চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

হেপাটাইটিস ভাইরাসের ঝুঁঁকিতে চট্টগ্রাম

বিস্তার ঠেকাতে চাই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ

২৯ জুলাই, ২০১৯ | ১:০২ পূর্বাহ্ণ

যেসব রোগ মানবস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে দেয় সেসবের অন্যতম প্রধান হচ্ছে হেপাটাইটিস। এটি লিভার বা যকৃতের প্রদাহজনিত রোগ। প্রাণঘাতী এই রোগটি আদিকাল থেকেই মানবসভ্যতাকে বিপর্যস্ত করে এসেছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া হেপাটাইটিস হয় মূলত যকৃতের ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে। তবে রোগটি ভয়াবহ হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে যথেষ্ট অসচেতনতা রয়েছে। অশিক্ষিত মানুষ তো বটেই, শিক্ষিত মানুষদেরও একটি বিশাল অংশ হেপাটাইটিসের ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তারা মনে করে এটি একটি সাধারণ ব্যাধি, ঝাড়-ফুঁক বা কবিরাজী চিকিৎসায় উপশম হয়ে যাবে। ফলে তারা আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার ধারে কাছেও যান না। পরিণতিতে অনেকটা জ্যামিতিক হারেই রোগটির বিস্তার ঘটছে দেশে। গতকাল দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে প্রাণঘাতী হেপাটাইটিস ভাইরাসের ঝুঁঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম। এটি নিশ্চয়ই চরম উদ্বেগকর খবর।
‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ২০১৯’ উপলক্ষে শনিবার আয়োজিত এক সেমিনারে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮ থেকে ১০ শতাংশ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত। পাশর্^বর্তী মিয়ানমার এবং রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে এই ভাইরাস আরও বেশি ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের চিকিৎসকরা। এছাড়া দেশের মোট জনসংখ্যার পাঁচ দশমিক এক শতাংশ জনগোষ্ঠী হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত রয়েছে বলে জানিয়েছে হেপাটোলজি সোসাইটি বাংলাদেশ। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, পাঁচ ধরনের হেপাটাইটিস ভাইরাস-হেপাটাইটিস ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’ ও ‘ই’ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সারাবিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৩ দশমিক ৪ লাখ মানুষ মারা যায়। হেপাটোলজি সোসাইটি’র তথ্য বলছে, বাংলাদেশের প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রায় ৫০ শতাংশ, যা আগে ছিল ২৭ শতাংশ। চট্টগ্রামে দিনদিন এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এটি খুবই উদ্বগকর চিত্র সন্দেহ নেই।
হেপাটাইটিস-এ এবং ই সংক্রমিত হয় দূষিত খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে। আর হেপাটাইটিস-বি, সি এবং ডি সংক্রমিত হয় রক্তের মাধ্যমে। যকৃতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রক্তের লোহিত রক্তকণিকার আয়ুষ্কাল শেষ হলে তার অন্তর্গত হলুদ রঙের বিলিরুবিন-কে দেহ থেকে নিষ্কাশিত করা। হেপাটাইটিসের ফলে যকৃতের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হওয়ার জন্য রক্তে বিলিরুবিন-এর পরিমাণ বেড়ে দেহ হলদেটে হয়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের ভাইরাল হেপাটাইটিসের মধ্যে সবথেকে বিপজ্জনক হেপাটাইটিস-বি এবং সি। কারণ, এই দু’ধরনের ভাইরাস থেকে আক্রান্ত হলে অবস্থা বেশ বিপজ্জনক হয়। আবার এই দু’টি ভাইরাস থেকে নিরাময়-অযোগ্য ক্রনিক হেপাটাইটিসও হতে পারে। ক্রনিক হেপাটাইটিস থেকে হতে পারে লিভার সিরোসিস, লিভারের ক্যানসার। হেপাটাইটিস-ডি অবস্থান করে হেপাটাইটিস বি-এর সঙ্গেই। হেপাটাইটিস-বি, সি এবং ডি সংক্রমিত হয় অশুদ্ধ ইঞ্জেকশন সুচ ব্যবহার, সংক্রামিত রক্ত গ্রহণ, সেলুনে ও উল্কি আঁকার সময়ে শুদ্ধতার অভাব ইত্যাদির মাধ্যমে। সংক্রমিত মায়ের থেকে শিশুর দেহেও এই ভাইরাসগুলি সংক্রমিত হয়। তাই এ ব্যাপারে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। আগেভাগে টিকা নিলে এবং সাবধানতা অবলম্বন করলে হেপাটাইটিস ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে না।
উল্লেখ্য, শরীরে হেপাটাইটিস ভাইরাস থাকলেও সহজে এর কোন উপসর্গ থাকে না। এক গবেষণা জরিপ বলছে, দেশের প্রায় ৮১ লাখ মানুষই নিজের অজান্তে মারাত্মক ব্যাধি হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস বহন করছে। অথচ তারা সুস্থ মানুষের মতোই জীবনযাপন করছে। তাই সবারই উচিত নিজে সচেতন হয়ে রক্ত পরীক্ষা করে নিজের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিজেকেই নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে পরিবারের কেউ হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাকে দ্রুত চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাওয়া ও নিজেরা সতর্ক হয়ে যাওয়া। এ রোগে আক্রান্ত রোগীরা সময়মতো চিকিৎসাসেবা না পেলে মৃত্যুর আশংকা রয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত শারীরিক সম্পর্ক, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ, টুথপিক, টুথব্রাশ ব্যবহারের মাধ্যমে হেপাটাইটিস ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই এ ব্যাপারেও সকলকে সচেতন হতে হবে।
আমরা মনে করি, স্বাস্থ্যবান জাতি গড়ার অন্তরায় হেপাটাইটিস ভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে সরকারকে সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণ এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই নিতে হবে। হেপাটাইটিস কি? কেন হয়, কীভাবে রোগটি ছড়ায়, এবং এর ভয়াবহতা এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে ধারণা দেয়া গেলে, একইসঙ্গে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করে অনিরাপদ যৌনকর্ম ও অনিরাপদ রক্ত গ্রহণে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা গেলে, ঘাতক ব্যাধি হেপাটাইটিসের বিস্তার রোধ কোন কঠিন ব্যাপার হবে না। তবে এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি এনজিওসহ বিভিন্ন বেসরকারি সেবা সংস্থারও এগিয়ে আসা উচিত।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট