চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

ছেলেধরা গুজব, গণপিটুনি ও মানব হত্যার ভয়াবহ পরিণতি

জসিম উদ্দীন মাহমুদ

২৯ জুলাই, ২০১৯ | ১:০৩ পূর্বাহ্ণ

ইদানিং বাংলাদেশে কোমলমতি শিশুদের ওপর নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, বীভৎসতা ও নির্মমতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। পৈশাচিকতার এক ধরনের কলঙ্ক রচিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে। কোন শিশুই যেন এখন আর আমাদের কাছে নিরাপদ নয়। দিনে দিনে ওদের নির্মল পরিবেশ সংকুচিত হয়ে আসছে। এটি ঘরে-বাইরে, বিদ্যালয়ে, সর্বত্র, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আজ শিশুরা নিরাপদ নয়। শারীরিক, মানসিক নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ওরা। সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, পদ্মা-সেতুতে কল্লা লাগছে এই গুজব ছড়িয়ে দিয়ে শিশু ও তাদের অভিভাবকদেরকে আরো ভয়ঙ্কর উদ্বেগের ভেতর ঠেলে দিয়েছে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল।
কয়েক দিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটছে, তাতে আমরা গভীর উদ্বিগ্ন। এসব কিসের আলামত? যে কোনো অজুহাতে গণপিটুনি শুধু আইনের শাসনের জন্য মারাত্মক হুমকি নয়, সভ্যতারও পরিপন্থী। গণপিটুনি নামক বর্বরতায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই নিরীহ দুর্বল মানুষ। এঁদের মধ্যে নারী ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষও রয়েছে। গণপিটুনির শিকার হয়ে অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ করতে কিংবা নিজের পরিচয় জানাতেও পারছে না।
গণপিটুনি ও এর মাধ্যমে হত্যাকা- বাংলাদেশে নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে জনগণ ছিনতাইকারী, চোর বা ডাকাত ধরে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার অনেক ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে যে মনস্তত্ত্ব কাজ করে তা হলো থানা-পুলিশে দিয়ে কাজ হবে না, আইন নিজের হাতে তুলে নিতে হবে। কিন্তু কোনো সভ্য জগতে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ নেই।
আমরা জানি সততা ও সভ্যতা ইসলামের মূল চালিকা শক্তি। মুমিন ও মুসলিম হলো সত্যের অনুসারী। জীবনের সব ক্ষেত্রে, সর্বাবস্থায় সত্যের অনুসরণ করাই হলো ঈমান ও ইসলাম। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘বলো : সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত; নিশ্চয় মিথ্যা দূরীভূত হবারই’ (সূরা বনী ইসরাঈল ১৭, আয়াত- ৮১)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে সংমিশ্রণ করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না’ (সূরা বাকারা ২, আয়াত- ৪২)।
আমরা এও জানি, সঠিক তথ্য বা সংবাদ জ্ঞানের উৎস। তাই কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে তথ্য যাচাই করা প্রয়োজন। কারণ, ভুল তথ্যের ওপর নেওয়া সিদ্ধান্তও ভুল হবে এবং এর পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ হবে। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের সতর্ক করে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! যদি তোমাদের কাছে কোনো ফাসিক ব্যক্তি কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তখন তোমরা তা যাচাই-বাছাই করো, (তথ্যানুসন্ধান ও সঠিক সূত্র সন্ধান করো), না হলে তোমরা (এ অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে) অজ্ঞতাবশত কারও প্রতি আক্রমণ করে বসবে ( যা যথাযথ নয়), ফলে তোমরা পরে তোমাদেরই স্বীয় কর্মের জন্য লজ্জিত হতে হবে’ (সূরা হুজরাত ৪৯, আয়াত- ৬)।
সত্য-সুন্দর হলো ইসলাম, মিথ্যা হলো কুফর এবং জাহেলিয়াত বা মূর্খতা হলো অন্ধকার। মিথ্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে হাদিস শরীফে আছে, ‘মিথ্যা সব পাপের জননী’ (বুখারী)। রাসুল সা. বলেন, ‘কোনো মানুষ মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শুনে (সত্যাসত্য যাচাই না করে) তাই বলতে বা প্রচার করতে থাকে’ (বুখারী)। কোনো মিথ্যাবাদী কখনো প্রকৃত মুমিন হতে পারে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শপথ সেই মহান সত্তার! যার হাতে আমার প্রাণ! দুনিয়া ততক্ষণ পর্যন্ত ধ্বংস হবে না (তার পূর্বে) মানুষের প্রতি এমন একসময় আসবে; হত্যাকারী জানবে না, কেন হত্যা করছে আর নিহত ব্যক্তি জানবে না তাকে কেন হত্যা করা হয়েছে। বলা হলো: সেটা কীভাবে হবে? বললেন: হারাজ (গুজব, মূর্খতা, হুজুগ, বিবেকহীনতা, অলীকতা, নির্বু্িদ্ধতা, বিচারহীনতা, সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ, অন্যায় হত্যা ইত্যাদি) এর কারণে’ (মুসলিম : ৩৯০৮)।
কিয়ামতের আলামত বলতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের আগে ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, ভূমিকম্প বেশি হবে, সময় সংকীর্ণ হয়ে যাবে, ফিতনা প্রকাশ হবে, হত্যাকা- খুনখারাবি বেড়ে যাবে’ (বুখারী : ১০৩৬)। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ! তখন কি মানুষের বুদ্ধি-বিবেক থাকবে না? নবীজি বললেন, ‘না! সে সময় মানুষ বিবেকশূন্য হয়ে যাবে এবং মনে করবে সে-ই সঠিক, আসলে তা নয়’ (মুসনাদে আহমাদ: ৩২:৪০৯)। রাসুল (সা.) বলেন, কিয়ামতের আলামত হলো ‘হারাজ’! বলা হলো, ‘হারাজ’ কী? তিনি বললেন, ‘মিথ্যা ও হত্যা। এই হত্যা হবে অজ্ঞতাপ্রসূত, স্বার্থপরতায় এবং খামখেয়ালিপনায় (ফাতহুলবারি- ১৩: ৩৪)।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ন্যায়বিচার ব্যতীত কোনো মানুষ হত্যা করবে না, যা আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন’ (সূরা আন’আম ৬, আয়াত : ১৫১)। তিনি আরও বলেন, ‘কোনো মুমিন কোনো মুমিনকে হত্যা করতে পারে না’ (সূরা নিসা ৪, আয়াত : ৯২)। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত কোনো মুমিনকে হত্যা করল, তার পরিণতি জাহান্নাম, তাতে সে চিরকাল থাকবে। তার ওপর আল্লাহর গজব ও লানত আর আল্লাহ তার জন্য মহা শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন’ (সূরা নিসা ৪, আয়াত : ৯৩)। ‘নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করা হেতু ব্যতীত কেহ কাউকে হত্যা করলে, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল, আর যে কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে প্রাণে রক্ষা করল’ (সূরা মায়িদা ৫, আয়াত : ৩২)।
গুজব কিংবা কোনো ফাসিকের মিথ্যাচারে নয়, দুনিয়ায় শান্তি ও নিরাপত্তা এবং পরকালে জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য আমাদের জ্ঞানের অনুসরণ করতে হবে। অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাই করে সত্যকে গ্রহণ করতে হবে। বিনা প্রমাণে কাউকে অভিযুক্ত করা কবিরা গুনাহ। আইন-আদালতের বাইরে কাউকে কোনো প্রকার শাস্তি প্রদান করা অপরাধ। অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনে সকলের সচেতনতা ও এগিয়ে আসা জরুরি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, ইসলামি গবেষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট