চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

পবিত্র হজ ও ঈদুল আজহা মানবিক সমাজ গড়ার শিক্ষা দেয়

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

১০ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৩০ পূর্বাহ্ণ

১২ আগস্ট বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের একটি বড় উৎসব পবিত্র ঈদুল আযহা উদযাপিত হতে যাচ্ছে। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর কলিজার টুকরা, আদরের পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে কুরবানী দিচ্ছেন, এই স্বপ্ন হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর ছেলেকে বলার সাথে সাথে ছোট্ট বালক ইসমাইল আল্লাহর নির্দেশ পালনে সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলেন। পবিত্র মক্কা নগরীর মিনা নামক এলাকার একটি স্থানে হযরত ইব্রাহীম (আ.) যখন ইসমাইলকে আল্লাহর রাহে কুরবানী দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বেহেশ্তি দুম্বা এসে কুরবানী হয়ে গেলেন। সেই থেকে মানুষের ভেতরের পশুত্ব, সব খারাপ অভ্যাস ও নোংরামীকে কুরবানী করাই কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য। শুধু প্রতীকী কুরবানী নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় সঠিক নিয়ম মেনে কুরবানী করে মানুষ নিষ্পাপ ও আদর্শ বান্দা হতে পারে। এভাবে হয়রত ইব্রাহীম (আ.) কে অনেকগুলো পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রত্যেকটি পরীক্ষায় তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। সেজন্যে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কালামে পাকে বলেছেন, ‘স্মরণ কর (যখন ইব্রাহীমকে তার রব কতিপয় বিষয়ে (তার আনুগত্যের) পরীক্ষা নিলেন অতপর সে তা পুরোপুরি পূরণ করল, আল্লাহ তায়ালা বললেন, আমি তোমাকে মানব জাতির জন্যে নেতা বানাতে চাই, সে বলল-আমার ভবিষ্যত বংশধররাও (কি নেতা হিসাবে বিবেচিত হবে?) আল্লাহ তায়ালা বললেন, আমার এই প্রতিশ্রুতি জালেমদের কাছে পৌঁছবে না।’ হয়রত ইব্রাহীমের যুগ থেকে অদ্যাবধি মুসলিম জাতি আল্লাহর সেই নির্দেশ পশু কুরবানীর মাধ্যমে পালন করে আসছেন। ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী কুরবানী দেওয়া ওয়াজিব। আল্লাহ তায়ালা সূরা হজ্বের ২৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘যাতে করে তারা তাদের নিজেদেরই ফায়েদার জন্যে এখানে এসে হাজির হয় এবং নির্দিষ্ট দিনসমূহে কুরবানী করার সময় তার উপর আল্লাহর নাম নেয় যা তিনি তোমাদের দান করেছেন চতুষ্পদ জন্তুগুলো থেকে। অতপর এ গোশ্ত থেকে তোমরা খাবে, অভাবগ্রস্থদেরও তার কিছু অংশ আহার করাবে।’ পবিত্র কুরআনের সূরা হজ্বের ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘কুরবানীকৃত পশুর গোশ্ত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ম ঘোষণা কর।’ অর্থাৎ কুরবানী হওয়া উচিত শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ প্রতিবছর জিলহজ্ব মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ সন্ধ্যার মধ্যে কুরবানী দেন। তবে প্রথম দিন কুরবানী করা উত্তম। কুরবানীর পশু নিজেদের হাতে জবাই করা মুস্তাহাব। নিজে জবাই করতে না পারলে অন্য যে কোনো নেককার ও বিদগ্ধ আলেম দিয়ে কুরবানীর পশু জবাই করা উত্তম। ৬ প্রকার গৃহপালিত পশু কুরবানী দেয়া যায়, যেমন: উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ভেড়া ও ছাগল। নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ছাড়া যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে অর্থাৎ সাড়ে ৭ তোলা সোনা বা সাড়ে ৫২ তলা রুপা বা এর সম-মূল্যের জিনিসপত্র অথবা নগদ টাকা অথবা ব্যবসার মালামাল আছে তার জন্যে কুরবানী করা ওয়াজিব। কুরবানীর গোশ্ত তিন ভাগ করা মুস্তাহাব। নিজ ও নিজ পরিবার পরিজনের জন্যে ১ ভাগ, আত্মীয় স্বজনের জন্যে ১ ভাগ ও ফকির মিসকিনদের জন্যে ১ ভাগ। কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি না করে দান করা যায়। আর বিক্রি করলে তার মূল্যে ছদকা করা ওয়াজিব। কুরবানীর পশু সুন্দর ও নিখুঁত হওয়া দরকার। আমাদের রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন কুরবানীর পশু পশম, শিং সহ উপস্থিত হবে।’ অন্য একটি হাদিসে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলছেন, তোমরা কুরবানীর পশু শক্তিশালী ও মোটাতাজা দেখে নির্বাচন কর। কারণ এগুলো পুলসিরাতের উপর তোমাদের বাহন হবে। অনেক সময় কুরবানীর পশু অবৈধ পন্থায় মোটাতাজাকরণ করা হয় যা ইসলামের দৃষ্টিতে পুরোপুরি বর্জনীয় ও হারাম। কেননা, কুরবানীর পশু মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও সৃষ্টির নৈপুণ্যের নিদর্শন। সূরা হজ্বের ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘কুরবানীর উট, গরু আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহর নিদর্শনস্বরুপ বানিয়েছি।’ হযরত মুসা এর যুগের একটি হত্যা রহস্য ঊন্মোচনে গরু কুরবানী বা জবাইয়ের বর্ণনার কারণে আল্-কুরআনের সর্ববৃহৎ সূরার নামকরণ হয়েছে বাকারা বা গরু। এ সূরার ৬৭ থেকে ৭১ নম্বর আয়াতে গরুর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। যা কুরবানীর পশু নির্বাচনে আদর্শ মানদ- থাকা দরকার, যেমন: মধ্যম বয়সী হওয়া, হলুদ উজ্জ্বল গাঢ় বর্ণের হওয়া, আকর্ষণীয় ও দর্শকনন্দিত হওয়া, পরিশ্রম ক্লান্ত না হওয়া, সুস্থ ও নিখুঁত হওয়া। আমাদের রাসূলের নিদের্শনা হল: কুরবানীর পশুতে ৪টি দোষ থাকা যাবে না, যেমন: অন্ধ, মারাত্মক অসুস্থ, দুর্বল হাড্ডিসার এবং অক্ষম বা খোঁড়া। অনেক মুনাফালোভী ব্যবসায়ী কুরবানী পশু মোটাতাজাকরণের জন্যে নিরীহ বোবা প্রাণীকে মৃত্যু ঝুঁকিতে ঠেলে দেয়, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়। অন্যদিকে গ্রোথ হরমোন, ড্রাইক্লোফেনাক, ষ্টেরয়েড ব্যবহার, রেজিষ্ট্রার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া পশুকে ঔষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য দেয়া। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে এ নিয়ামতকে আমরা যথাযথ প্রয়োগ করতে পারছি না।
কুরবানীর দিন দেখা যায় পশু জবাই করার পর তার মল-মূত্র, নাড়ি-ভূড়ি, যত্রতত্র ছড়ানো ছিটানো থাকে রাস্তাঘাটে। যার ফলে পথচারীদের চরম দূর্ভোগ পোহাতে হয়। দুর্গন্ধে টিকে থাকা যেন দায়। কুরবানীর বর্জ্য অপসারণ করার কোন উদ্যোগও যেন নেয়া হয় না সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে। কুরবানীর পশুর নাড়ি-ভূড়ি থেকে দুর্গন্ধ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহের শরীরে প্রবেশ করে। যার ফলে বমিভাব, পেটের পীড়া, পেট কামড়ানো এমনকি পাতলা পায়খানা হওয়ারও সমূহসম্ভাবনা রয়েছে। একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে নিজের পশু কুরবানীর পর নিজ উদ্যোগে বা সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগে কুরবানীর বর্জ্য, নাড়ি-ভূড়ি, রক্ত ও মূত্র সাথে সাথেই অপসারণ করা উচিত অথবা মাটির নিচে গেড়ে ফেলা উচিৎ।
এতে করে উক্ত বর্জ্য থেকে সৃষ্ট নানাবিধ রোগসমূহ আর মানব দেহে প্রবেশ করতে পারে না। ব্যক্তি উদ্যোগের সাথে সাথে সিটি কর্পোরেশন ও উপজেলা প্রশাসনেরও উচিত কুরবানী বর্জ্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় কুরবানী করার সাথে সাথে তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে আবর্জনা সরিয়ে ফেলা। এতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ ও আন্তরিক সৎ ইচ্ছা। দেশের সামাজিক সংগঠন ও এনজিওসমূহকে কুরবানীর বর্জ্য অপসারণে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকা চাই।

লেখক : সভাপতি, রাউজান ক্লাব জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট