চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

গুজব, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও টেকসই উন্নয়ন

লায়ন এ কে জাহেদ চৌধুরী

২৬ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:২৫ পূর্বাহ্ণ

বাঙালিরা নাকি ‘হুজুগে’ জাতি। আমি কিন্তু এ কথায় একেবারেই একমত নই। যদি বাঙ্গালী জাতি ‘হুজুগে’ হত, তাহলে ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মত বিশাল বিশাল কালজয়ী অর্জনের মাধ্যমে ইতিহাস রচনা করতে পারত না। যে জাতি সৃষ্টিতে পারদর্শী সে জাতিকে কোনভাবেই ‘হুজুগে’ বলা সমীচিন হতে পারে না।

কিছুদিন ধরে দেশের আনাচে কানাচে একটি গুজব চাউর হয়ে গেছে যে, পদ্মা সেতুর জন্য শিশুদের মাথা লাগবে। একটি সেতুর জোড়া লাগানোর জন্য শিশুর মাথার প্রয়োজনীয়তার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই। তারপরও একশ্রেণীর মানুষ তা বিশ্বাস করছে। যুদ্ধাপরাধের অপরাধে দন্ডিত মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে এমন কথাও এক শ্রেণীর মানুষ বিশ্বাস করেছে। সাঈদী সাহেবকে চাঁদে দেখার জন্য দেশব্যাপী হাজার হাজার নারী-পুরুষ মধ্যরাতে ঘর থেকে বের হয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছিল। তবে কেউ দেখেছে এমন তথ্য কেউ দিতে পারেনি। ওই সময়ে বন্ধুভাবাপন্ন এক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনিতো রাতে হাজার হাজার মানুষের সাথে বের হয়েছিলেন। আপনি চাঁদে কিছু দেখেছিলেন?” সেই কর্মকর্তা হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, “ভাই আমিওতো বলেছিলাম ঐতো সাঈদী সাহেবকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে, যদিও আমি কিছুই দেখি নাই।” এই হল আমাদের সমাজের বাস্তব অবস্থা।

সেতুর জন্য মানুষের মাথার প্রয়োজনীয়তা বা মাওলানা সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার মত ঘটনার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা ভিত্তি না থাকলেও এক শ্রেণীর মানুষ তা বিশ্বাস করেছে। তবে কেউ বিশ্বাস করেছে সরল মনে, আবার কেউ বিশ্বাস করেছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে যারা বিশ্বাস করেছে বা বিশ্বাস করার ভান করেছে তাদেরকে চিহ্নিত করাটাই বর্তমান সময়ের জরুরী কাজ। মানুষের মাথা কাটার অমূলক ও ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানো হয়েছে, তাতে এই পর্যন্ত সারাদেশে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনীতে অন্তত আটজন নিরীহ মানুষের প্রাণ সংহার হয়েছে এবং অগণিত নারী পুরুষ আহত হয়েছে। আমরা মনে করি সমাজে বা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য এটা একশ্রেণির সমাজবিরোধী মানুষেরই কাজ। অন্যদিকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এটিকে “মব সাইকোলজি” বলা হয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সমাজে যখন নির্দিষ্ট কোন বিষয় নিয়ে আতংক সৃষ্টি হয় বা মানুষ নিরাপত্তাহীণতা বোধ করে, তখন তাদের মধ্যে এক প্রকারের মানষিক অবসাদ সৃষ্টি হয়। ফলে মানুষের মধ্যে চলমান ঘটনা প্রবাহ নিয়ে একটি বিশ্বাস তৈরী হয় এবং ঐ বিশ্বাসের ভিত্তিতে সে সব কিছুকে বিবেচনা করে। ফলে কেউ কাউকে আঘাত করতে দেখলে উচিত অনুচিত বিবেচনা না করে সকলেই তাতে সামিল হয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, “মব সাইকোলজি”র বৈশিষ্ট হল, যারা গণপিটুনী দেয় তাদের উচিত অনুচিত বা ভালমন্দ বোঝার মত বিবেক কাজ করে না। তাদের মধ্যে সৃষ্ট ধারণার উপর ভিত্তি করেই তারা ক্রোধ প্রশমণের জন্য গণপিটুনী বা ধ্বংসাত্মক কাজে অংশ নেয়। এভাবেই স্বার্থান্বেষী মহল বা গুজব সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়। কিছুদিন আগে গণপিটুনীর ঘটনা এমন উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে যে, ঢাকায় একজন মা সন্তানের ভর্তির জন্য স্কুলে গেলে ঐ মাকে পর্যন্ত ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মানসিক রোগী, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই এমন ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। এভাবে সারা বাংলাদেশে অনেক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, যা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে সকলেই অবগত হয়েছেন।

উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য এবং এহেন অনেক ন্যাক্কারজনক ও মর্মান্তিক ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ লক্ষ্য করা গেছে। যার মধ্যে অন্যতম হল এধরনের গণপিটুনীর ঘটনায় সম্পৃক্তদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা। প্রচারমাধ্যমে পুলিশের জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন বক্তব্যেও মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে। তথাপি আরও কিছু পদক্ষেপ জরুরী ভিত্তিতে গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে সচেতন মহল মনে করেন। যেমন: মসজিদের ইমাম সাহেবদের জুমার নামাজে সচেতনতামূলক বক্তব্য দেওয়া, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচারপত্র বিলি, প্রতিটি ইউনিয়ন পৌরসভা এবং নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে মাইকিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে সতর্ক করা, পুলিশ ও সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের নজরদারী বৃদ্ধি করা। এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে এধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে না হয় বা গুজব সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করা যায়।

আমাদের সমাজে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অবস্থান, সামাজিক কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, পশ্চাৎপদতা, অন্ধ বিশ্বাস, রাজনৈতিক মতদ্বৈততাসহ নানাকারণে এধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়। সুতরাং, এর পুনরাবৃত্তি রোধে সকল মহলকে সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, সামাজিকশৃঙ্খলা, দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিয়ামক শক্তি। সামাজিক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপেক্ষায় যারা আছে, তাদেরকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই অশুভ শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করা দরকার।

লেখক: কলামিষ্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট