চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিল্পী শান্তনু’র শূন্যতা ঘুচবে কী?

লোকপ্রিয় বড়–য়া

২৬ জুলাই, ২০১৯ | ১:১৯ পূর্বাহ্ণ

শান্তনু বিশ্বাস চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। সাংস্কৃতিক শব্দটির সাথে জড়িয়েছিলেন স্বীয় যোগ্যতা ও মেধার উপযুক্ত প্রমাণ রেখে। সেন্ট প্লাসিড স্কুলের অধ্যয়নরত অবস্থা থেকেই মেধাবী ছাত্রের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। এই মেধা শুধু পুঁথিগত বিদ্যাতে সীমাবদ্ধ রাখেননি, অসাধারণ মেধার কারণে তিনি নিজেকে ক্লাসের পড়ালেখার পাশা-পাশি ব্যস্ত রেখেছিলেন কবিতা, গীত রচনা, সুর দেওয়া, গান গাওয়া, থিয়েটারে যুক্ত হওয়া, অভিনয় করা, নিজ থেকে নাটকের পান্ডুলিপি লেখা এবং নাটকের নির্দেশনা দেওয়া সব ক্ষেত্রেই সমান পারদর্শী। শান্তনু বিশ্বাস জানতেন ‘জীবন একটাই’। তাই হয়তো নিজের মনে বড় তাগিদ ছিল কিছুতো করে যেতে হবে। গত ৯ জুলাই এই প্রাণোচ্ছল মানুষটি সারাদিন অফিস করে বিকেলের দিকে বুকে ব্যাথা অনুভব করেন এবং দ্রুত স্থানীয় একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি হন। দু’টো দিনের মধ্যেই উনার শরীরের অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শে উনাকে ঢাকা ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় এবং ১২ জুলাই তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান।
তারুণ্যের উচ্ছলতায় দীপ্ত প্রত্যয়ী টগবগে যুবক ১৯৭৬ সালে মিলন চৌধুরীর নেতৃত্বে শান্তনু বিশ্বাস, অধ্যাপক সনজীব বড়ুয়াসহ গনায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ করে এবং শান্তনু বিশ্বাস ও সনজীব বড়ুয়া প্রথম প্রদর্শনীতে অভিনয় করেন। বিভিন্ন কারণে ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক পরিম-লে মিলন চৌধুরীর নেতৃত্বে শান্তনু বিশ্বাস ও অধ্যাপক সনজীব বড়ুয়া প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে “অঙ্গন” থিয়েটার এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে ঢালী আল মামুন ও শিমুল বড়ুয়া প্রমুখ নাট্যবাক্তিত্ব এসে ‘অঙ্গন’ থিয়েটারে যুক্ত হয়েছিলেন। চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার নিয়ে কথা হলে যে মানুষটির নাম অগ্রে চলে আসে তিনি হলেন মিলন চৌধুরী। মিলনদার নেতৃত্বে শান্তনু বিশ্বাস, সনজীব বড়ুয়া, শুভ্রা বড়ুয়া, ঢালি আল মামুন, শিমুল বড়ুয়া প্রমুখ নাট্যপ্রেমী এক ঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল যুবক/যুবা সমন্বয়ে নিজেদের গ্রুপে নিয়মিত নাটকে অভিনয় করেছিলেন। এরি মাঝেই শান্তনু বিশ্বাস পান্ডুলিপি (স্ক্রীপ্ট) লিখে নাটকে নির্দেশনা দিতে শুরু করেন। অভিনয় করে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন গ্রুপ থিয়েটার অঙ্গনে এবং অগুনিত দর্শক শ্রোতাদের নিকট থেকে। তখন থেকেই “অঙ্গন থিয়েটার” বেশ ভাল ভাল নাটক নিয়ে মঞ্চ মাতিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। গ্রুপে নিয়মিত রিহার্সেল, মঞ্চে নাটক পরিবেশনা আর প্রতিটি পদক্ষেপেই নেত্ত্বৃ দেওয়া শান্তনু বিশ্বাসের আস্থাকে দিনকে দিন করেছে মজবুত। এক পর্যায়ে গ্রুপের কাজের ফাঁকে শুভ্রাকে ভালবেসে ফেলে এবং প্রেমের বন্ধন মজবুত করতে দু’জনেই সিদ্ধান্ত নিলেন সংসার জীবনে নিজেদের বেঁধে ফেলবেন এবং বিয়ে করে ঘরে তুলে নিলেন শুভ্রাকে।
রাউজান উপজেলার রাউজান বৌদ্ধ পল্লীর বিশিষ্ট সমাজসেবী এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী প্রয়াত সরিৎ বড়ুয়া’র ২য় কন্যা শুভ্রা। শান্তনু বিশ্বাসের জীবন সঙ্গী হয়ে শুভ্রা পারিবারিক, সাংসারিক এবং মঞ্চে খুব বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন, যা শিল্পী শান্তনু’র আঙ্গিনাকে করেছিল আলোকিত। শান্তনু বিশ্বাস ও শুভ্রা বিশ্বাসের ঘরে দুই কন্যা সন্তান এবং তারা আজ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একাধারে গ্রুপে অভিনয়, নির্দেশনা চালিয়ে যেতে যেতে এক পর্যায়ে নিজেকে কিছুটা গ্রুপের কাজ থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন এবং হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আলাদা থিয়েটার গ্রুপ করবেন। ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন “কালপুরুষ নাট্য সম্প্রদায়”। একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছেন এবং সফলতাও পেয়েছেন অনেক। মনের কোণে অনেক ভাবনা আর তাইতো শুধু নাটক নিয়ে কেন? দেখা যায় তিনি নিজের গ্রুপের হাল তুলে দিলেন প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন তার স্ত্রী গ্রুপের দায়িত্বটা কেমন নিতে পারে। উনার ভাবনা চিন্তা সঠিক তাইতো শুভ্রা বিশ্বাস নিজেকে প্রমাণ করেছেন এক দক্ষ নাট্যকর্মী থেকে দলের নেত্ত্বৃ দিতে।
শিল্পী শান্তনু কি শুধু নিজের কর্মস্থলের গুরু দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকবেন? না তা নয়, তিনি লিখে চলেছেন পান্ডুলিপি, গীত রচনা, নিজের সুর, গেয়েছেন নিজে এবং তার রচিত গানে সুর দিয়ে অনেক কণ্ঠশিল্পী রেডিও টেলিভিশনে গান গেয়েছেন। দেশের বিভিন্ন শহরে তার নিজের লেখা ও সুরে একক স্টেজ সন্ধ্যার আয়োজন করে দর্শক-শ্রোতাদের মন জয় করেছিলেন। উনার গানের বিশেষত্ব ছিল পাশ্চাত্য ও ইউরোপের বিখ্যাত গানের মিউজিকের সাথে এ দেশীয় ধাঁচে গবেষণামূলক গান উপস্থাপনা করা যা সত্যিই একজন গুণী শিল্পীর উন্নত প্রতিভার পরিচয় ঘটেছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও অনেক আমন্ত্রণ পেয়ে গানের অনুষ্ঠান করে বেশ সম্মান বয়ে এনেছিলেন। এই বহুমাত্রিক প্রতিভার মানুষটির চলনে, বলনে পরিবেশনায় অসাধারণ ক্যারিশমা পরিলক্ষিত হতো, যা সচরাচর প্রত্যেক শিল্পীদের ক্ষেত্রে দেখা যেত না। এই গুণী মানুষটি দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে এই উপমহাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান এম এম ইস্পাহানী গ্রুপের টি ট্রেডে বিভিন্ন পদে থেকে কোম্পানীর চীফ অপারেটিং অফিসার এর দায়িত্ব বেশ সুনামের সাথে পালন করেছিলেন।
বাংলাদেশে যে ক’জন ভাল টি টেস্টার রয়েছেন তাদের মধ্য শান্তনু বিশ্বাস ছিলেন একজন অগ্রণী ব্যক্তি। যোগ্যতার মাপকাটিতে বাংলাদেশ টি ট্রেডার্স এসোশিয়েশন এর চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বেশ দক্ষতার সাথে। কোম্পানীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে সহকর্মীদের এবং মালিকদের বিনোদনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। উনার সাথে মালিকপক্ষদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নীবিড়। কোম্পানীর হয়ে দেশে বিদেশে নেতৃত্ব দিয়েছেন বহুবার এবং পৃথিবীর অনেক দেশ পরিভ্রমণ করেছেন।
এই প্রতিষ্ঠানের উনার সহকর্মীরা আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে এই মহান ব্যক্তিটিকে। নিজ দায়িত্ব পালনের অবসর মুহূর্তে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন কলম ও কাগজ নিয়ে। গুন গুন মনে মনে আবৃতি করতেন আর লিখতেন, যা আমার কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল একই প্রতিষ্ঠানে চাকুরির সুবাদে। আমি এক কথায় এই বিশাল মাপের মানুষটিকে বলবো তিনি ছিলেন নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। গীত রচনা করেছেন শত শত এবং কিছু ইতিমধ্যে বই আকারে ছাপিয়ে দিয়ে অমূল্য সম্পদ রেখে গেছেন অনেক শিল্পীদের জন্য। আমার জানামতে উনার অনেক অপ্রকাশিত লেখা রয়েছে, যা হয়তো শুভ্রা বৌদিকে দায়িত্ব নিয়ে তার অসমাপ্ত কাজগুলি সম্পন্ন করে বর্তমান প্রজন্ম এবং অগুনিত পাঠক ও শিল্পীদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে।
শান্তনু বিশ্বাস নিজে জানতেন জীবন একটাই আর তাই নিজে গবেষণা করেছেন অনেক। নিজের শরীরটা নিয়ে অনেক শিক্ষার্থীরা গবেষণা করুক এমন একটি ভাবনা উনাকে তাড়িত করতো এবং বেশ ক’বছর আগে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের এনাটমী বিভাগের কাছে নিজের দেহ দান এর আইনগত দলিল হস্তান্তর করে রেখেছিলেন। আমরা যারা জানিনি তারা দেখলাম কী মহৎ কর্ম উনি সম্পাদন করেছিলেন। জয়তু শান্তনু বিশ্বাস। আপনার দেহ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে অনেক ছাত্র-ছাত্রী গবেষণা কাজে লাগিয়ে নিজেদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত করে মানবসেবার কাজে আসবে।
আমাদের বাংলাদেশের এই গুণী শিল্পী শান্তনু বিশ্বাসকে আমরা আমাদের আঙ্গিনাতে আর দেখবোনা কিন্তু সমস্ত গ্রুপ থিয়েটার সংগঠনের এবং পুরো সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দায়িত্ব রয়েছে সদ্য প্রয়াত শান্তনু বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখতে। উনার সৃষ্টি করা “কাল পুরুষ নাট্য সম্প্রদায়” এর দায়ভার রয়েছে অনেক। আমরা চাইবো এই গ্রুপের কর্মকা- দীর্ঘস্থায়ী হোক, ভাল কাজ নিয়ে তাদের পথচলা হোক বাধাহীন। পরিশেষে একটি ছোট্ট প্রস্তাব রাখছি; সমুদাকে (শান্তনু বিশ্বাস) সবার মাঝে আরও চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে যে কোন মহল থেকে প্রতিবছর ‘শান্তনু’ স্মৃতি পদক চালু হোক, যা গুণী ও উদিয়মান শিল্পীদের সম্মান বৃদ্ধি হবে। শান্তনু বিশ্বাসের অকস্মাৎ বিদায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বড় শূন্যতা বিরাজ করবে অনেক দিন। শ্রদ্ধেয় শান্তনু স্যার আপনি যেখানে থাকুন অনেক শান্তিতে থাকুন। আপনাকে মনে রাখবো আমরা শ্রদ্ধায় ভালবাসায় প্রতিদিন।

লেখক : নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্রকর্মী ও প্রাবন্ধিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট