চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

ধর্মীয় ও জাগতিক জীবনে পাক-পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

২৫ জুলাই, ২০১৯ | ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

পবিত্রতা একজন মানুষের জন্য উত্তম ও উৎকৃষ্ট অবস্থা আর অপবিত্রতা নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত অবস্থা। মানুষের কর্তব্য ও বৈশিষ্ট্যই হলো সর্বদা নিকৃষ্টতা পরিহার করে সাধ্যমত উত্তম ও উৎকৃষ্ট অবস্থায় থাকা। যারা ভালভাবে পবিত্রতা অর্জন করেন, পবিত্র থাকেন আল্লাহ তাদের প্রশংসা করেন। পরিষ্কার, পরিপাটি, নির্মল অবস্থাকে বলে পরিচ্ছন্নতা। আর বিশেষ পদ্ধতিতে অর্জিত দেহ, মন, পোষাক ও স্থান বা পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা ও নির্মলতাকে বলে তাহারাত বা পবিত্রতা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সালাত আদায় করার জন্যে শরীর, পোষাক ও স্থান তথা পরিবেশ পবিত্র হওয়া অপরিহার্য। পরিচ্ছন্নতা বা পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ। আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতাকে ভালবাসেন। যারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র থাকে সবাই তাদের ভালবাসে। আল্লাহ পাকও তাদের ভালবাসেন। কুরআন মাজীদে আছে; যারা পবিত্র থাকে আল্লাহ তাদের ভালবাসেন।’
নবী করিম (স.) ইরশাদ করেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র, পবিত্রতাই তিনি পছন্দ করেন। আল্লাহপাক আমাদের উদ্দেশ্যে বলেন: যে ব্যক্তি ভেতরে বাইরে পবিত্রতা অর্জন করে, সে অবশ্যই সাফল্য লাভ করে।-(সূরা আ’লা-১৫)।
আমরা নানা রকম কাজ করি- আমাদের হাত, পা, শরীর ও কাপড় চোপড় ময়লা হয়, ধূলাবালি লাগে। ঘামে শরীর ভিজে যায়, দুর্গন্ধ হয়। আমরা মুখ দিয়ে খাবার খাই, দাঁতে ময়লা লাগে। দাঁত, মুখ পরিস্কার না করলে মুখ থেকে দুর্গন্ধ আসে। অকালে দাঁত পড়ে যায়। দাঁত পরিষ্কার রাখার জন্য অযু করার আগে দাঁত মাজতে হয়, মেসওয়াক করতে হয়। মহানবী (স.) বলেছেন, আমার উম্মতের জন্য কষ্ট না হলে, প্রত্যেক অযুর আগে আমি মেসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।’
অনেকের নখ, চুল বড় হয়। দেখতে খারাপ লাগে। নখ বড় হলে নখে নানা রকম ময়লা জমে, তা খাবারের সাথে পেটে যায় এবং পেটের অসুখ হয়। নখ কেটে ছোট ও পরিষ্কার রাখতে হবে। জুমআর দিন নখ কর্তন করা মুস্তাহাব। হামীদ ইবনে আবদুর রহমান স্বীয় পিতা হতে বর্ণনা করেন যে, হুজুরে পাক (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমআর দিন নখ কাটে, সে সুস্থ থাকে। অসুস্থ থাকলে সুস্থ হয়। বৃহস্পতিবার আছরের পরেও নখ কর্তন করার প্রতি ধর্মীয় পর্যায়ে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
ওয়াকী হযরত আয়েশা (রাদি.) হতে বর্ণনা করেন, হুজুরপাক (স.) এরশাদ করেছেন, হে আয়েশা! তুমি নখ কাটবারকালে প্রথমে মধ্যমা, তারপর কনিষ্ঠা, তারপর অনামিকা এবং সর্বশেষ তর্জনীর নখ কাটবে। নখ কাচি অথবা চাকু দ্বারা কাটবে। দাঁত দ্বারা নখ কাটা মাকরূহ। বর্ণিত আছে, হুজুরে পাক (স.) নখ কাটার পর উহা মাটি চাপা দিয়ে রাখার হুকুম দিয়েছেন। নখ কাটার পর আঙ্গুলের মাথা ধুয়ে ফেলবে।-(গুনিয়াতুত ত্বালেবীন)।
চুলও ঠিক করে রাখতে হবে। মহানবী (স.) একবার একটি লোককে এলোমেলো চুল দেখে বললেন, এ ব্যক্তি কি চুল ঠিক করার কিছু পেল না? অনেকে শৌচাগার হতে এসে ভালভাবে পরিষ্কার হয় না। শরীর ময়লা, নোংরা থাকলে নানা রকম রোগ হয়। পায়খানা প্রস্রাবের পর ভালভাবে হাত পরিষ্কার হতে হবে। দিনে একবার গোসল এবং পাঁচবার অযু করার মাধ্যমে দেহ পরিচ্ছন্ন হয়, পবিত্র হয়, মন ভাল থাকে, ফূর্তি লাগে ও কাজকর্মে উৎসাহ আসে।
হযরত আবু হুরাইরা (রাদি.) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, রাসূলুললাহ (স.) এরশাদ করেছেন: যখন কোন মু’মিন অথবা মুসলিম বান্দা ওযু করে এবং চেহারা ধোয়, (তার চেহারা থেকে) তার চোখের দ্বারা কৃত সব গুনাহ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে দূর হয়ে যায়। যখন সে তার হাত ধোয়, তার দু’হাতে কৃত সমস্ত গুনাহ তার হাত থেকে পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে দূর হয়ে যায়। অত:পর সে ব্যক্তি সমস্ত গুনাহ থেকে পাক হয়ে যায়-(মুসলিম)।
উল্লেখ্য, অযু করার সময় অবশ্য পালনীয় কাজসমূহ নির্দেশ করতে গিয়ে আললাহতায়ালা বলেছেন- হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য প্রস্তুত হবে, তখন তোমরা তোমাদের মুখমন্ডল ও হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করবে এবং তোমাদের মাথা মাসেহ করবে আর গ্রন্থি পর্যন্ত ধৌত করবে।-(৫:৬)। উপরোক্ত আয়াত থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, অযুর ফরয চারটি। পক্ষান্তরে, আমাদের এ বিষয়টিও জেনে রাখা ভাল, গোসলের ফরয তিনটি: এক. কুলি করা, দুই. নাকে পানি দেয়া, তিন. সমস্ত শরীর একবার ধৌত করা।-(আলমগীরী)।
আমরা নানা ধরনের কাজকর্ম করি। আমাদের কাপড়-চোপড় ময়লা হয়। ময়লা কাপড়-চোপড় পরলে শরীর খারাপ হয়। নানারকম রোগ হয়। মন ভাল লাগে না। পোষাক পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহপাক বলেন:“ তোমার কাপড় পবিত্র পরিচ্ছন্ন রাখ”। মহানবী (স.) সবসময় পবিত্র কাপড় পরতেন। শরীর পরিষ্কার রাখার মতই কাপড়-চোপড় পরিষ্কার রাখার গুরুত্ব অপরিসীম। অপবিত্র শরীরে যেমন সালাত আদায় করা যায় না, তেমনি অপবিত্র পোষাকেও সালাত আদায় করা যায় না। কেননা হুজুর (স.) বলেছেন: পবিত্রতা অর্জন করা নামাযের চাবি।-(তিরমিযী)।
আমরা অনেক সময় ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট খেলার মাঠ ইত্যাদি নোংরা রাখি, অপরিচ্ছন্ন রাখি। যেখানে-সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলি, মলমূত্র ত্যাগ করি। এতে আমাদের পরিবেশ নোংরা হয়, নষ্ট হয়। নোংরা পরিবেশ রোগব্যাধির আধার। আমাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠে। সালাত শুদ্ধ হওয়ার জন্য শরীর ও পোষাকের মত জায়গা বা পরিবেশও পবিত্র হওয়া একান্ত অপরিহার্য।
পরিবেশ পরিষ্কার না থাকলে শরীর ও পোষাক পরিচ্ছন্ন রাখা যায় না। আমাদের রাস্তা-ঘাট, যানবাহন, বাস স্টেশন, রেল স্টেশন, ফেরিঘাট ইত্যাদি জনাকীর্ণ স্থানগুলো এমন নোংরা থাকে যে ভাবতেও অবাক লাগে। পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন হলে আমরা অনেক রোগব্যাধি থেকে রেহাই পেতে পারি। আজকে চিকিৎসাবিজ্ঞান এ বিষয়গুলো বারবার জোর দিয়ে আমাদের অঙ্গুলি ইশারা করছে।
বলা বাহুল্য, পানি আমাদের পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শরীর ও পোষাক সাফ করার জন্য পাক পানি অপরিহার্য। পানি যাতে দূষিত ও অপবিত্র না হয় সেদিকে আমাদের সবার দৃষ্টি রাখা অবশ্য কর্তব্য। যে পানি দ্বারা মানুষ পাক-সাফ হয়, যে পানি মানুষ পান করে, আমরা অনেক সময় সে পানিতেই ময়লা আবর্জনা ফেলি, মলমূত্র ত্যাগ করি। এটা যে কত বড় অন্যায়, গুনাহ ও ক্ষতিকর তা কি আমরা ভেবে দেখি?
অবশ্যই আমাদেরকে এসব জনগুরুত্বপূর্ণ ও ধর্মীয় দায়িত্ব সম্পর্কীয় বিষয়টির প্রতি সচেষ্ট ও যত্নবান হতে হবে। এভাবেই আমরা ইহ-পরকালের কল্যাণপ্রাপ্ত হতে পারি।

লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট