চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

আতঙ্ক, নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা অরাজকতা ছড়াচ্ছে কারা?

সমকাল দর্পণ

ড. মাহফুজ পারভেজ

২৭ জুলাই, ২০১৯ | ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন। কিন্ত এক সাথে মিলালে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির ছবি দেখা যায়। মনে হয়, অদৃশ্য কে বা কারা সংগোপনে পুরো সমাজ ও মানুষকে টার্গেট করেছে। সুযোগ পেলেই নানা ছুতা তৈরি করে বা গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করছে।
এমন অরাজকতা ও নৈরাজ্যের সিরিজ ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে আতঙ্কিত হতে হয়। নিজের জন্য, স্ত্রী, সন্তান, পরিজনের জন্য চিন্তিত হতে হয়। কখন প্রকৃত ছেলেধরা মু-ু কেটে নিয়ে যাবে, কিংবা ছেলেধরা বানিয়ে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হবে, কেউ জানে না।
আতঙ্ক, নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা, অরাজকতা দেখা যায় বিপ্লব ও সংঘাতের সময়। চার্লস ডিকেন্সের কালজয়ী ‘অ্যা টেল অব টু সিটিজ’ যারা পড়েছেন, তারা সেই বিবরণ জানেন।
কখনো কখনো উদ্দেশ্যমূলক ভাবেও আতঙ্ক, নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা, অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়। প্রতিবিপ্লবী, নাশকতাকামী, সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো কখনো কখনো সুপরিকল্পিত উপায়ে সমাজে ভীতি, আতঙ্ক ছড়িয়ে স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে চায় এবং এর মাধ্যমে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে।
নব্য-স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বার্থবাদী মহল অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল। স্বাধীনতার পর পর তেমন চিত্র দেখা গিয়েছিল। মতিঝিলে গণপিটুনিতে যুবক নিহত। শাহবাগে লাশ। আলফাডাঙ্গায় ব্যাঙ্কে হামলা। চাঁদপুরে পাটের গুদামে আগুন। এমন বহু ঘটনা সে সময় ঘটানো হয়েছিল।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশ্য ও গোপন শত্রুদের সেই হামলা ও নাশকতা রুখে দেশ ও জাতি অকুতোভয়ে সামনে এগিয়ে এসেছে। তবুও শত্রুর আঘাত ও চক্রান্ত মনে হয় থামে নি। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে তেমনই ধারণা হচ্ছে।
কারণ, গত কিছুদিন ধরে বেশ কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ও মৃত্যু সমাজে আতঙ্কের কারণ হয়েছে। প্রথমে ব্যাগে তাজা কর্তিত মস্তকসহ লোক ধরা পড়লো। তারপর ছেলে ধরা সন্দেহে মারা হলো একাধিক নারী ও পুরুষকে। সব ঘটনাকে এক সাথে করলে নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দেওয়ার একটি উদ্দেশ্য ধরা পড়ে। মানুষের মধ্যে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা ছড়িয়ে দেওয়ার একটি বদ মতলব শনাক্ত হয়।
কে বা কার এইসব করছে? কেউ না কেউ অবশ্যই নেপথ্যে রয়েছ। কারণ সমাজে কোনও কিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনা-আপনি হয় না। এরা কারা? কী তাদের উদ্দেশ্য? যারা এসব হীন কাজ করছে?
উদ্দেশ্য যে ভয়ঙ্কর তা অনুমেয়। একজন মানুষও এগিয়ে এসে যুক্তি দিয়ে দেখছে না, নারী বা পুরুষটি আসলে কে। উন্মত্তদের সামনে কেউ হয়ত দাঁড়ানোর সুযোগও পায় নি। ছেলেধরা বলে রায় দিয়ে সেখানে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো। এক জায়গায় নয়, একাধিক স্থানে এমন নৃশংস ও বর্বর ঘটনা ঘটলো!
এই প্রবণতা যদি সামাজিক হিংসা ও অসহিষ্ণুতা থেকে হয়, তবে অবশ্যই তা প্রতিরোধ করতে হবে। সমাজে এমন তা-ব ছড়িয়ে গেলে তা মনুষ্য বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে। আইন-কানুন, যুক্তি, বিশ্বাস, রীতি-নীতি নির্বাসিত হবে।
আর এই প্রবণতা যদি রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক কারণে হয়, তবে তা মারাত্মক। নৈরাজ্য, অরাজকতা ও অস্থিতিশীলতার মহামারী শুরু হবে তাহলে। মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপন বিপন্ন হয়ে পড়বে।
কিংবা এই প্রবণতা যদি আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা ও ক্রিমিনাল কার্যক্রম হয়, তবে এর মাধ্যমে সমাজ অপরাধপ্রবণ হবে। ক্রিমিনালাইজেশনের মাধ্যমে অপরাধীরা ক্রমেই সব কিছু তছনছ করে দেবে।
ঘটনার নেপথ্যে কারণ যা-ই হোক, তাকে চিহ্নিত করতে হবে। সঠিকভাবে খুঁজে বের করতে হবে অস্বাভাবিক ঘটনাগুলোর প্রকৃত কার্যকারণ। তারপর উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যদি এক্ষেত্রে শৈথিল্য ও গাফিলতি দেখানো হয়, তাহলে আতঙ্ক, নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা, অরাজকতার রাহু সবাইকে গ্রাস করবে।
মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত রণাঙ্গন পেরিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতনকে পদানত করার জন্য এবং গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবিকতা, উদারতা, সহিষ্ণুতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য। এমন বাংলাদেশে গণপিটুনি, মানুষ হত্যা, গুজব, হটকারিতা, নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতার কোনও অপচেষ্টা মেনে নেওয়া যায় না। সম্মিলিত পদক্ষেপে সবাই মিলে সমাজে বিকাশমান অন্ধকার ও অনাচার রোধ করতেই হবে।

লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট