চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভারতে আজমগড়ী হযরতের যেয়ারত

কালান্তরে দৃষ্টিপাত

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

২৯ জুলাই, ২০১৯ | ১:০৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আজমগড়ী হযরতের জন্মস্থান উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলার কুহন্ডায়। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে এ কুহন্ডায় গমন করার সৌভাগ্য হয়। এবার সফরসঙ্গী ছিলেন এডভোকেট মুহাম্মদ ইলিয়াস, এমদাদ উল্লাহ, আলহাজ্ব মুহাম্মদ শরীফ, আলহাজ্ব মুহাম্মদ ইকবাল ও আবু মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম। আমরা কলকাতা থেকে হাজার দোয়ারী এক্সপ্রেসে করে ভোরে মুর্শিদাবাদ রওনা হই। মুর্শিদাবাদ থেকে পর দিন দুপুরে জিপে প্রায় ৮৬ কি.মি পথ অতিক্রম করে মালদা পৌঁছি। মালদায় ২ দিন থেকে আমরা বিহার রাজ্যের বাগলপুরে পৌঁছি। বাগলপুর থেকে ১ ডিসেম্বর বুধবার দিবাগত রাত অঈ ঞড়ি ঞরবৎ ঝষববঢ়বৎ এ আমরা শাহগঞ্জের উদ্দেশ্য রওনা হই। পর দিন দুপুরে শাহগঞ্জ পৌঁছার ট্রেনের সিডিউল। শাহগঞ্জ থেকে ১০ কি.মি দূরে কুহন্ডা আজমগড়ী হযরতের বাড়ি। কিন্তু ট্রেন বিলম্বে চলায় পর দিন সকালে আমরা সিদ্ধান্ত পাল্টায়ে দুপুর ১ টায় শাহগঞ্জের প্রায় ৪০ কি.মি আগে জৈনপুর ট্রেন স্টেশনে নেমে যাই। জৈনপুর ভারতের প্রাচীন শহর। এখানে সুলতানী আমলের অনেক স্থাপনা রয়েছে। হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.) জৈনপুর সম্পর্কে বলেছিলেন, জৈনপুর থেকে যখন কোন উত্তম বাতাম বের হয় তা পৃথিবী এবং পৃথিবীর সকল কিছু সুগন্ধময় হয়ে যায়। মহান পীর হযরত কেরামত আলী জৈনপুরীর আবাসস্থল এ জৈনপুরে । তাঁরই তরিক্বতের অগ্রজ হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ মোহাদ্দেস দেহলভী। হযরত জৈনপুরী রংপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ চত্ত্বরে শায়িত রয়েছেন। এ মহান অলির তিন বংশধর। যথা: (১) হযরত মাওলানা হাসনাইন আহমদ ছিদ্দিকী প্রকাশ বড় হযরত, (২) হযরত মাওলানা সৈয়দাইন আহমদ ছিদ্দিকী মেজ হযরত, (৩) হযরত মাওলানা আহমদ ওসামা ছিদ্দিকী ছোট হযরত । এ মহান হযরতগণ ট্রেন স্টেশনে আমাদের জন্য গাড়ি পাটায়। জৈনপুর শহরে যেয়ারত ও ঘুরে দেখা, তাদের ঘরে রাত্রিযাপন ও রাজকীয় আতিথেয়তা অতি মূল্যবান তাদের প্রদেয় হাদিয়া স্মরণযোগ্য। পরদিন ৩ ডিসেম্বর ২০১০ খ্রিস্টাব্দের শুক্রবার ভোরে জৈনপুরী হুজুরগণের টাটা সুমো ভারতীয় জিপ নিয়ে আমরা প্রায় ৪০ কি.মি দূরত্বে শাহগঞ্জ চলে যাই। তথা হতে ১০ কি.মি দূরত্বে খোঁজ নিয়ে নিয়ে কুহন্ডা আজমগড়ী হযরতের বাড়িতে পৌঁছি।
আজমগড়ী হযরতের এক মাত্র পুত্র মুহাম্মদ বাকর (যিনি মুহাম্মদ বাকর আলী নামেও পরিচিত)। তাঁর প্রথম পুত্র জনাব আবদুল মুনায়েম ও পঞ্চম পুত্র জনাব আবদুস সুবহান পৈতিৃক বাড়িতে ছিলেন। তাঁদের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করি। অতঃপর তাঁরাসহ ৩/৪ ‘শ’ মিটার দূরত্বে পারিবারিক কবরস্থানে যেয়ারত করতে আসি। এখানে শায়িত রয়েছেন আজমগড়ী হযরতের মহান পিতা তরিক্বতের পীর শেখ করিম বক্স (রহ.) ও তাঁর পীর হযরত শেখ নেযাবত আলী (রহ.)। এখান থেকে আমরা যখন জৈনপুর ফিরে আসি তখন জুমার আযান হচ্ছিল। জৈনপুর থেকে বানারশ পাঠ্না হয়ে আমরা কলকাতা পৌঁছি।
এখানে উল্লেখ্য ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে অতি বার্ধক্য অবস্থায় সপ্তাহখানেকের জন্য চট্টগ্রাম সফরের পর ঢাকা হয়ে আজমগড়ী হযরত কুহন্ডা ফিরে গেলে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদিকে তাঁর একমাত্র পুত্র মুহাম্মদ বাকর পশ্চিমবঙ্গের আষানশুলে সপরিবারে থাকতেন। ফলশ্রুতিতে আজমগড়ী হযরতের খেদমতের অত্যধিক প্রয়োজন বিধায় গুন্ডা থেকে তাঁর মেয়ে ও মেয়ের জামাই ২ জনই কুহন্ডা এসে আজমগড়ী হযরতকে গুন্ডা নিয়ে যান। প্রায় বছর খানেক পর এখানেই আজমগড়ী হযরত (রহ.) ইন্তেকাল করেন ( ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেউন)। কুহন্ডা থেকে গুন্ডার দূরত্ব প্রায় ১৫০ কি.মি। ট্রেনে শাহগঞ্জ থেকে প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লাগে।
৪র্থ বার যেয়ারতে গমন: ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ এপ্রিল মঙ্গলবার ৪র্থ বার আজমগড়ী হযরতের যেয়ারতে গমন করার সৌভাগ্য হয়। এডভোকেট মুহাম্মদ ইলিয়াস, এমদাদ উল্লাহ, মাহবুবুল আলমকে সাথে নিয়ে ১৭ মার্চ শনিবার ঢাকা থেকে ভূটান যাত্রা করি। ২১ মার্চ বুধবার সকালে ভূটান থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডু পৌঁছি। কাঠমুন্ডু থেকে ২৬ মার্চ সোমবার দিল্লি আসি। ২৮ মার্চ বুধবার ভোরে শতাব্দী ট্রেনে যেয়ারতের উদ্দেশ্য সেরহিন্দ গমন করি। ঐ রাতে ঐ শতাব্দী ট্রেনে চন্ডীগড় হয়ে দিল্লী ফিরে আসি। ২৯ মার্চ বৃহস্পতিবার ভোরে শতাব্দী ট্রেনে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে আজমীর গমন। ৩০ মার্চ শুক্রবার বিকালে শতাব্দী ট্রেনে দিল্লী ফিরে আসা। ১৩ এপ্রিল রবিবার ভোরে শতাব্দী ট্রেনে কাঠগুদাম হয়ে নৈনীতাল। ২ এপ্রিল সোমবার বিকালে কাঠগুদাম এসে রাতের কাঠগুদাম এক্সপ্রেসে রওনা দিয়ে পর দিন ৩ এপ্রিল মঙ্গলবার যথা সময়ে সকাল ৯ টায় আমরা ৩ জন গুন্ডা ট্রেন স্টেশনে পৌঁছি। যেহেতু মাহবুব সাহেব দিল্লি থেকে কলকাতা চলে আসে।
এই বারও গুন্ডা ট্রেন স্টেশনে অপ ড়ৎ ঘড়হ অঈ কোন জবঃরৎরহম ৎড়ড়স পেলাম না। ফলে বাধ্য হয়ে আমরা তিন জনকে উড়ৎসরঃড়ৎু ৎড়ড়স এতে সিট নিতে হল। আমরা ঘণ্টা খানেকের ব্যবধানে একটি টম টম নিয়ে ৩/৪ কি.মি দূরত্বে আজমগড়ী হযরতের মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে যাই। যাওয়ার সময় ৩ ভাইয়ের পরিবারের জন্য বিভিন্ন নাস্তা কিনে নিই। যেহেতু তাঁরা হাদিয়া হিসেবে টাকা নেয় না। পৌঁছে জানতে পারলাম তাঁদের বড় ভাই ফজলুল বারী ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অক্টোবর ৮১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেউন)। তিনি উত্তর প্রদেশের দু’বার এম.এল.এ ছিলেন। এবারের সফরে এডভোকেট ইলিয়াস ও মুহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ উৎফুল্ল থাকায় গুন্ডায় বেশি সময় থাকার সিদ্ধান্ত নিই। সেই মতে আজ দিবাগত রাতও ট্রেন স্টেশনে থাকব। আমরা বেলা ১১ টার দিকে আজমগড়ী হযরতের মেয়ের শ্বশুর বাড়ি পৌঁছি। তখন মেঝ নাতি জাফরুল বারী বৈঠকখানায় ছিলেন। তিনি বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত। বয়স ৭৮ বছর। তারপরেও ১১ বছরের ব্যবধানে আমাকে চিনতে পেরেছেন। আমরা ৩ জনের জন্য চায়ের পাশাপাশি কয়েক প্রকারের নাস্তা দিয়ে আপ্পায়ন করেন। এরই মধ্যে ডা.আবদুল বারী আমরা পৌঁছার সংবাদ পেয়ে তাঁর স্কুল থেকে গাড়ি নিয়ে আসেন। ১১ বছরের ব্যবধানে অনেক পরিবর্তন দেখতেছি। ডা.বারীর বয়স এখন ৭৪ বছর। তিনি ২ বছর আগে স্ট্রোক করেছেন। নিজে নিজে হাঁটতে পারেন না। কানে শুনে কোন মতে মেশিন দিয়ে। তাঁদের সাথে আলাপের মধ্যে আমাদের প্রোগ্রামের কথা জানিয়ে দিলাম। আমরা যেয়ারত করে ট্রেন স্টেশনে চলে যাব। তথায় বিশ্রাম নিব। ট্রেন স্টেশন থেকে বিকালের দিকে আবার যেয়ারতে আসব। তখন ডা. বারী বলেন, যেয়ারত করে তাঁর বাড়ির পাশে মসজিদে দুপুরের নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। আমরা ভাবলাম আজকে রাত্রেও যখন আছি একবেলা খেলে ভাল হয়। তখন ডা. জাফরুল বারীর পুত্র সাদেক জাফরকে সাথে নিয়ে আমরা আজমগড়ী হযরতের যেয়ারত করতে গেলাম।
দেখতে পেলাম আজমগড়ী হযরতের সাদামাটা কবর শরীফের চারদিকে প্রায় ৩/৪ ফুট উচ্চতায় দেওয়ালটি কেবলার দিকে আরও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এতে বসে মোরাকাবা করার জন্য ফ্লুর পাকা করা হয়েছে। বাউন্ডারী দেওয়ালের বাহিরে একটি নলকূপ বসানো দেখলাম।
মহান আল্লাহ পাক দাতার দান ও শ্রম কবুল করুক। (আমিন)। এখানে যেয়ারতকারীগণের অতি প্রয়োজনীয় সুবিধার জন্য আরও কাজ করা দরকার। ৪র্থ বার আজমগড়ী হযরতের যেয়ারতের বিবরণ দৈনিক পূর্বকোণে উল্লেখ করা হয়েছে বিধায় পুনরায় উল্লেখ করলাম না। পরদিন সকালে ৭ টার গুন্ডা থেকে বানারশগামী ট্রেনে ৪ ঘণ্টায় যাত্রায় দুপুর ১১ টার দিকে শাহগঞ্জ ট্রেন স্টেশনে নেমে পড়ি। শাহগঞ্জ থেকে ১০ কি.মি দূরত্বে আজমগড়ী হযরতের জন্মভূমি কুহন্ডা। ট্রেন স্টেশন থেকে চুক্তিতে একটি টেক্সী রিজার্ভ করি কুহন্ডায় ২ ঘন্টা যেয়ারতের উদ্দেশ্য অবস্থান করে এখান থেকে প্রায় ৭০ কি.মি দূরত্বে বানারশ বিমান বন্দরে যাতে পেঁেৈছ দেয়া হয়। কুহন্ডায় পারিবারিক কবর স্থানে শায়িত আজমগড়ী হযরতের মহান হযরত পিতা শেখ করিম বক্স (রহ.) এবং তাঁর পীর হযরত শেখ নেজাবত আলী (রহ.) সহ মুরব্বিগণ শায়িত। সে মতে কুহন্ডা ২ ঘণ্টা সময় কাটিয়ে বিকালের দিকে বানারশ বিমান বন্দরে পৌঁছি। আকাশ পথে কলকাতা রওনা হই। আমার যত বার গুন্ডা যাওয়া হয় ততবারই আজমগড়ী হযরতের নাতিগণের আতিথেয়তা ও অভিভাবকত্বে থাকি। তাদের ঘর আজমগড়ী হযরতের কবর শরীফ প্রায় ১ কি.মি কাছাকাছি দূরত্বে।
সম্প্রতি গারাংগিয়া সিলসিলার ৫/৬ জন যেয়ারতের উদ্দেশ্য গুন্ডা গমন করে। তারা জানতে পারেন, আজমগড়ী হযরতের কবরের কিছুটা পশ্চিম দিকে চকবাজার এলাকা। তথায় রয়েছে মুসলিম মুসাফিরখানা। যেখানে টাকার বিনিময়ে কম খরচে থাকা যায়। গারাংগিয়ার যেয়ারতকারীও এখানে থাকেন। (সমাপ্ত)

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট