চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস : আপনি কি হেপাটাইটিস আক্রান্ত?

ডা. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ

২৮ জুলাই, ২০১৯ | ১:১৭ পূর্বাহ্ণ

আজ ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস’। ভাইরাল হেপাটাইটিস বর্তমান বিশ্বের একটি অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। প্রতি বছর ২৮ জুলাই হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আবিষ্কারক নোবেল বিজয়ী আমেরিকান চিকিৎসক প্রফেসর ব্লম বার্গ এর জন্ম তারিখকে সম্মান জানিয়ে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালিত হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো- ‘আসুন, খুঁজি অজানা লক্ষ রোগীদের’।
হেপাটাইটিস কি?
লিভারের যেকোনো ধরণের প্রদাহকে হেপাটাইটিস বলে। আর এই প্রদাহ যদি নির্দিষ্ট ভাইরাসজনিত কারণে হয় তবে তাকে বলা হয় ভাইরাল হেপাটাইটিস। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি ও ই-এই পাঁচটি ভাইরাসই মূলত: ভাইরাল হেপাটাইটিসের জন্য দায়ী। ৬ মাস বা এর কম স্থায়ী হলে ‘একিউট বা স্বল্পমেয়াদী’ এবং ৬ মাসের বেশী স্থায়ী হলে এটিকে ‘ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদী’ হেপাটাইটিস বলে।
আপনি জানেন কি?
বিশ্বের প্রায় সাড়ে ৩২ কোটি লোক হেপাটাইটিস রোগে আক্রান্ত। অথচ তাদের মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ অর্থাৎ আক্রান্ত প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই নিজের শরীরে এই রোগের উপস্থিতি সম্পর্কে জানেন না। সারাবিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১৩ লক্ষ লোক ভাইরাল হেপাটাইটিসে মারা যায়। যেটি এইডস কিংবা ম্যালেরিয়া রোগে মৃত্যুর চেয়েও বেশী। লিভার ক্যান্সারে মারা যাওয়া প্রতি ৩ জনের ২ জনই হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ তে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৫ ভাগ মানুষ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের বাহক। তাদের কারো কারো বিভিন্ন সময়ে লিভারের জটিল রোগ হচ্ছে। এ দেশের প্রায় ৩.৫% গর্ভবতী মায়েরা হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত। এই ভাইরাস তাদের নবজাতকের শরীরে সংক্রামিত হতে পারে। বাংলাদেশের শতকরা ১ ভাগ লোক হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের বাহক। যাদের অধিকাংশই জানেন না তারা এই রোগে ভুগছেন। প্রশ্ন হল আপনিও কি হেপাটাইটিসে আক্রান্ত?
কিভাবে বুঝবেন?
হেপাটাইটিস এ ও ই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা সাধারণত: ‘একিউট বা স্বল্পমেয়াদী’ হেপাটাইটিসে ভুগেন, যার লক্ষণগুলো হলো: চোখ, প্রস্রাব এবং ত্বক হলুদ হওয়া, জ্বর, বিতৃষ্ণাবোধ, বমি/বমিভাব, খাবারে অরুচি, পেটব্যথা ইত্যাদি। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, হেপাটাইটিস-বি ও সি ভাইরাসজনিত ‘ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদী’ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগেরই কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে না। কারো কারো ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো হলো: অবসাদ, ক্ষুধামন্দা, জ্বরজ্বর ভাব, শরীর শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
হেপাটাইটিসের জটিলতা : হেপাটাইটিস এ ও ই রোগের বেশিরভাগেরই কোনো জটিলতা হয় না। তবে খুবই অল্পসংখ্যক রোগীদের বিশেষত গর্ভবতী মহিলাদের ‘ফালমিনেন্ট হেপাটিক ফেইলিওর’ কিংবা প্রাণঘাতি লিভারের সমস্যা হতে পারে। দীর্ঘদিন রোগভোগের কোনো এক পর্যায়ে হেপাটাইটিস-বি ও সি রোগীদের সিরোসিস, পেটে বা পায়ে পানি আসা, রক্তবমি এমনকি ক্যান্সারের মত জটিলতা দেখা দিতে পারে।
হেপাটাইটিসের চিকিৎসা : আশার কথা হলো অধিকাংশ হেপাটাইটিস এ ও ই রোগে আক্রান্ত রোগীরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম, নিয়মিত স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ এবং অল্প কিছু ওষুধের মাধ্যমে সেরে উঠেন। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত নিরব/নিষ্ক্রিয় বাহকদের দীর্ঘদিন কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজনীয় বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণীত ‘ক্রনিক একটিভ বা সক্রিয়’ রোগীদের সুনির্দিষ্ট ওষুধের প্রয়োজন হয়। সুখের বিষয় হলো আন্তর্জাতিক মানসম্মত সবগুলো ওষুধই এখন সাশ্রয়ী মূল্যে বাংলাদেশেই পাওয়া যায়।
কিভাবে ভাল থাকবেন?
১. একবার ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ও সুঁচ পুনরায় ব্যবহার করবেন না। ২. শিরাপথে মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। ৩. শরীরে রক্ত গ্রহণের পূর্বে রক্তদাতার রক্ত সঠিক ও নিশ্চিতভাবে পরীক্ষা করিয়ে নিন। ৪. নিরাপদ যৌন জীবন-যাপন করুন। ৫. দাঁতের চিকিৎসার সময় জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সচেতন হোন। ৬. মদ পান করা থেকে বিরত থাকুন। ৭. সেলুনে দাড়ি কামালে ডিসপোজিবল ব্লেইড ব্যবহারে নিশ্চিত হোন। ৮. নাক/কান ফোঁড়ানোর সময় জীবাণুমুক্ত সুঁচ ব্যবহারে নিশ্চিত হোন। ৯. হেপাটাইটিস এ ও বি রোগের ভ্যাকসিন/টিকা নিন। ১০. যখন পায়ারসিং বা ট্যাটু আঁকার কাজ করবেন তখন নিশ্চিত হয়ে নিন যে এসব কাজে স্টেরিয়ালাইজড নিডল বা সূঁচ ব্যবহার করা হচ্ছে। ১১. পানি ফুটিয়ে পান করুন। ১২. অপ্রয়োজনীয় এবং অবৈজ্ঞানিক ওষুধ সেবনে বিরত থাকুন।
আসুন, হেপাটাইটিস নির্মূলে সচেতন হই : হেপাটাইটিস একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসমস্যা। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিস নির্মূলে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই লক্ষ্য পূরণে ২০২০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ মানুষের এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৯৫ শতাংশ মানুষের রোগ নির্ণয় করার কর্মসূচী ঘোষিত হয়েছে। দেশের প্রায় ১ কোটি হেপাটাইটিস ভাইরাস বহনকারী মানুষের মধ্যে আপনিও একজন হতে পারেন। একমাত্র সঠিক রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই স্বল্পমূল্যে শরীরে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব নিশ্চিত হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, রক্ত পরীক্ষা করান, হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হলে আতংকিত না হয়ে এ দেশেই সর্বাধুনিক ও বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা গ্রহণ করুন। এ বিষয়ে ভ্রান্ত পরামর্শ বর্জন করুন। সবাই সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন।

লেখক : এমডি (হেপাটোলজি), লিভার বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক, হেপাটোলজি বিভাগ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট