চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বঙ্গবন্ধু ও যুবসমাজ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মোহীত উল আলম

১৬ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৪৬ পূর্বাহ্ণ

এজন্য দেখা যায়, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে মেধা ও শ্রম দিয়ে লেখাপড়ায় উন্নতি করে ভালো চাকরি করে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাই অধিকাংশ শিক্ষিত লোকের আরাধনা হয়। এ গোত্রভুক্ত লোকেরা, তারা ধনী হোক, গরিব হোক বা মধ্যবিত্ত হোক, কেবলই আত্মোন্নয়ন মানসিকতায় পরিপুষ্ট থাকে বলে এদের সঙ্গে মানবিক শিক্ষা, সমাজসেবা বা দেশপ্রেমের সম্পর্ক ততোটুকুই থাকে যতোটুকু আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন। এদের দক্ষতা আছে কিন্তু একান্ত স্বার্থসংশ্লিষ্ট চিন্তায় নিয়োজিত থাকে বলে এদের মধ্যে প্রচুর সাধারণ বোধ বুদ্ধির অভাব লক্ষ্য করা যায়। এদের মেধার প্রয়োগ হচ্ছে শুধু নিজের অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য যতোটুক ুপ্রয়োজন, কিন্তু দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে এরা ৯টা-৫টার বাইরে দায়িত্ব নেবে না।
দিনশেষে এদেরকে কেরানিসুলভ মনোবৃত্তির অধিকারী হিসেবে দেখা যায়। এরা প্রকৃত শিক্ষার চেয়ে সনদভিত্তিক শিক্ষাকে বেশি দাম দেয়। কাজের চেয়েও চেয়ারকে দাম দেয় বেশি। সৃজনশীল চিন্তা করার চেয়েও গৎবাঁধা চিন্তা করতে এরা অভ্যস্ত। আরেক শ্রেণির শিক্ষিত লোক এবং শিক্ষার্থী আছে যাদের মধ্যে সমাজ ও দেশ নিয়ে চিন্তা আছে কিন্তু মেধায়, চিন্তাশক্তি ও শ্রমের বেলায় এরা বেশ খানিকটা পেছনে। এরা বিশাল কর্মীবাহিনীতে পরিণত হয়, এবং শিক্ষক বলেন শিক্ষার্থী বলেন এরা পড়াশুনা ও জ্ঞানচর্চা থেকে দূরে থাকে। এরা মাথা ব্যবহার না করে হাত এবং জিভ ব্যবহার করতে সচেষ্ট থাকে। অনেক সময় এরা ‘ব্যাড মানি ড্রাইভস গুড মানি আউট অব সার্কুলেশন’-এর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরাও পরে উল্লেখিত শ্রেণির আত্মমগ্নতা থেকে দূরে থাকলেও আসলে দূরে নয়। কারণ দলীয় রাজনীতির মধ্যে যে ব্যক্তিপূজার বা কাল্টিজমের চর্চা হয় এরা তার সাক্ষাৎ অনুসারী ও রূপায়ন কারী। উপমন্ত্রীর মতে ছাত্রসমাজের মধ্যে এই কাল্টিজমই সবচেয়ে খারাপ দিক। এরা আদর্শের চেয়েও ব্যক্তিমানুষকে পূজা করে বেশি। এরা ভারে কাটে, ধারে কাটে না। পড়াশুনা ও জ্ঞানচর্চার পথ পরিহার করে এরা নানরকম অর্থনৈতিক অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জীবন ও সমাজে ব্যাপক প্রতিষ্ঠা পায়। এদের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার জ্ঞান খুব টনটনে। সমাজে এদের সফলতা এটাও প্রমাণ করে যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদের কারণে শিক্ষিত লোকের চেয়ে অল্প-শিক্ষিত লোকেরাই বাস্তব জীবনে অনেক বেশি সফল। তৃতীয় পর্যায়ের যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আছেন তাঁরা যুগপৎ মেধাবী ও দেশপ্রেমিক। এ শ্রেণির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা হচ্ছে একটি অবনতশীল সমাজকে উন্নয়নশীল সমাজে পরিণত করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত গোষ্ঠী। এরা প্রচুর পরিমাণে সৎ এবং বিবেকবান হয় এবং কোন অবস্থাতেই দেশের স্বার্থ বিসর্জন দেয় না। দলীয় স্বার্থের চেয়েও এরা দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখে। বস্তুত এরা নিজেদেরকে ছাড়িয়ে চিন্তা করতে পারে। কিন্তু বাস্তবজীবনে এদের সফলতা প্রায় নিরব পর্যায়ে থেকে যায়। এদের বড় ব্যর্থতা হলো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে এরা যুক্ত হতে পারে না। এমনকি ভানও করে না। এজন্য অনেক সময় সাধারণ মানুষ এদের ভূমিকা নিয়ে দন্দ্বে থাকে।
তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা নাও দিতে পারে। আমাদের সমাজে শিক্ষার হার এখনো যথেষ্ট নীচে। সেটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার। কিন্তু যারা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষিত নয়, কিংবা আমরা যাদেরকে নিরক্ষর বলি তাদেরকে একাধারে অশিক্ষিত বলা ভুল। তারাও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতিরেকেই চরিত্রগতভাবে জ্ঞানী ও বোধসম্পন্ন লোক হতে পারে, তারা যার যার পেশায় শিক্ষিত হতে পারে। যেমন একজন চাষী নিরক্ষর হতে পারে, কিন্তু ধান বুননের বেলায় তাকে অশিক্ষিত বলা যাবে না।
বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত ভাষণে শিক্ষা নিয়ে কোন সংকীর্ণ নয় সার্বিক চিন্তা-চেতনা ছায়া ফেলেছে বলা যায়। ঐ একই ভাষণে বলছেন: “সেইজন্য আমি তোমাদের বারবার বলি, আত্মসমালোচনা কোরো। আত্মসংযম কোরো। তারপর আত্মশুদ্ধি কোরো। নাহলে হবে না কিছু। তোমাদের মানুষ হতে হবে। ছাত্র তোমরা থাকবা না।
আজ তোমরা ছাত্রলীগ, ছাত্র-প্রতিষ্ঠান, মানে ছাত্র-আন্দোলন করতেছ। তোমাদের আর তিন বৎসর, চার বৎসর, পাঁচ বৎসর, দুই বৎসর পরে তোমরা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাবা। কেউ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক হবা, কেউ সরকারি কর্মচারী হবা, কেউ তোমরা সেখানে ব্যবসায়ী হবা, কেউ তোমরা রাজনীতিবিদ হবা, কেউ পার্লামেন্টের মেম্বার হবা, কেউ মন্ত্রী হয়েযাবা, কেউ প্রধানমন্ত্রী হয়েযাবা। এখন তোমাদের শিক্ষার সময়। এই সময়ে যদি শিক্ষা গ্রহণ করতে না পার ভবিষ্যৎ জীবনেতা তোমরা পারবানা।
তাই তোমাদের কাছে আমার অনেক আশা, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান কোরো। বাবারা, আল্লাহ্র ওয়াস্তে একটু লেখাপড়াও কোরো। একটু লেখাপড়া কোরো। একটু মানুষ হও। স্বাধীন দেশ এক রকমের আর পরাধীন দেশ অন্য রকমের। স্বাধীন দেশে তোমরা যতই চুম্বক হও যা কিছুই কোরো না কেন তোমাদের রিসপন্সিবিলিটি একদিন নিতে হবে। এক গ্রুপ চলে যাবে, আরেক গ্রুপ আসবে। আরেক গ্রুপ চলে যাবে, আরেক গ্রুপ আসবে। দেশ স্বাধীন, দেশ স্বাধীন থাকবে।”
জয় বঙ্গবন্ধু!
জয়বাংলা!
জয়বাংলাদেশ! সমাপ্ত

লেখক : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ ও ডিন, প্রিমিয়ার বিশ^বিদ্যালয় চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট