চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘ছেলেধরা’ গুজব ও গণপিটুনিতে নিরীহ মানুষ হত্যা

মাহমুদ আহমদ

২৫ জুলাই, ২০১৯ | ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

‘পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে শিশুদের মাথা লাগবে’ গুজবের পর থেকে দুই সপ্তাহ ধরে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনায় সারাদেশে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অপরিচিত কাউকে দেখলেই বিচার-বিশ্লেষণ না করেই ‘ছেলেধরা’ অভিযোগ তুলে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। গত শনিবার (২০ জুলাই ২০১৯) ঢাকাসহ কয়েকটি এলাকায় একদিনেই নারীসহ ৪ জনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে সারাদেশে ২১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ জন ও আহত হয়েছেন ২২ জন। এমন পরিস্থিতিতে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে গণপিটুনিকে ‘ফৌজদারি অপরাধ’ উল্লেখ করে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি বার্তাও পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের সন্তানকে ভর্তি করাতে যাওয়া এক নারীকে ‘ছেলে ধরা’ সন্দেহে গণপিটুনি দেয়া হয়। পরে পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে ওই নারীকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। নিরীহ এই মায়ের নির্মম ও মর্মান্তিক মৃত্যুর সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। অবুঝ শিশু তুবার ভিডিও দেখলে দু’চোখের অশ্রু আটকিয়ে রাখা কষ্টকর। সংগ্রামী এই মার নাম তাসলিমা বেগম রেনু। বয়স ৪০ বছর। তিনি থাকতেন ঢাকার মহাখালীর ৩৩/৩ জিপি/জ ওয়্যারলেস গেটে। তার গ্রামের বাড়ি লক্ষীপুর জেলার রায়পুরে। এর আগে তিনি উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক স্কুলের পাশে আলী মোড় এলাকায় স্বামী তসলিম হোসেনের সঙ্গে পরিবার নিয়ে থাকতেন। গত দুই বছর আগে পারিবারিক কলহের কারণে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর থেকে সন্তানদের নিয়ে মহাখালীতে বসবাস করতেন রেনু। তার প্রতিটি দিন অতিবাহিত হত সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তিনি চেয়েছিলেন, বাবার অবর্তমানে সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করতে। ২০ জুলাই সকালে উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক স্কুলে সন্তানকে ভর্তির খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন তিনি। সকাল পৌনে ৮টার দিকে উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজার সড়কে ছেলেধরা সন্দেহে হুজুগে পড়ে রেনুকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে কতিপয় বিক্ষুব্ধ জনতা। তার বেঁচে থাকার আকুল আকুতিতে একটুও মন গলেনি পাষাণহৃদয় মানুষগুলোর। এই ঘটনায় ছেলেধরা গুজবে মানুষ নামে দানবের নিষ্ঠুরতায় মাকে হারালো অবুঝ শিশু তুবা। যে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় ছিলেন ওই মা সেই সন্তানের আগামীটা এখন হয়ে গেছে আরও বেশি অনিশ্চিত। তার মাকে কেন হত্যা করা হলো ছোট্ট তুবা যদি এমন প্রশ্ন করে কী জবাব দেবেন ওই হামলাকারীরা। একটি গুজব পাল্টে দিলো সব হিসেব-নিকেশ, কিছু মানুষের নিষ্ঠুরতা রক্তাক্ত করেছে স্নেহের আঁচল। যদিও ছোট্ট তুবা এখনও জানেই না যে মা নেই, মা আর ফিরে আসবে না কখনই। আর কখনোই জাপটে ধরবে না বুকের ভেতর, কিনে দেবে না রঙিন জামা ও হরেক খেলনা।
ভাবতে অবাক লাগে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত মানুষের তত্ত্বাবধানে যদি এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে, তবে আমাদের সমাজ কত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও গুজবে বিশ্বাসী, তা চিন্তা করে শিউরে উঠতে হয়। কেবল যে বর্তমানে ‘ছেলে ধরা’ সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা ঘটছে তাই নয়, মাঝে মাঝেই চোর, ডাকাত ও ছিনতাইকারী সন্দেহে বা অন্যান্য কারণেও গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা ঘটে। সামাজিক অস্থিরতা হঠাৎ করেই যেন প্রবলরূপ ধারণ করেছে। পারিবারিক সামাজিক অবক্ষয়জনিত একের পর বীভৎস ঘটনার সাক্ষীও হচ্ছে দেশ। হত্যা, ধর্ষণ, ইভটিজিং ও আত্মহননের মিছিলে বেরিয়ে পড়ছে সমাজের এবং নৈতিকতার বিপর্যয় এবং অধঃপতনের ভয়ানক চিত্র। প্রতিদিনই ঘটছে নানা অঘটন। সারাদেশে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও খুন, ধর্ষণ হচ্ছেই। সমাজ আজ এতটাই অবক্ষয়ে নিমজ্জিত যে, বাবা অথবা মা নিজের শিশু সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করছেন। বাবা অথবা মাও খুন হচ্ছেন সন্তানের হাতে। রাস্তা বা ডোবা থেকে উদ্ধার হচ্ছে তরুণীর খ-িত লাশ। এতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে সচেতন নাগরিক এমনকি জনসাধারণের মাঝে। ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পর বরগুনার রিফাত শরীফের হত্যাকা- বড় ধরনের আলোড়ন তুলল দেশে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার- শত শত লোকের সামনে রিফাতকে কুপিয়ে মারল সন্ত্রাসীরা, কেউ এগিয়ে এলো না তাকে বাঁচাতে। প্রাকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে আর আমরা দর্শকের ভূমিকা পালন করছি আর এখানে শতশত মানুষের সামনে একজন নিরীহ মার ওপর মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হল। আমরা কী ভাবতে পারি যে, সামাজিক অবক্ষয় কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে?
একের পর এক ঘটনা মূলত, আইনের প্রতি আস্থাহীনতা, গুজবে কান দেয়া এবং নৈতিক-সামাজিক অবক্ষয় থেকে মানুষ জীবিত আরেকজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যার মতো জঘন্য কাজ করতে পারে। এ ধরনের হত্যার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কাউকে দায়ী করতে না পারার সুযোগটি কাজে লাগায় অপরাধপ্রবণ লোকরা। এ অবস্থায় যে কোনো গুজবে কান দিয়ে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা বন্ধ করার জন্য সচেতনতা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে একটি গুজব ছড়ানো কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ। তিনি বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত যত নিহতের ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ প্রতিটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বলা হচ্ছে। কারণ কোনভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না।
আজ আমরা এতটাই অবক্ষয়ে জর্জরিত যে, বিবেকের যেন মৃত্যু ঘটেছে। যে দিকে তাকাই শুধু অস্থিরতা। মাত্র পৌনে এক ভরি স্বর্ণের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে হত্যা করা হলো পাঁচ ও ছয় বছর বয়সী দু’টি শিশুকে। এই শিশুহত্যার রহস্য উদঘাটনের মধ্যেই নরসিংদীতে ছয়, আট ও দশ বছর বয়সী তিন ভাই-বোনকে হত্যা করল আপন ভাই। অশান্তির জ্বালা মেটাতে মা অবুঝ শিশুকে শাড়ির সাথে বেঁধে ঝাঁপ দিচ্ছেন নদীতে। কুমিল্লায় দরজা আটকে এক গৃহবধূর হাত-পা বেঁধে গায়ে অকটেন ঢেলে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে পাষ- স্বামীর বিরুদ্ধে। নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক কলেজছাত্রীকে কুপিয়ে জখম করেছে এক বখাটে। স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় সাভারের সিরামিক্স বাজার এলাকায় গৃহবধূ ও তার স্বামীকে কুপিয়ে জখম করেছে বখাটেরা। একের পর এক মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিশেষ করে অসহায় শিশুদের ওপর দীর্ঘ দিন ধরে চলছে ভয়ঙ্কর নির্মমতার স্রােত। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে ৬৩০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ সময় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ নারীকে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ছয় মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
বর্তমানে যে সামাজিক ও পরিবেশগত অবস্থা তাতে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অশান্তি বাড়ছে। ফলে মানুষের মধ্যে চরম হতাশা কাজ করছে। আর এ হতাশা থেকে তার মধ্যে এক ধরনের আগ্রাসী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তির মধ্যে নেতিবাচক দিকগুলো ফুটে ওঠে। সে আত্মবিশ্বাসী হয় না। তার মধ্যে ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি কাজ করে। নৃশংস হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্যক্তি নিজে যেমন অন্যকে ধ্বংস করতে চায়, অন্যদিকে সে নিজেও এর শিকার হয়। এ ক্ষেত্রে শিশুরাই নৃশংসতার শিকার হয় বেশি। কারণ শিশুরা দুর্বল। তারা প্রতিবাদ করতে পারে না, প্রতিরোধও করতে পারে না। মূলত আমরা প্রতিনিয়ত যেসব পৈশাচিক আর হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি তা আসলে সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। এসব আমাদের অবক্ষয় আর সামাজিক সঙ্কটের চিত্র। অনেক ক্ষেত্রেই সবার অজান্তে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও অসাম্য বিস্তার লাভ করেছে ভয়াবহ আকারে।
অযথা গুজব ছড়িয়ে নিরীহ মানুষদেরকে হত্যার যে ব্যাধি শুরু হয়েছে এ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে। অপরিচিত কোনো নারী-পুরুষকে কোনো কারণে সন্দেহ হলে তাকে আটকে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়াই সচেতন নাগরিকদের দায়িত্ব। এ বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া দরকার অবিলম্বে। স্থানীয় থানা থেকে মাইকিংসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে এ ব্যাধি নিরাময়ের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া দরকার।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট