চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

হজ ও কোরবানি : ত্যাগ, ভালোবাসা ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের প্রতিযোগিতা

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

৯ আগস্ট, ২০১৯ | ১:০২ পূর্বাহ্ণ

আজ সর্বত্রই হজ ও কুরবানীর গুঞ্জন, আত্মাশুদ্ধি অর্জনের, ত্যাগ ও ভালবাসার প্রতিযোগিতার অংশ নেয়ার মহান ব্রতে উদ্বেলিত মুসলিম জনপদ। উল্লেখ্য, যে সকল গরীব মুসলমান কুরবানী দানের সামর্থবান নয় তারাও এ মাসে নির্দিষ্ট কিছু আমল সম্পাদনের মাধ্যমে হজ ও কুরবানীর ফজিলত অর্জন করতে পারে, পারে অফুরন্ত আত্মতৃপ্তি ও মর্যাদা অনুভব করতে। এ মাসের ১০, ১১ এবং ১২ তারিখে কোন ব্যক্তি যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য দ্রব্যাদি ব্যতীত সাড়ে সাত ভরি পরিমাণ স্বর্ণ অর্থবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা তৎসম মূল্যের অন্যান্য দ্রব্যাদির মালিক হয় তার উপর কুরবানী দেয়া ওয়াজিব। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন: কুরবানীর সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করেনা সে যেন আমাদের ঈদের ময়দানে না আসে। ’
পশুর আকৃতি : গরু, মহিষ, উট , ভেড়া, ছাগল ও দুম্বা – এসব জন্তু দ্বারা কুরবানী করা যায়। অন্য কোন পশু অনুমোদিত নয়। একটি ভেড়া, ছাগল ও দুম্বা দ্বারা কেবল একজনের কুরবানী চলে। গরু, মহিষ ও উট দ্বারা সাতজনের শরীক কুরবানী আইনসিদ্ধ। – (আলমগীরী)। কুরবানীর জন্য গরু, মহিষ দু’বছরের, উট পাঁচ বছরের এবং ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা এক বছর বয়সী হতে হবে। অবশ্য খুবই মোটা তাজা হলে এক বছরের কম বয়সী ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারাও কুরবানী দেয়া যায়।- (দুররে মানসুর)।
পশুর অযোগ্যতা: ১. অন্ধত্ব, একচোখা, এক-তৃতীয়াংশ দৃষ্টিহীনতা। ২.কান কিংবা লেজ এক – তৃতীয়াংশ কাটা। ৩. কোন একটি পা অচল। ৪. গোড়া দিয়ে শিং ভেঙ্গে যাওয়া। ৫. ক্ষীণকায় এবং হাড়মজ্জাহীন হওয়া। এসব কারণে যে কোন পশু কুরবানীর জন্য অযোগ্য হয়ে যায়। (শামী , আলমগীরী)।
কুরবানীর মাংস: তিনভাগ করে একভাগ নিজেদের জন্য রাখা, একভাগ দরিদ্র ও নিঃস্বদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া আর একভাগ আত্মীয় স্বজনদের মাঝে বন্টন করা উত্তম। – (শামী)। এখন কিন্তু আমরা তা করিনা। আমরা ভালভাল গোশ্তগুলো প্রথমেই উঠোন থেকে ঘরে তুলে ফেলি। তারপরে ফ্রিজে রেখে দেই। আগামী ছয় মাস গোশ্ত না কেনার জন্য। টিক্কা কিংবা কাবাব বানিয়ে খাওয়ার জন্য। আর যে সব গোশ্ত হাড্ডি সংরক্ষণ অযোগ্য সেগুলোকে দরজায় কোন ভিক্ষক আসলে তাদেরকে কিছু কিছু দিয়ে বিদায় করি। অথচ ঈদুল আয্হার মূল কথা ছিল প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করা এবং এ শিক্ষা ধারণ করার প্রয়োজন ছিল জীবনের সবসময়। অন্তত আগামী বছরের ঈদুল আযহা পর্যন্ত। কিন্তু আমরা ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই ঈদের কয়েক ঘন্টাও ত্যাগের দৃষ্টান্ত রাখতে পারিনা, লিপ্সা আর লোক দেখানোর মানসিকতা আমাদের ঈদের মাহাত্ম্যটুকুন ধ্বংসের মাঝে নিপতিত করে। প্রতিবেশী যেসব গরীব বা কুরবানী দেন নি এমন লোকজন – যারা লজ্জায় কারও ঘরের দরজায় যায় না, তাদের খোঁজ করে লিস্ট করে কুরবানীর গোশ্ত পৌঁছে দেয়ার জরুরত মনে করি না। এখানেই তফাত সে যুগের ত্যাগী, আল্লাহ ও রাসূলপ্রেমিক মুসলমানদের আর আজকের ভোগবাদী মুসলমানের। এ উৎসব পশু কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার রিজামন্দি হাসিলের। যেহেতু এটি মূলত পশু কুরবানী দানের অনুষ্ঠান, তাই ইবাদত, নৈকট্য, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মত্যাগের অনুশীলনের সাথে সাথে এ উৎসব আমাদেরকে স্বাস্থ্যকর পশু জবাই ও আহারের সম্মিলিত ট্রেনিং এবং শিক্ষা দিয়ে থাকে।
আমরা জানি, প্রাণীসমূহ খাদ্যোপযোগী করার জন্য অতি জরুরী হল, এগুলোকে জবাই করতে হবে। ইসলামে জীবন্ত প্রাণীর দেহ থেকে গোশতের কোন টুকরা কর্তন করাও নির্দয় নিষ্ঠুর ক্ষতিকর (কাজ)। কেননা কর্তনের পর ক্ষত থেকে নির্গত রক্ত একে কষ্ট দিয়ে নিহত করতে পারে। বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে যে কোন প্রকারে ক্ষতে স্থানের ও ফোঁড়া বা ঘা এর চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। তবু সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে উক্ত প্রাণীর স্বাস্থ্য ঠিক থাকে না। এটি মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচলেও আগামীতে কোন কাজের যোগ্য ও শক্তিশালী হয় না। সুতরাং এর অবশিষ্ট গোস্তও অকেজো হয়ে যায়।
নবী করীম (স.) মদীনায় আসার পর জীবিত প্রাণী থেকে অংশ বিশেষ কর্তন করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার মত ঘৃণ্য ও আমানবিক প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। প্রাণীকে খাদ্যোপযোগী করার জন্য প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকার পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। প্রাচীন কালে মানুষ প্রাণীদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে ঘায়েল করে বধ করত। বড় বড় প্রাণীদের শিকার করা খুব কষ্টকর হতো। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ ছিল যে প্রাণী আহত ক্ষত-বিক্ষত ও প্রাণবায়ু বের হয়ে যাওয়ার পর তার মধ্যে বিভিন্ন স্থানে জমাটবাঁধা রক্ত থেকে যায়। ব্যথা ও আঘাতের কারণে প্রাণী দেহ থেকে হিস্টামিন সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় ভীতির কারণে দেহ থেকে রক্ত পরিপূর্ণ বের হতো না বলে গোস্ত বিস্বাদ ও দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতো। আল্লাহর জমিন আবাদ করার প্রথম যুগে মানুষকে আল্লাহ প্রাণীকে কষ্ট দিয়ে হত্যা করার পরিবর্তে জবাই করার বৈধ পন্থা শিখায়ে দেন। যেমন ইব্রাহীম (আ.) হাত সম্প্রসারিত করে ছুরি গ্রহণ করেন এবং স্বীয় পুত্রকে জবাই করেন। ’
তাওরাত গ্রন্থে ইব্রাহীম (আ.) এর দিকে সম্বন্ধ করে বলা হয়েছে যখন তিনি কুরবানী করার জন্য বের হন তখন রীতিমত ছুরি সঙ্গে নেন। সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাদি.) বলেন ‘রাসূলুল্লাহ (স.) আদেশ করেছেন, ছুরিতে যেন ভালভাবে ধার দেওয়া হয় এবং উহা প্রাণীর সম্মুখে লুকিয়ে লুকিয়ে নিয়ে যাবে। জবাই করার সময় তাড়াতাড়ি জবাই করে ফেলবে।’ -(আহমদ, ইবনে মাজাহ)।
এ বিষয়ে হযরত আওফ বিন শাদ্দাদ (রাদি.) রাসূলুল্লাহ (স.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন – ‘আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জিনিসের সাথে সদয় ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। যদি তোমরা কাউকে হত্যা কর তবে তা দ্রুত সম্পাদন করে ফেল, আর যদি জবাই কর তাহলে খুব তাড়াতাড়ি করে ফেল। ছুরিতে খুব ভালভবে ধার দিয়ে নাও এবং প্রাণীকে আরাম দাও। ’ (মুসলিম)।
ইসলাম প্রাণীসমূহকে খাওয়ার উপযোগী বানানোর জন্য মৌলিক শর্ত দিয়েছে তার শরীরের সমস্ত রক্ত বের হয়ে যাওয়া। এজন্য স্বাভাবিকভাবে ঘাড়ের সামনের দিকটায় রক্ত প্রবাহের চারটি প্রধান রগ ঔঁমঁৎ ঠবরহং, ঈধৎড়ঃরফ অৎঃবৎরবং এর সঙ্গে কন্ঠনালীও কাটতে হবে, এতে প্রাণী সঙ্গে সঙ্গেই বেহুঁশ হয়ে যায়। কলিজা থেকে মাথায় যাওয়ার বড় রগ ও ধমনী দুটি কেটে গেলে তীরবেগে রক্ত বের হতে থাকে, প্রাণীও তড়পাতে থাকে। প্রাণীটি জোরে জোরে হাত পা নাড়ার ফলে শরীরের শেষ প্রান্তে আটকে থাকা রক্তও বের হয়ে আসে। এভাবেই ইসলাম নির্দেশিত পন্থাই পশু জবাইয়ের আসল বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা। যা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত মুহাম্মদ (স.) এর পবিত্র বাণী ও আমল থেকে ঈদুল আযহা উপলক্ষে আমরা প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকি।
লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক……। হাজির হে মহা মহিম প্রভু হাজির তোমার দরবারে। লক্ষ লক্ষ হাজী সাহেবানের এ আকুল করা তালবিয়া ধ্বনিতে হেযাযভূমি আজ মুখরিত।
হজ একান্তভাবেই ব্যক্তিগত আমল। ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তাঁর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যই একজন আল্লাহতে মজনু হাজী সাহেব হজ করে থাকেন। তা সত্ত্বেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হজের বিরাট গুরুত্ব রয়েছে। বস্তুত: হজের মৌসুম এমন এক বসন্ত মৌসুম, যার আগমনে নতুন প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মুসলিম উম্মাহ্। হজের মৌসুমে আলিম- উলামা এবং সুফী ও সংস্কারকগণ পবিত্র মক্কা ও মদীনায় একত্রিত হয়ে থাকেন। তাই এ সময় উম্মাহর সঠিক অবস্থা পর্যালোচনা করা, তাদেরকে শিরক ও বিদ’আতের অভিশাপ হতে মুক্ত করা এবং মুসলিম বিশ্বে তালিম ও তাবলীগী মিশন প্রেরণের বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া যায়। হজ যেহেতু মুসলিম উম্মাহর এমন এক বিশ্ব সম্মিলন, যেখানে সব শ্রেণীর মানুষই এসে সমবেত হয়। তাই এ সময় বিশ্বশান্তি স্থাপনের এবং জাতি সমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব- কলহ মিটিয়ে, লড়াই ঝগড়ার পরিবর্তে ভালবাসা , বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করার এক বিশ্ব মৌসুম।

লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট