চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পবিত্র হজ সুদৃঢ় হোক মুসলিমবিশ্বের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন

১০ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৩০ পূর্বাহ্ণ

আজ পবিত্র হজ। বিশ্বমুসলিমের সর্ববৃহৎ সম্মিলন। আজ লাখো হাজির কণ্ঠে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শরীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়ামাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারীকা লাক্’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠবে আরাফার ময়দান। এই তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে পবিত্র মক্কা নগরীতে হাজি সাহেবানদের বুলন্দ আওয়াজে এক অনির্বচনীয় দৃশ্যের সৃষ্টি হবে। বিঘোষিত হবে মহান আল্লাহর একত্ব ও মহত্ত্বের কথা। কাফনের কাপড়ের মতো সাদা দু’টুকরো ইহরামের কাপড় পড়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়বেন আল্লাহর বান্দাহগণ। সব হাজিই সমস্বরে আত্মসমর্পণ ঘোষণা করবেন মহান আল্লাহর দরবারে। আল্লাহ তায়ালা এবং বান্দার মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের অনন্য আবহে বিরাজ করবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্য।
হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। হজ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা বা সংকল্প করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ পালনার্থে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্ধারিত তারিখে, নির্দিষ্ট স্থান তথা কাবা শরিফ ও তৎসংশ্লিষ্ট স্থানগুলো জিয়ারত করার সংকল্প করাকে হজ বলা হয়। এটি শারীরিক ও আর্থিক ইবাদতগুলোর মধ্যে অনন্য। আর্থিক ও দৈহিকভাবে সামর্থ্যবানদের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। হজ অলৌকিক ভাবধারায় অন্তরাত্মা অবগাহিত হওয়ার এক অপূর্ব সুযোগ তৈরি করে দেয়। হজের মাধ্যমে হাজিদের ঈমানে এক নবতর প্রেরণার উজ্জীবন ঘটে। এটি উম্মতে মুহাম্মদীর (দ.) জন্যে এক দুর্লভ প্রাপ্তি। ইসলাম চায় তার অনুসারীরা যাতে এই সর্ববৃহৎ সম্মেলন থেকে সরাসরি উপকৃত হয়। ইমাম সাদেক (রা.) যথার্থই বলেছেন, ‘ইসলাম হজের মাধ্যমে এমন একটি বিধান দিয়েছে যার ফলে প্রাচ্যের মানুষ বলুন, আর পাশ্চাত্যের মানুষই বলুন, সবাই একত্রিত হতে পারে এবং পরস্পরের সাথে পরিচিত ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে। হজে রয়েছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক নানাবিদ শিক্ষা ও কল্যাণ। এটি একটি সমষ্টিগত ইবাদত এবং জীবনশিক্ষার বৃহত্তম পাঠশালা। এটি একত্ব ও সাম্যের এক মোহনীয় চিত্র। হজের আনুষ্ঠানিকতায় সারাবিশ্বের মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সৃষ্টি হয় এক অনাবিল ভ্রাতৃত্ববোধের।
হজ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা জাগ্রত করার পাশাপাশি মানুষের মনে বৈষম্যের পরিবর্তে সাম্যের শিক্ষাকেই জোরদার করে। কারণ সামর্থ্যবান সকল মুসলমানই হজ করার অধিকার রাখেন। নি¤œবর্ণের বা গায়ের রং কালো বলে হজ করতে পারবেন না কিংবা ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা, উচ্চবর্ণ-নি¤œবর্ণের জন্যে আলাদা ব্যবস্থায় হজ হবে, এমন বিধান নেই হজের ক্ষেত্রে। জাতি-বংশ-গোত্র-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সামর্থ্যবান মুসলমানই কোনো ভেদাভেদহীন পরিবেশে হজ করতে পারবেন। এই বিধান রহিত করার ক্ষমতা কারো নেই। তাই হজ থেকে মানুষ সাম্যের শিক্ষা পায়, বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার শিক্ষা পায়, শিক্ষা পায় মানবিক চেতনায় পুষ্ট হয়ে সমগ্র মানবজাতি ও জগতবাসীর কল্যাণে নিজেকে সমর্পণ করার। হজের মধ্য দিয়ে আল্লাহর আনুগত্য, আল্লাহর নৈকট্য লাভ, আল্লাহভীতি এবং রাসূল (সা.)এর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালবাসার প্রকাশ এবং তার অনুপম আদর্শ অনুসরণের দুর্লভ সুযোগ লাভ হয়।
হজের অন্তর্নিহিত শিক্ষাই হচ্ছে বর্ণ-গোত্র এবং জাতিগত বৈষম্যের উর্ধ্বে ওঠে একটি সাম্যপূর্ণ ও সৌহার্দ্যময় সমাজ নির্মাণে নিজেকে উৎসর্গ করা, মুসলিম বিশ্বের ঐক্য সাধন এবং মানুষের মধ্যে বিদ্যমান যাবতীয় খারাপ বিষয়গুলো বিসর্জন দিয়ে নিজেকে যাবতীয় কল্যাণকর্মে উৎসর্গ করা। হজের এই শিক্ষা সবার জীবনে ধারণ করলে সত্যিই একটি হানাহানি ও বিদ্বেষমুক্ত শান্তিপূর্ণ বিশ্বগড়া সম্ভব হবে। হজে আল্লাহর নির্দেশে সমগ্র বিশ্বমানবকে আপন করে পাওয়ার আকুতিটুকুই একান্ত কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবেই হৃদয়ের গভীরে অঙ্কুরিত হয় বিশ্বভ্রাতৃত্বের এক শুচিশুদ্ধ ফল্গুধারা। তাছাড়া হজের এই মহাসমাবেশে সমগ্র বিশ্বমানব এমনই একটি কেন্দ্রবিন্দুতে এসে সমবেত হন, যা মানবজাতির প্রথম আবাসস্থল। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য সমগ্র আদম সন্তানের জন্মগত অবিচ্ছেদ্য ঐক্যের অনুভূতি তীব্রতর করে সকল শ্রেণির মানুষকে একই সারিতে এক জামাআতে দাঁড় করানো। তাই বিশ্বজনীন এ অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষাই হচ্ছে হজের অন্যতম প্রধান শিক্ষা। হজের শিক্ষা সবার জীবনে ধারণ করলে সত্যিই একটি হানাহানি ও বিদ্বেষমুক্ত নিরাপদ শান্তিপূর্ণ বিশ্বগড়া সম্ভব হবে।
মুসলিম জাহান ও উম্মাহর এই ক্রান্তিকালে হজের মূল শিক্ষা ও প্রেরণা এবং বিশ্বনবির (সা.) বিদায়হজের ঐতিহাসিক শিক্ষা বিশ্বমুসলিমের উত্তরণের সবচেয়ে কার্যকর পাথেয় হতে পারে। আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত সারাবিশ্বের মুসলমানদের অন্তরে সেই শিক্ষার আলো উদ্ভাসিত হোক এবং সারাবিশ্বে তা’ ছড়িয়ে পড়–ক- আজকের এ মহান দিনে এই প্রত্যাশা আমাদের।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট