চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ঈদুল আজহার শিক্ষা

জসিম উদ্দীন মাহমুদ

১০ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:২৯ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত পরম আনন্দের একটি দিন। সারা বিশ্বের মুসলমানরা ঈদুল আজহায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও করুণা লাভের জন্য পশু কুরবানী দিয়ে থাকেন। মহান আল্লাহর কাছে হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর পূর্ণ আত্মসমর্পন ও ইসমাঈল (আ.) এর সুমহান ত্যাগের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র ঈদুল আজহা। কুরবানীর মহিমা আমাদের অন্তরলোকের সংকীর্ণতা ধুয়ে দেয়। ইসলামের এই মহান চেতনাকে ধারণ করে ত্যাগ, ধৈর্য ও তিতিক্ষার ভেতর দিয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষায় আমরা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনকে গৌরবান্বিত করে তুলতে পারি। তাই ঈদুল আজহা, কুরবানীর বহুমুখি শিক্ষা চেতনা ও তাৎপর্য অপরিসীম।
এক. মহান আল্লাহর পথে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনই হচ্ছে ঈদুল আজহা ও কোরবানীর মূল কথা। সত্যের পথে অবিচল থেকে পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করারর বিশ্বজনীন বার্তা দেয় এ ঈদুল আযহা ও কোরবানী। শক্তি-সামর্থের দুর্বলতা থাকলেও ঈমানি চেতনা বুকে ধারণ করে মুসলিম উম্মাকে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে এবং কোনো অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করা যাবে না- এ হলো ঈদুল আজহা ও কোরবানীর বৈপ্লবিক বার্তা।
কোরবানীর মহান শিক্ষা ও বার্তা চিরকাল মুসলিমউম্মাহকে উজ্জীবিত করেছে। আজও বিশ্বের প্রকৃত ঈমানদার মানুষ কোরবানীর মহান চেতনায় সত্য সংগ্রামের পথে অকুতোভয়। তারা ভয় করেনা পারমাণবিক অস্ত্রগর্বিত তাগুতি শক্তির কোন ষড়যন্ত্রকেও। কোরবানী বা আত্মত্যাগের এই মহান চেতনা যতদিন মুসলিম উম্মার মাঝে থাকবে, ততদিন পৃথিবীর সকল তাগুতি শক্তি জোটবদ্ধ হয়েও তাদের পরাজিত করতে সক্ষম হবে না। ইতিহাস বহুবার তার প্রমাণ দিয়েছে। কোনো নিন্দুকের নিন্দাকে তাঁরা ভয় করেননি। কোরবানীর এই শক্তি অর্জন করা প্রতিটি মুসলিমের ঈমানি দায়িত্ব।
দুই. মুসলিম শব্দের অর্থ হচ্ছে আত্মসমর্পনকারী। মহান আল্লাহর বিধি-বিধানের নিঃশর্ত আনুগত্যই হচ্ছে ইসলামের মূল কথা। ‘কোনো বিধান যুক্তিগ্রাহ্য হলে মানবো অন্যথায় মানবো না’- এ মনোভাব থাকলে মুসলমান হওয়া যায় না। হযরত ইবরাহিম (আ.) মানবতার জন্য এ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের সর্বোত্তম আদর্শ স্থাপন করেছেন। তিনি মহান আল্লাহর নির্দেশে আপন পুত্রকে জবাই করার উদ্যোগ নিয়ে সমগ্র মানবতাকে আনুগত্যের যথার্থ শিক্ষা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মানুষের পরামর্শ নিলে অনেকেই হয়তো এ পদক্ষেপকে অন্যায় ও গর্হিত বলে যুক্তি দিতো। কিন্তু হযরত ইবরাহিম (আ.) যুক্তির পেছনে পড়েননি। তাঁর দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ ছিলো- ‘আমার সালাত, আমার কোরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহে নিবেদিত এবং মর্মেই আমি নির্দেশিত হয়েছি আর আমি প্রথম আত্মসমর্পণকারী। (সূরা আরাফ, আয়াত ১৬২)
তিন. পশুকোরবানীর মাধ্যমে আমরা হযরত ইবরাহিম (আ.) এর সেই আনুগত্য ও আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করি। অনেকে মনে করেন, কোরবানীর পশু ক্রয়ে অর্থ ব্যয় না করে তার মূল্য অসহায় মানুষের মাঝে নগদ টাকা বিতরণ করে দেয়াই যৌক্তিক। এ ধারণা নিতান্ত অজ্ঞতা ও মূর্খতারই ফল। কারণ ইসলাম তো নিছক কোনো যুক্তিপূজার নাম নয়। ইসলাম হচ্ছে মহান আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণের নাম। যদিও ইসলামের সকল বিধানই যৌক্তিক, বিজ্ঞানময় ও কল্যাণকর, কিন্তু মানুষ তার ক্ষুদ্র বিবেক দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তা উপলব্ধি করতে পারে না। তাই মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম যে ইবাদতের যে প্রক্রিয়া নির্দেশ করেছেন, সে ইবাদত সে প্রক্রিয়াতেই আদায় করতে হবে। যুক্তি দিয়ে মনগড়া ভিন্ন কোনো পন্থায় আদায় করলে তা গৃহীত হবে না। উপরন্তু তাকে অবাধ্যতার শাস্তি ভোগ করতে হবে। পবিত্র কোরআন ও হাদিস শরীফের বিভিন্ন স্থানে একথার স্পষ্ট বর্ণনা আছে।
চার. মুসলমানদের জীবনে ঈদুল আযহার গুরুত্ব ও আনন্দ অপরিসীম। উৎসব হিসেবে পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতি এর সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামের জীবন আর ধর্ম একই সূত্রে গাঁথা। তাই ঈদ শুধু আনন্দের উৎস নয় বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্প্রীতির ভাবটা এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানকার লোকেরা ঈদের নামাযের জন্য নির্দিষ্ট ঈদগাহে সমবেত হয়। এতে সকলের মধ্যে একাত্মতা ও সম্প্রীতি ফুটে ওঠে- ইসলামের মহান ভ্রাতৃত্ববোধে সবাই উদ্দীপ্ত হয়। পরস্পর কোলাকুলির মাধ্যমে সব বিভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই বলে গৃহীত হয়। ধনী-গরীবের ব্যবধান তখন প্রাধান্য পায় না। ঈদের আনন্দ সবাই ভাগ করে নেয়। এর ফলে ধনী-গরীব, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়-স্বজন, সবাই পরস্পর ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে। ঈদ মানুষে মানুষে ভেদভেদ ভোলার জন্য, মানুষের মধ্যে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হওয়ার জন্য পরম মিলনের বাণী নিয়ে আসে। ঈদুল আজহায় যে কুরবানী দেওয়া হয় তার মাধ্যমে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়, কুরবানীর রক্ত-মাংস কখনই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। শুধু দেখা হয় মানুষের হৃদয়কে। পবিত্র কোরআনে বিষয়টি এভাবে এসেছে- ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহর নিকট এ কোরবানীর গোশত ও রক্ত কিছুতেই পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। (সুরা হজ্ব, আয়াত ৩৭)।
প্রকৃতপক্ষে কুরবানীদাতা কেবল পশুর গলায় ছুরি চালায় না বরং সে তো ছুরি চালায় সকল প্রবৃত্তির গলায় আল্লাহর প্রেমে পাগলপারা হয়ে। এটিই কুরবানীর মূল নিয়ামক, প্রাণশক্তি ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ। এ অনুভূতি ব্যতিরেকে যে কুরবানী করা হয় তা হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর সুন্নাত নয়, এটা এক রসম তথা প্রথা মাত্র। এতে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে কিন্তু সেই তাকওয়া হাসিল হয়না যা কুরবানীর প্রাণশক্তি।
পাঁচ. কোরবানীর পূর্বে রিয়া থেকে সর্বতোভাবে তাকওয়া অর্জন করে নেওয়া জরুরী। লৌকিকতা বা খ্যাতি লাভের দিকটি যাতে কল্পনায় না আসতে পারে সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। এ ইবাদত আদায়ের পূর্বে কৃপণতা, মনোসংকীর্ণতা হতে বেঁচে থাকা জরুরী। কোরবানীর অভিপ্রায় পোষণের পর থেকেই একজন মোমিনকে তাকওয়ার অনুশীলন করতে হয়। তারপর নিষ্ঠার সাথে যখন ইবাদতটি সম্পন্ন হয়, তখন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাকওয়ার বিভিন্ন সুফল অর্জিত হয়। তাই স্পষ্ট যে কোরবানীর মাধ্যমে আমরা ইখলাস ও তাকওয়ার অনুশীলনের সুযোগ লাভ করে থাকি।
ছয়. ঈদের মধ্যে আছে সাম্যের বাণী, সহানুভূতিশীল হৃদয়ের পরিচয়। পরোপকার ও ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানুষের মন। কোরবানীর মাধ্যমে পার্থিব ধন ও জীবনের মোহ হ্রাস পায়। কারণ কোরবানীর পশু জবাই করার দ্বারা বাহ্যত কোরবানীদাতার সম্পদ কমে। সম্পদের এ ক্ষতি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই মেনে নেয়া হয়। ফলে যাকাতের মতো কোরবানীর মাধ্যমেও বান্দার সম্পদের মোহ হ্রাস পায় এবং আল্লাহর পথে নিজের জান-মাল উৎসর্গ করার চেতনাকে উজ্জীবিত করে।
সাত. কোরবানী দাতাদেরকে কোরবানীর গোশতের কিছু অংশ আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও সমাজের গরীব-দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে এতে করে সমাজের সবাই মিলে একই দিনে সাময়িকভাবে হলেও বৈষম্যহীন একটা আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ আসে। দুঃখী, দরিদ্র, অসহায় মানুষ- যাদের সারা বছরে কোনদিন নিজ অর্থে গোশতের ব্যবস্থা করার সামর্থ হয় না, কোরবানীর উছিলায় তাদেরও একটু উত্তম খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। ফলে সামর্থবানদের মাঝে এ অনুভূতি জাগ্রত হয় যে সারা বছরই এভাবে দুঃখী-দরিদ্রদের প্রতি ইহসান করা উচিত। এভাবে কোরবানী আমাদেরকে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণেরও শিক্ষা দেয়।
আট. কোরবানী শিরক থেকে মুক্ত থাকার একটি অনন্য কার্যকর উপায়। মুশরিকদের মাঝে পশুপূজার রেওয়াজ দীর্ঘদির ধরে চলে আসছে। ইসলাম মুসলমানদের কোরবানীর বিধান দিয়ে তাওহীদের বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করার পাশাপাশি এ শিক্ষা দেয় যে, জীবজন্তু ও পশুপাখি উপাসনার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি বরং মহান আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় তাঁর পথে উৎসর্গের মাধ্যমে তাঁরই মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
নয়. কুরবানীর ঈদ বা ঈদুল আযহা আমাদের নিকট আত্মশুদ্ধি, আত্মতৃপ্তি ও আত্মত্যাগের এক সুমহান বার্তা নিয়ে প্রতি বছর উপস্থিত হয়। ঈদুল আজহার শিক্ষায় উজ্জীবিত হলে আমরা সকল পাপ, বঞ্চনা, সামাজিক অনাচার ও রিপুর তাড়না বা শয়তানের অসওয়াসা হতে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হব। তাই ঈদুল আজহার পশু কুরবানীর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে বিরাজমান পশুশক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুগুলোকেই কুরবানী দিতে হয়। আর হালাল অর্থে অর্জিত পশু কুরবানীর মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়। আমরা চাই ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সকল অনিশ্চয়তা-শঙ্কা দূর হোক। হিংসা, হানাহানি ও বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে এক সঙ্গে এক কাতারে পবিত্র ঈদুল আজহার আনন্দে শামিল হয়ে সকলের মধ্যে সাম্য ও সহমর্মিতার মনোভাব জাগিয়ে উঠুক। কুরবানী হোক ধ্বনি গরিব সকল মুসলমানের জন্য আল্লাহর মেজবান।
দশ. কোনো প্রাণী যখন নিষ্ঠার সঙ্গে একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানী করা হয়, তখন তার মধ্যে মহান আল্লাহ এমন শক্তি দান করেন যার দ্বারা ভক্ষণকারীর প্রাণশক্তি বর্ধিত হয় এবং সে প্রশান্তি লাভ করে। একারণেই ইসলামি শরীয়ত মতে কোরবানীর গোশত খাওয়া মুস্তাহাব। উত্তম হচ্ছে কোরবানীর দিন কোরবানীর গোশত খাওয়ার আগে অন্য কিছু না খাওয়া এবং সবার আগে কোরবানীর গোশত খাওয়া। মহান আল্লাহ আমাদেরকে যথার্থ কোরবানী করার তাওফীক দান করুন। আমিন।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট