চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মৌর্যযুগে ভারত ও বাংলা

নাওজিশ মাহমুদ

২৮ জুলাই, ২০১৯ | ১:১৭ পূর্বাহ্ণ

উত্তর ভারতে কুষান সা¤্রাজ্য পতনের (২৩০ খ্রিস্টাব্দ) পর মগধের পাটালিপুত্রকে (আধুনিক পাটনা) রাজধানী করে বৃহৎ সা¤্রাজ্য হিসেবে গুপ্তশাসনের (২৭৫ খ্রিস্টাব্দ) উত্থান ঘটে। এর মাঝের সময়ে রাজনৈতিক ভাঙচুরের যুগ বলা চলে। গুপ্তরা ছিল বৈশ্য বর্ণের। গুপ্তবংশের উত্থানের কারণ ছিল ঘোড়াকে স্বার্থকভাবে ব্যবহারের দক্ষতা। ফলে তারা গতিশীল এবং দক্ষ অশ^ারোহী হিসেবে অন্যদের উপর আধিপত্য কায়েম করে। গুপ্ত বংশের প্রথম দুজন শাসক ছিলেন মহারাজ শ্রীগুপ্ত এবং তাঁর পুত্র মহারাজ ঘটোৎকচ। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত (৩১৯-৩৩) গুপ্ত শাসন সুসংহত করেন। তিনি গুপ্ত বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। ক্ষত্রীয় লিচ্ছবী কন্যা কুমারদেবীকে বিয়ে করে চন্দ্রগ্রপ্ত ভুখ-গত সুবিধা এবং দুইটি রাষ্ট্রশক্তির মিলন ঘটান। মৌর্যযুগ থেকেই এই বৈশালীর লিচ্ছবীরা ছিল প্রধান যোদ্ধাশক্তি। এই মৈত্রীবন্ধনের ফলে গুপ্ত রাজাদের অধীনে ঐক্যবদ্ধ এক সা¤্রাজ্য গঠনে সহায়ক হয়।
সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে গুপ্তাব্দ সাল প্রবর্তন করেন। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পুত্র সমুদ্রগুপ্তের (৩৩৫-৩৮০) আমলে গুপ্ত সাস্রাজ্যকে ভারতের প্রধান শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে মৌর্য স¤্রাট অশোক অহিংসার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন, আর সমুদ্রগুপ্ত হিংসা এবং রাজ্য বিজয়ের জন্য খ্যাতি পান। তবে মৌর্য স¤্রাট অশোক উত্তারাধিকারী সূত্রে বড় সা¤্রাজ্যের অধিকারী হলেও সমুদ্রগুপ্ত যুদ্ধ ও ধ্বংসের মাধ্যমে বড় সা¤্রাজ্য গড়ে তোলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের (৩৮০-৪১২) আমল ছিল গুপ্ত বংশের স্বর্ণ যুগ। দ্বিতীয় চন্দ্রগ্রপ্ত সা¤্রাজ্যকে আরো বর্ধিত করেন। দক্ষিণ ভারতের বৃহৎ সা¤্রাজ্য ভকতক রাজার সাথে নিজের কন্যাকে বিবাহ দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করান। এর পর তারই পুত্র প্রথম কুমারগুপ্ত (৪১৫- ৪৫৫) সাম্রাজ্যকে আরো সুসংহত করেন। তার শাসনের শেষ দিকে ইরান থেকে আগত পুষ্যমিত্ররা এই সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন। কুমার গুপ্তের পুত্র স্কন্দগুপ্ত (৪৫৫-৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ) এই আক্রমণ প্রতিহত করেন। এর পরই গুপ্ত সা¤্রাজ্যে অবক্ষয় শুরু হয়। এর পরবর্তী শাসকগণ, দ্বিতীয় কুমার গুপ্ত, বুধগুপ্ত, বৈন্যগুপ্ত, ভানুগুপ্ত, নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য, তৃতীয় গুপ্ত ও সবশেষ বিষ্ণু গুপ্ত কোন রকমে সা¤্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখেন। ৫৪০ খ্রিস্টাব্দে এই বৃহৎ সাম্রাজ্য হিসেবে পতন ঘটে। মগধের ক্ষুদ্র অংশ এই বংশের শাসানাধীন থাকে। খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হুনদের আক্রমণে গুপ্ত সা¤্রাজ্যের পতন শুরু হয়। হুনদের ঘোড়ার অধিকতর ক্ষীপ্রতা, ধাতুর রেকাব ও দক্ষ তীরান্দাজ ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত যুদ্ধ কৌশল দ্বারা ইরান ও ভারতে সাফল্য অর্জন করে। বহিরাক্রমণ সামলাবার জন্য আভ্যন্তরীণ যে সংহতি দরকার, তা ক্রমশ ব্যাহত হয়েছিল। সা¤্রাজ্যের বিশালতা, উত্তারাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধ, যোগ্য শাসকের অভাব, অর্থনৈতিক সংকট, সামন্ত প্রথায় আঞ্চলিক শাসকদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রাদেশিক বিদ্রোহ প্রভৃতি কারণে গুপ্ত সা¤্রাজ্যের পতন ঘটে। তার মধ্যে প্রধান কারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যে হ্রাস পাওয়ায় শুল্ক আদায় কমে যাওয়া। এর পরে ক্রমাগত ব্যয় বৃদ্ধির সাথে খরচ সংকুলান করতে অক্ষমতায় সৈনিকদের নগদ অর্থে বেতন দিতে অসমর্থ হয়। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির কারণেও শুল্ক হ্রাস পেতে পারে।
গুপ্ত সা¤্রাজ্যের সময় শাসন ক্ষমতা স¤্রাটের উপর ন্যস্ত থাকলেও অমাত্যরাও যথেষ্ট ক্ষমতা ভোগ করতেন। শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সমন্বয় করে চলতো। প্রাদেশিক শাসনের ক্ষেত্রে গুপ্তরা কোন হস্তক্ষেপ করতেন না। গ্রাম পর্যায়ে জনগণের মতামতের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো। ভারতের পঞ্চায়েত ধারণা তখন থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। তবে গুপ্তযুগে বর্ণপ্রথা বহাল ছিল। তবে কড়াকড়ি শিথিল হয়ে পড়ে। গুপ্তরা নিজেরাই ছিল বৈশ্য। বৈশ্যবর্ণের একটি অংশ ক্ষত্রীয় পর্যায়ে উন্নতি হয়। আরেকটি অংশ শূদ্র পর্যায়ে নেমে কৃষিকার্য ও পশুপালনে নিয়োজিত হয়। শূদ্রদের মহাভারত, রামায়ণ এবং পুরাণ শুনার অধিকার দেয়া হয়। নতুন দেবতা বিষ্ণুর পুজা করার অধিকার পায়। ক্রীতদাস, গৃহভৃত্য ও ক্ষেতমজুর শ্রেণি কৃষিজীবীতে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ পশুপালন সমাজ বা ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের দাস সমাজ থেকে ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের কৃষিসমাজ বা সামন্ত সমাজের উত্থান ঘটে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের গুরত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো পুরোহিত ও স্থানীয় শাসকদের নানা বাণিজ্য ও শাসনকার্য প্রদান। তার মধ্যে প্রধান হলো জমির মালিকানা প্রদান। ব্রাম্মণরা এই দান হিসেবে মালিকানা নিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায় করতো। উচ্চশ্রেণি বেশী জমির অধিকারী হয়ে বহু বিবাহ চালু করে এবং আরো বেশী জমি অধিকার করতে সচেষ্ট হয়। এই উচ্চশ্রেণির নারীরা পুরাপুরি পুরুষনির্ভর ছিল। সম্পত্তির কোন উত্তারাধিকারও পেত না। স্ত্রীর সহমরণ এই সময় প্রচলন হয়। নি¤œবর্ণে নারীদের স্বাধীন জীবিকার অধিকার থাকলেও উচ্চবর্ণের নারীদের এই অধিকার ছিল না। তবে মহাভারত, রামায়ণ পড়ার অধিকার পায়। ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়দের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর কনিষ্ঠ ভাই বা অন্য কোন ভাই জ্যেষ্ঠ ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করার রীতি বৈদিক যুগে প্রচলিত ছিল। গুপ্তযুগে তা রহিত করা হয়। তবে নি¤œবর্ণে তা অব্যাহত থাকে।
তবে মৌর্যোত্তরকালে যে ভগবত ধর্মের উৎপত্তি হয়, যেখানে বিষ্ণুর প্রাধান্য, তা গুপ্ত রাজারাও অনুসরণ করেন। বৈদিক দেবতা কৃষ্ণ ও অবৈদিক নারায়ণকে একীভূত হয়ে নতুন রূপ পায়। যা বৈষ্ণব ধর্ম হিসেবে পরিচিতি পায়। যার ভিত্তি ছিল ভক্তি ও অহিংসা। যা ছিল বৌদ্ধ ধর্মের মহাযানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বৈদিক আমলে পশু পালন সমাজের বলি প্রথা ও মাংস খাওয়ার রীতির বদলে কৃষিসমাজে প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থেকে নিরামিষ খাওয়ার প্রচলনের মাধ্যমে সমন্বয় করা হয়। মেথর, শ্মশান পরিচর্যাকারী ও কসাই সম্প্রদায় অস্পৃশ্য হিসেবে স্থান পায়। চন্ডাল নামকরণ করা হয়। গ্রামের বাহিরে আলাদা বাস করতে থাকে। উচ্চবর্ণের লোকেরা তাঁদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতো। বিষ্ণু ধর্মে বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসা নীতি গ্রহণের ফলে এই বৌদ্ধ ধর্মের আবেদন ফুরিয়ে যায়। বিষ্ণু ধর্মের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম বিলীন হয়ে যায়। ভারতবর্ষে থেকে বৌদ্ধ ধর্ম ধীরে ধীরে লোপ পায়।
গুপ্তযুগে সরকারী ভাষা ছিল সংস্কৃত। সংস্কৃত ভাষার চর্চা এই সময় বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। অনেক সাহিত্য ও নাটক রচিত হয়। দ্রুপদী সংস্কৃতভাষা ধারার শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাস রচনা করেন “অভিজ্ঞানশকুন্তলম” যা পৃথিবীর প্রথম ১০০ টি শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্মের মর্যাদা দেয়া হয়। আরেক নাট্যকার ভাস এই সময়ে বিখ্যাত হয়ে উঠেন। সংস্কৃত ভাষায় প্রচুর ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য রচিত হয়। তার পাশাপাশি ধর্মীয় সাহিত্য স্থায়ী রূপ পায়। রামায়ণ, মহাভারত নতুন করে সংকলিত করা হয়। মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভগবত গীতাকে প্রাধান্য দিয়ে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব দেয়া হয়। মহাকাব্যদ্বয় থেকে ধর্মীয় উপদেশ ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য আলাদাভাবে পুরান সংকলিত করা হয়। সংস্কৃত ব্যাকরণও এই যুগে রচিত হয়। অন্যতম জ্যোতিষ্ক অমর সিংহের অমরকোষও এই সময় সংকলিত হয় অর্থাৎ প্রাচীন ভারতের ধ্রুপদী সাহিত্য এই যুগেই সৃষ্টি হয়। এই যুগে বৌদ্ধধর্ম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারায়। তবে শাসকদের কাছ থেকে কোন বাধার সম্মুখ হয়নি। এই সময় নালান্দা শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। গুপ্তরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারী ছিলেন। এই ধর্মের পুনর্জীবিত হয় এই সময়। গুপ্তযুগেই মন্দিরে মূর্তিপুজা ধারা প্রাধান্য পায়। এটাই পরবর্তীকালে প্রচলিত ধারা হিসেবে সর্বজনীন হয়ে উঠে। নানারকম কৃষি উৎসবকে ধর্মের সাথে সংযুক্ত করা হয়। যার কারণে পুরোহিত ব্রাহ্মণদের আয়ের উৎস হয়ে উঠে।
পঞ্চম শতকে পাটালিপুত্রের অধিবাসী আর্যভট্টের লেখা আর্যভট্টিয় শূন্য ও দশমিকের উপর রচিত হয়। বইটি অংক শাস্ত্রের উন্নতমানের বই হিসেবে স্বীকৃত। গুপ্ত সময়ে মহারাষ্ট্রের পাহাড়ের গুহায় বিখ্যাত অজন্তা চিত্রকলা খোদাই করা হয়। দিল্লীর মেহরৌলীতে প্রাপ্ত লৌহ স্তম্ভ গুপ্ত আমলে নির্মিত হয়। পনের শত বছর পরে স্তম্ভে মরচে না পড়ায় তখনকার কারগির দক্ষতা ও উৎকর্ষতার প্রমাণ মিলে। এই সময় বৌদ্ধ মূর্তির পাশাপাশি হিন্দু ধর্মের তিন প্রধান দেবতা বিষ্ণু শিব এবং ব্রম্মের ব্রোঞ্জ মূর্তিও ব্যাপকভাবে নির্মিত হয়।
তৃতীয় শতকের শেষে (২৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) এবং চতুর্থ শতকের প্রথমার্ধে (৩১৯ খ্রিস্টাব্দ) গুপ্ত সা¤্রাজ্যের আদি পুরুষ শ্রীগুপ্ত ও ঘটোৎকচ বাংলার বরেন্দ্র অঞ্চলের সামন্ত রাজা ছিলেন। সেখান থেকে বৃহৎ গুপ্ত স্রাম্যজ্যের বিকাশ ঘটে। পুন্ডবর্ধনভূক্তি এলাকা যা সমগ্র উত্তরবঙ্গকে বোঝাত সরাসরি গুপ্ত শাসনে অধীনে ছিল। চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাঁকুড়ার দামাদোরের তীরবর্তী পোখর্ন নামক অঞ্চলে মহরাজা উপাধিধারী জনৈক রাজা রাজত্ব করতেন, যা ফরিদপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি সংস্কৃত চর্চা করতেন এবং বিষ্ণুর উপাসনা করতেন। সমুদ্র গুপ্তের হাতে তাঁর পতন হয়। চতুর্থ শতকে বাংলার সমতট অঞ্চল বা দক্ষিণ বঙ্গ গুপ্ত সা¤্রাজ্যের অন্তর্র্ভুক্ত হয়। এই অঞ্চলের প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবে ব্রাহ্মণ ছিল না, বৌদ্ধ ছিল তা জানা যায় না। তবে এই অঞ্চলের মানুষ প্রাকৃতিক ভাষা জানত এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিও অনুগত ছিল। এখানে উত্তর বঙ্গের মত সংস্কৃত ভাষা চর্চার নিদর্শন পাওয়া যায় নি। ব্রাম্ম লিপি ব্যবহার করতো। বর্ণপ্রথারও কঠোরতা ছিল না। তবে ধারনা হচ্ছে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় তা¤্রলিপ্ত বা গঙ্গে বন্দর ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় সমতটের সমদ্দর বন্দর (চট্টগ্রাম বা সন্দ্বীপ) মাধ্যমে বহির্বাণিজ্য সচল রাখার প্রয়োজনে সমতট দখল করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। উত্তর প্রদেশ ও বিহার ছিল গুপ্ত সা¤্রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্র। এই অঞ্চল গুপ্তরা সরাসরি শাসন করতো। এর বাহিরে শাসন করতো গুপ্তদের নিয়োগকৃত শাসক দ্বারা। বাংলা অঞ্চল ছিল গুপ্তদের প্রশাসনিক ক্ষমতা কেন্দ্রের বাহিরের অঞ্চল। ফলে গুপ্ত শাসনের শেষে বাংলায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। যারা ছিল মূলত করদরাজ্য বা প্রায় স্বাধীন ছিল।
আজকের ভারতে ব্যাপক যে হিন্দু ধর্ম পালিত হয়। তার প্রধান উৎপত্তির উৎস বৈদিক সভ্যতা। এই বৈদিক সভ্যতা আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে সাথে করে নিয়ে আসে। মৌর্য শাসন আমলে এবং মৌর্যোত্তর যুগে বৌদ্ধ ধর্মের কারণে বৈদিক সভ্যতা পিছিয়ে যায়। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারায়। ভারতীয় প্রাচীন জনগোষ্ঠীর সামাজিক রীতির সাথে ক্রমাগত মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বিকশিত হয়ে নতুন সংস্কৃতি। যা হিন্দু ধর্মকেও প্রভাবিত করে। বৌদ্ধ ধর্ম বিশেষ করে মহাযান ধারার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু ধর্ম অধিকতর ভারতীয় হয়ে উঠে। গুপ্ত আমলে এই বৈদিক সভ্যতাকে ভিত্তি কওে হিন্দু ধর্ম পুনর্জীবিত হয়। নতুনভাবে পরিপূর্ণতা পায়। বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে পশুপালন সমাজের সভ্যতাকে কৃষি সমাজ সভ্যতার সাথে সমন্বয় করে নতুর রূপে হাজির হয়। ভারতীয় সমাজে স্থায়ী রূপ নেয়। বর্ণ প্রথাকে নতুন সভ্যতার সাথে সমন্বিত করে হিন্দু সমাজ কাঠামো সগৌরবে উত্থান ঘটে। গুপ্ত শাসকেরা হিন্দু ধর্মের বিষ্ণু ও শৈব ধারা দুই ধারাকেই পৃষ্ঠপোষকতা করে। গুপ্ত সা¤্রাজ্যের পতন হলেও তাদের প্রবর্তিত ভাষা সাহিত্য, ধর্মীয় বিধান, সমাজ কৃষি উৎপাদনে উৎকর্ষতার নিয়মাবলী ভারতীয় সমাজের মূলভিত্তি হয়ে উঠে। যা হিন্দু ধর্ম, ভাষা, সমাজ ও সভ্যতা ভারতের মূল ধারা হিসেবে এখনো সগৌরবে বিরাজমান।
সমুদ্রবাণিজ্য, বর্হিসভ্যতার ও বৈদেশিক যোগাযোগের প্রভাবে বাংলা অঞ্চলের বৃহত্তর বাঙালি সমাজ গুপ্ত সমাজের রচিত ভাষা ধর্ম সমাজ ও সভ্যতার বিপরীতে নতুন ধর্ম নতুন সমাজ বাংলা ভাষা ও আরো অগ্রসর সভ্যতার আলোকে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ গড়ে তুললেও বৃহৎ অংশ এখনও গুপ্ত আমলের ধর্ম, সমাজ ও সভ্যতাকে আঁকড়ে ধরে আছে। বাঙালি দুটি সমান্তরাল স্রােত নিয়ে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে বাস করছে। তার মধ্যে একটি ধারা শুধু বাঙালিদের আধিপত্য আরেকটি ধারা ভারতীয় কাঠামোতে নিজস্ব স্বকিয়তা নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। বাঙালি দুটি বিপরীত স্রােত ধারা সমান্তরাল চলবে, না একই স্রােতে মিশবে তা নির্ধারণ করবে এই উভয় অংশের দূরদর্শিতা এবং এই অঞ্চলের রাজনীতি অর্থনীতি ও সংস্কৃতির বিকাশের সাথে রাষ্ট্রীক দেয়ালের বাঁধা অতিক্রমের আকাক্সক্ষার উপর অনেকাংশ নির্ভর করবে।

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট