চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

কোরবানির গুরুত্ব ও ফজিলত

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

১১ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৪৫ পূর্বাহ্ণ

কুরবানি শব্দটি এসেছে “কুরবান” থেকে। কুরবান মানে নৈকট্য, সান্নিধ্য, উৎসর্গ ইত্যাদি। জিলহজ মাসের দশ, এগার বা বার তারিখ আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সুন্নাতের অনুসরণপূর্বক ইসলামি শরিয়া নির্ধারিত পশুজবাই করাকে কুরবানি বলা হয়। ইমাম ফখরুদ্দিন রাযি বলেন, যে পশু বা দানের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অর্জন করার নাম কুরবান। নিজের যৌক্তিক প্রয়োজন মেটানোর পর কারো নিকট যদি সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা সে পরিমাণ নগদ টাকা থাকে তাহলে তার ওপর একটি ছাগল বা ছাগল জাতীয় পশু কুরবানি দেয়া ওয়াজিব। গরু বা গরুজাতীয় পশু হলে অন্তত তার একভাগ কুরবানি দেয়া ওয়াজিব। কুরবানির জন্য উল্লেখিত পরিমাণ সম্পদ পূর্ণবছর স্থিতি থাকা আবশ্যক নয়; যা যাকাতের ক্ষেত্রে আবশ্যক।
কুরবানির মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহতায়ালার বড়ত্ব প্রকাশ এবং তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। প্রাপ্ত নেয়ামত স্বীকার, কৃপণতার চরিত্র থেকে মুক্তি, দরিদ্রদেরকে দান ও আপ্যায়নপূর্বক তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করাও কুরবানির উদ্দেশ্য। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের এ প্রচেষ্টার অপর নাম তাকওয়া। যেমন বলা হয়েছে, “আমি প্রত্যেক জাতির জন্য কুরবানি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা আল্লাহর দেয়া পশু যবেহ করার সময় তাঁর নাম উচ্চারণ করে” (সুরা হজ: ৩৪)। আরো বলা হয়েছে, “পশুর রক্ত-মাংস আল্লাহর নিকট পৌঁছে না, তাঁর নিকট পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া” (প্রাগুক্ত: ৩৭)। প্রাসঙ্গিক আরেকটি আয়াত হলো, “হে রাসূল, আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ শুধু আল্লাহর জন্য, যিনি সমগ্র জগতের পালনকর্তা (সুরা আল-আন্আম: ১৬২)।” হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, “কুরবানির দিন পশু জবেহের চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় মানবজাতির আর কোন ইবাদত নেই”(তিরমিযি)। উল্লেখিত আয়াত ও হাদিসের আলোকে কুরবানির লক্ষ্য- উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং পশু ক্রয়ের টাকা, জবেহের পদ্ধতি, জবেহের উদ্দেশ্যসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি যদি শরিয়তসম্মত না হয় তাহলে কুরবানির মূললক্ষ্য অর্জিত হবে না। অর্থাৎ নিয়তের পরিশুদ্ধি, বৈধসম্পদের ব্যবহার, পশু হালালকরণ পদ্ধতি যথাযথ হতে হবে। লোকদেখানো, সামাজিকরীতি মানা বা কেউ কিছু বলবে ইত্যাদি মানসিকতা নিয়ে পশু জবেহ করলে কুরবানি হবে না। অনুরূপভাবে কারো আমানত নষ্ট করে বা পাওনা রেখে দিয়ে কুরবানি করলে তা-ও কবুল হবে না। চুরি, ডাকাতি, ঘুষ, সুদ, আত্মসাৎ, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ দিয়ে কুরবানি দেয়াও বৈধ নয়। মোদ্দাকথা হলো, কুরবানি মানে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের প্রচেষ্টা। তাই যেসব ধারণা, উপার্জন ও কাজে শরিয়তের নিষেধাজ্ঞা আছে সেগুলো উপেক্ষা করে কুরবানি করলে তা আদায় হবে না। এক্ষেত্রে লৌকিকতা, হীনপ্রতিযোগিতা, বিত্ত-বৈভব জাহির করার মানসিকতা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অপরিশুদ্ধ নিয়ত, অবৈধ সম্পদ বা অননুমোদিত পন্থায় কৃত কুরবানি আল্লাহর তায়ালার নিকট অগ্রহণযোগ্য। গৃহীত হবে তাঁর কুরবানি, যিনি আল্লাহপ্রেম ও খোদাভীতি নিয়ে সুন্নাত তরিকায় কুরবানি করেন। যেমন বলা হয়েছে, তিনি শুধু মুত্তাকিদের কুরবানি কবুল করেন” (সুরা মায়িদা: ২৭)।
কুরবানি বা আল্লাহ নামে পশু বা সম্পদ উৎসর্গ করার বিধান যুগে যুগে প্রত্যেক জাতির জন্য বিধিত ছিল। হযরত আদম (আ.) এর পুত্রদ্বয় তথা হাবিল-কাবিলের বিয়ের পাত্রি নিয়ে বিতর্ক হলে আল্লাহতায়ালা তাদের উভয়কে স্ব স্ব সম্পদ কুরবানি করার নির্দেশ দেন। যেহেতু কাবিলের দাবি ছিল অযৌক্তিক এবং শরিয়তবিরোধী সেহেতু তার কুরবানি কবুল হয়নি। পক্ষান্তরে আমরা কুরবানি করছি মুসলিমজাতির পিতা ইব্রাহিম (আ.) এর সুন্নাত হিসেবে; যা করার জন্য আমাদের নবি (স.) নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি নিজেই করেছেন। তিনি বলেন, “কুরবানি তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের সুন্নাত” (সুনানে ইবন মাজাহ)। তিনি আল্লাহরতায়ালার পক্ষ থেকে স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়ে স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাঈলকে (আ.) আল্লাহর নামে কুরবানি দেয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন এবং তাঁর গলায় ছুরি চালান। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় ছুরি কাজ করেনি। কারণ, আল্লাহতায়ালা তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য এ নির্দেশ দিয়েছিলেন মাত্র। হযরত ইব্রাহিম আ. উক্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র। উভয়ে আল্লাহপ্রেম ও খোদাভীতিকে নিজেদের জান-মালের ওপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আল্লাহতায়ালা একটি জান্নাতি দুম্বা পাঠিয়ে হযরত ইসমাইল (আ.)কে রক্ষা করলেন। তখন থেকে পশুকুরবানির বিধান আরোপ করা হয়। নমরূদ কর্তৃক হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করা হলে তিনি আল্লাহর হুকুমে নিরাপদে বেরিয়ে আসেন। নমরূদ এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করে বলেছিল, আমি তোমার রবের যে শক্তি প্রত্যক্ষ করলাম তার শুকরিয়া আদায় করার উদ্দেশ্যে কুরবানি দিতে চাই। হযরত ইব্রাহিম (আ.) বললেন, যতক্ষণ না তুমি মিথ্যাধর্ম পরিত্যাগ করে সত্যধর্মে গ্রহণ করবে, ততক্ষণ তোমার কুরবানি কবুল হবে না। নমরূদ তবুও চার হাজার গরু কুরবানি করেছিল। সুতরাং কুরবানির বিধান যুগে যুগে ছিল, আছে এবং থাকবে। তাই এটাকে অপ্রয়োজনীয়, অপচয় বা অত্যাচার বলার অবকাশ নেই। কারণ, একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাকে উপলক্ষ করে এর সূচনা হয়েছে। পৃথিবীর সব জাতির এমন তাৎপর্যপূর্ণ দিবস আছে। সেই দিবসসমূহ উদ্যাপন করার ক্ষেত্রে ব্যয় করাকে কেউ অপ্রয়োজনীয় মনে করে না। এ উপলক্ষে সম্পদ ব্যয় করাকেও অপচয় মনে করে না। তবে ইসলাম কল্যাণকর, যৌক্তিক ও বাস্তব ধর্ম হিসেবে মহৎ উদ্দেশ্যে যৌক্তিকভাবে কুরবানির বিধানারোপ করেছে। যেমন, ত্যাগের শিক্ষা, কৃপণতা মুক্ত জীবন গড়া, আল্লাহতায়ালার নির্দেশ পালনে অভ্যস্ত হওয়া, আত্মীয়-অনাত্মীয়, প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের প্রতি আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা দেখানো ইতাদি। অবশ্য একদিনে এতগুলো পশু যবেহ করার যৌক্তিকতা নিয়েও কারো কারো প্রশ্ন আছে। কিন্তু ইসলামি শরিয়া তিন দিন পর্যন্ত কুরবানি করার অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমানে যেখানে কুরবানি বেশি হয় সেখানে সব কুরবানি প্রথম দিন না করে পরবর্তী দিনগুলোতে করা হলে কুরবানির সাথে সশ্লিষ্ট বহু বিষয়ের উদ্দেশ্য আরো ভালোভাবে সাধিত হবে। আরেকটি বিষয় হলো কুরবানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে। ফলে আধুনিক প্রযুক্তির সৎব্যবহার করে কুরবানির গোস্তের অপচয় রোধ করা সহজ হয়েছে।
গরু বা গরু জাতীয় পশু দ্বারা কুরবানি করা হলে তার বয়স কমপক্ষে দুই বছর হতে হবে। তার চেয়ে কম বয়সী পশু কুরবানি দিলে আদায় হবে না। কিন্তু বর্তমানে পশু মোটা-তাজাকরণ পদ্ধতির সুবাদে অধিকাংশ কুরবানিদাতা ধোকার শিকার হন। তাই গরু বা সে জাতীয় পশুর বয়স দুই বছর পূর্ণ হয়েছে কিনা তা ভালভাবে যাচাই করতে হবে। ছাগল বা ছাগলজাতীয় পশুর বয়স যদি এক বছর পূর্ণ না হয়, কিন্তু এক বছর বয়সীর মত দেখায় তাহলে তা দিয়ে কুরবানি জায়েয হবে। কুরবানির পশুর গোস্ত তিন ভাগ করে একভাগ নিজের পরিবার-পরিজন, আরেকভাগ আত্মীয়-স্বজন এবং আরেক ভাগ দরিদ্রদের নিকট বন্টন করা সুন্নাত। দরিদ্রসমাজে বা দুর্ভিক্ষের সময় উক্ত পদ্ধতিতে বন্টন করা ওয়াজিব। কুরবানির মাধ্যমে ত্যাগের দীক্ষা নেয়া এবং অপরের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সতর্ক হওয়া জরুরি। কারো কুরবানি যদি অপরের অযৌক্তিক কষ্টের কারণ হয়ে থাকে তাহলেও কুরবানির উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। যেমন, পশুর রক্ত, নাঁড়িভুড়ি তথা উচ্ছিষ্ট অংশ ঠিকভাবে মাটিতে পুঁতে না দেয়া, রক্ত বা ময়লা ধুয়ে পরিস্কার না করা বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা উপেক্ষা করা ইত্যাদি কুরবানি কবুল হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ময়লা-আবর্জনা যথাযথভাবে দূর করা বা সুনির্দিষ্ট পন্থায় পরিষ্কারের ব্যবস্থা না করলে রোগ-জীবাণু সৃষ্টি হবে, যা শুধু পরিবেশ দূষণ করবে না, বরং কুরবানিদাতাসহ সবার ক্ষতির কারণ হবে। অতএব আমরা কুরবানি করব আল্লাহতায়ালার আইন মেনে। পাশাপাশি সচেষ্ট থাকব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে চলার। তাহলে আমাদের কুরবানি যথাযথ হবে। মনে রাখতে হবে, সাধারণ পশু আর কুরবানির পশু এক নয়, কুরবানির পশুকে আল্লাহতায়ালার কুদরতের নিদর্শন বলা হয়েছে। তাই পশু ক্রয়ের বা কুরবানির নিয়ত করার পর উদ্দিষ্ট পশু থেকে শ্রম নেয়া, দুধ দোহন করা ইত্যাদি নাজায়েয। কুরবানির পশু দ্বারা লড়াই দেয়া সম্পূর্ণ হারাম। উক্ত পশুর চামড়া এবং সংশ্লিষ্ট জিনিষ, যেমন তার রশি কোন দরিদ্রকে দিয়ে দিতে হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক,
আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট