাকি এমনি তাকিয়ে আছে? সে কি পড়তে পারে? কেন সে ভিক্ষা করে? চুল দাড়ি পেকে গেছে, শরীরে বয়সের ধকলের ছাপ স্পষ্ট। ছেলে মেয়ে কি তাড়িয়ে দিয়েছে বাবাকে? এমন প্রশ্নের বান এসেছিলো সেই কয়েকটা মুহূর্তে… এরপর থেকে যখনই এপথে যাই বা আসি লোকটাকে দেখতে দেখতে যাই। বছরের শুরুর দিকে সেন্টারের বাচ্চাদের স্পোর্টসে বিস্কিট-দৌড়ের জন্য লেক্সাসের প্যাকেট কিনে নিয়ে গেছিলাম। ফেরার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম বেঁচে যাওয়া প্যাকেটগুলো। লোকটার সামনে পৌঁছে এক প্যাকেট বের করে দিলাম। মুখ তুলে আমাকে কী একটা বললো, ভালো শুনতে পেলাম না। তবে বুঝে নিলাম, জানতে চাইছে আমার জন্য আর আছে কিনা। আমার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ দেখিয়ে বললাম, আরো চারটা প্যাকেট আছে। শুনে সন্তুষ্ট চিত্তে প্যাকেট হাতে টা টা দিলো আমাকে। সেদিনের পর মনে হলো, সামান্য হলেও মেন্টালি ইমব্যালান্সড লোকটা। আরো কয়েক কদম এগিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে উঁকি দিলাম, সে নিবিষ্ট মনে প্যাকেট খোলার চেষ্টা করছে। গতকাল ফেরার সময় দেখি, সে একেবারে দু’হাত সামনে বাড়িয়ে ভিক্ষা চাইছে। কী আকুতি চোখে! তার নাকের ডগা দিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে যেতে পারিনি। ফুটপাথে না উঠে পাশে সাইড করা গাড়ির ওপাশ দিয়ে ঘুরে চলে গেলাম। তাও সেই উঁকি দেওয়ার জায়গায় পৌঁছে আমার হাত দু’টা ব্যাগ খুলে পার্স থেকে দশ টাকার নোট একটা বের করে ফেললো। আবার গিয়ে দাঁড়ালাম লোকটার সামনে, লোকটাও ফিরে তাকালো মুখ তুলে। নোটটা বাড়িয়ে দিলাম, লোকটাও হাত বাড়িয়ে নিলো সেটা। দশ টাকা ভিক্ষা দেওয়ার সাহস রাখি আমি, এটা জাহির করতে এই ঘটনা বলছি না। মূখ্য ব্যাপার হলো, প্রাপ্তির পর প্রাপকের অভিব্যক্তি। নোটটা হাতে নিয়ে লোকটা একটু ঝুঁকে সেটা দেখলো। দিয়েই আবার ফিরে হাঁটা দিইনি তখনো। টাকার অঙ্ক দেখে যেটা করলো সে, ওটা আমি ভাবিনি। নোটসহ দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকালো নমস্কার করার মতো! কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেছিলাম সেই মুহূর্তে। আমার ঠাকুরদাদার মতো বুড়া একটা মানুষ আমাকে কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার দিচ্ছে শুধুমাত্র পরস্পরের আর্থিক অবস্থার পার্থক্যের কারণে! বড় খারাপ লাগে, ধরিত্রী মাতার আর কোনো সন্তানের মধ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ নাই। শুধু মানুষ ছাড়া। মানুষ ছাড়া আর কেউ পৃথিবী দূষিত করে না। সব প্রাণীই যথাক্রমে জগৎ, বিভাগ/পর্ব, শ্রেণি, বর্গ, গোত্র, গণ আর প্রজাতিতে বিন্যস্ত। কিন্তু সেখানে তো কোনো মারামারি কাটাকাটি নাই। অনেক প্রাণীই সঙ্গীর মন জয় করার জন্য দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় বা দলের অধিপতি হতে যুদ্ধ করে। এসব তো স্বাভাবিক একটা জৈবিক ও প্রাকৃতিক ব্যাপার। এসব যুদ্ধ ওখানেই শেষ হয়। কিন্তু মানুষই একমাত্র, যে অযথা, অকারণে, খারাপ অভিসন্ধিতে সবকিছু ধ্বংস করে, নষ্ট করে, ময়লা করে, দূষিত করে। এজন্যই রেডিসনে মিডনাইট পার্টি হয়, আর তার পাশের ফুটপাথে পথশিশু ভীষণ ঠা-ায় কুঁকড়ে ঘুমায়। এজন্যই আমার ঠাকুরদাদাসম আর মানসিক ভারসাম্যহীন ভিক্ষুক একটা দশ টাকার নোট পেয়ে ছলছল চোখে আমাকে কৃতজ্ঞতার নমস্কার জানায়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট