চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ঋণখেলাপি : বিলাসী জীবন, তবু ঋণ শোধ করেন না তাঁরা

অধ্যাপক ড. নারায়ণ বৈদ্য

২৭ জুলাই, ২০১৯ | ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

অর্থনীতি বিষয়ের ওপর লেখাপড়া করার কারণে স্বাভাবিকভাবে অর্থনীতির চলায়মান কিছু কিছু বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তোলে। গত সপ্তাহে একটি পত্রিকায় বর্তমান ঋণ খেলাপি অর্থের পরিমাণ নিয়ে একটি লিখা প্রকাশ করি। কয়েকজন বন্ধু ও অনুজ আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানায়। কিন্তু ঋণখেলাপিদের জীবন ব্যবস্থা নিয়ে যখন খবরাখবর নিতে শুরু করি তখন দেখা যায়, ঋণ খেলাপিদের কারণে তাঁরা অনুতপ্তও নয় বা তাঁদের জীবনযাত্রা মানের নি¤œগতিও দেখা যায় না। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গেলেও অধিকাংশ ঋণখেলাপি কৃতিত্বের সাথে দেশে অবস্থান করছে। তাঁদের চলাফেরা, জীবনযাত্রার মান অনেক অনেক ওপরে। শুধু তাই নয়। তাঁরা আচার আচরণে এরূপ ভাব প্রকাশ করে যে, ঋণ পুনঃ তফসিলের নামে আরো ঋণ না দিলে আসল ঋণও ফেরৎ দেয়া হবে না। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, খেলাপিকৃত ঋণ পেতে হলে তাঁদেরকে শিল্প তথা ব্যবসা পরিচালনার জন্য আরো ঋণ দিতে হবে। অর্থাৎ সরকারকে একপ্রকার বাধ্য করে আরো ঋণ দেওয়ার জন্য। অন্যথায় ঋণ ফেরৎ দিতে তাঁরা পারবে না।
বাংলাদেশে বর্তমানে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই প্রবণতা আরো বেড়েছে। বিশেষ করে বড় ও প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে এটা দেখা যাচ্ছে; তাঁরা ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা ও পরিচালকদের সঙ্গে যোগসাজশ, অনিয়ম, জাল জালিয়াতি ও রাজনৈতিক প্রভাবসহ বিভিন্ন কৌশলে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন। বড় কিছু গ্রাহকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত। এঁরা বিভিন্ন উপায়ে ঋণের নামে প্রচুর টাকা ঋণ নিয়েছেন এবং নানা কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু ফেরত দিচ্ছে না। ঋণ ফেরত দেয়ার আন্তরিকতাও তাঁদের মধ্যে দেখা যায় না। এসব ঋণের বিপরীতে যে জামানত নেয়া হয় তাও পর্যাপ্ত নয়। ফলে মামলা করেও ঋণ আদায় করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া রাজনৈতিক চাপেও অনেক ঋণ গেছে। ঋণখেলাপিরা যে টাকায় জমি, বাড়ি, গাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনেছেন সেটাতো সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা। এটা খেয়ানত করার অধিকার কারো নেই।
২০১৮ সালের পরবর্তীতে সরকারি ঘোষণা অনুসারে ঋণ খেলাপির পরিমাণ আর বাড়বে না বলে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়ের জোর প্রচেষ্টা চালানোর কথা বলা হয়েছিল। অথচ এই সময়ে ঋণখেলাপি হ্রাসে আদায়ের পদক্ষেপ জোরদারের পরিবর্তে ঋণখেলাপিদের আরো সুবিধা ও ছাড়ের পথ তৈরি করে দিয়েছে সরকার। সম্প্রতি ঋণ শ্রেণিকরণ ও পুনঃতফসিল উভয় নীতিমালাতেই ঋণখেলাপিদের বড় ধরনের ছাড় দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ পুনঃতফসিল নীতিমালার আওতায় মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট ও ৯ শতাংশ সরল সুদ নির্ধারণসহ ১০বছর মেয়াদে ঋণ নিয়মিত করার ব্যবস্থা করে এক সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এই সার্কুলারের সুবিধাভোগী হবেন খেলাপিরাই। এতে কাগজে কলমে ঋণখেলাপি কমলেও ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুসারে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের শেষে দেশে কার্যরত সকল তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এক লাখ ৭০ হাজার ৩৯০টি। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি হওয়া অর্থের পরিমাণ এক লাখ দুই হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের (২০১৯) মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১১.৮৭ শতাংশ। এর বাইরে গত বছরের ডিসেম্বর (২০১৮) পর্যন্ত অবলোপনের মাধ্যমে ব্যাংকের হিসাবের খাতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে নিট ৪০ হাজার ১০১ কোটি টাকা। এ ঋণে যোগ করলে দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ হবে এক লাখ ৫০ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা।
কয়েক ডজন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি হয় চট্টগ্রামের একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। তিনি ঋণের টাকা ফেরৎ না দিয়ে নামে-বেনামে বিভিন্ন জায়গায় অঢেল সম্পদ গড়েছেন। তারপরও বিভিন্ন সময় প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক সুবিধা নিয়েছেন। একই ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন বার বার। সবশেষ নিয়েছেন পুনর্গঠন সুবিধাও। কিন্তু ঋণের টাকা ফেরত দেননি। চট্টগ্রামের অপর এক ব্যবসায়ী ঋণখেলাপি হয়েও বিলাসী জীবনযাপন করেন। চড়েন দামী গাড়িতে। রাজধানীর ধানমন্ডি ও চট্টগ্রামে তাঁর বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। এছাড়া নামে-বেনামে বিভিন্ন জায়গায় অনেক জমি থাকারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাঁর মালিকানাধীন পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম তিনটিতে ৫০১ কোটি টাকা, দ্বিতীয়টিতে ২০৯ কোটি টাকা এবং তৃতীয়টিতে ১১৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপির শীর্ষ তালিকায় রয়েছে। আর এক নামসর্বস্ব ব্যবসায়ী এক হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ঋণের টাকা ফেরত না দিয়ে সপরিবারে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
ঋণখেলাপিরা ঋণের টাকা সাবাড় করে ক্ষান্ত নয়, তাঁরা সরকারের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকার সুদও মওকুফ পেয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ছয় হাজার ১৬৩টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে এক হাজার ১৯৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা সুদ মওকুফ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ মওকুফ করেছে অগ্রণী ব্যাংক। এ ব্যাংকটি দুই হাজার আটটি ঋণের বিপরীতে ৪৯৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা সুদ মওকুফ করেছে। আর বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক কোন সুদ মওকুফ করেনি। অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে কৃষি ব্যাংক ৬৬টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ৪৩৫ কোটি ৯৬ লাখ, রূপালী ব্যাংক ২০৩টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ১৩৪ কোটি ২৬ লাখ, সোনালী ব্যাংক ১৪টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ৭৩ কোটি ৭৩ লাখ, জনতা ব্যাংক দুই হাজার ৪৭৩টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ৫৩ কোটি ৮১ লাখ, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এক হাজার ৩৮০টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে চার কোটি ৩৫ লাখ এবং বেসিক ব্যাংক ১৯টি ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে এক কোটি ৬৯ লাখ টাকা সুদ মওকুফ করেছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে যে, চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ীদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণের বিবেচনায় এর পরিমাণ প্রায় ২৪ শতাংশ। এই ১২ হাজার কোটি টাকা পাওনা চট্টগ্রামভিত্তিক ৬৪ ব্যবসায়ী ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে। দেশজুড়ে বাকি ৩৬ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের খেলাপি ঋণের তালিকায় থাকা ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই জাহাজ ভাঙ্গা বা শিপ ব্রেকিং শিল্পের সঙ্গে জড়িত, যারা দীর্ঘদিন ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করেনি। এছাড়া ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী, ভোজ্য তেল, স্টিল খাতের ব্যবসায়ীও রয়েছে খেলাপির তালিকায়।
ঋণখেলাপিরা থাকেন শতকোটি টাকার আলিশান বাড়িতে, চড়েন কোটি টাকার বিলাসবহুল গাড়িতে। নিজ ও পরিবারের নামে করেছেন স্কুল-কলেজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। নামে বেনামে কিনেছেন জমি, নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ছেন। সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তিও বিপুল। নিয়মিত যান বিদেশে। আবার বিশে^র বিভিন্ন দেশে গড়েছেন সেকেন্ড হোম। পাচার করছেন অর্থ। সবই ঠিক চলছে। শুধু ব্যাংক ঋণের টাকা ফেরত দেওয়াতে যত অনীহা। আবার ঋণের টাকা মেরে সপরিবারে বিদেশে পালিয়েছেন এমন উদাহরণও আছে। এঁদের কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা বর্তমানে ৫১ হাজার কোটি টাকা, যা দিয়ে প্রায় দুইটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যায়।

লেখক : ট্রেজারার বিজিসি ট্রাষ্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট