চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

পলিথিন দানবকে রুখতে হবে

চলমান জীবন

আবসার হাবীব

২৪ জুলাই, ২০১৯ | ১২:৫২ পূর্বাহ্ণ

আবার পলিথিন ……. কিছদিন সকলেই কাগজের ঠোঙা আর চটের থলে নিয়ে বাজারে ছুটেছিল। অভ্যস্তও হয়ে উঠেছিল। এখন আবার পলিথিন নিয়ে সকলে বাজারে ছুটছে। আইন করে আইনের প্রয়োগ না হলে যা হওয়ার তাই হলো। তারপরও কিছু সচেতন মানুষ পরিবেশের কথা ভেবে কাগজের ঠোঙা ব্যবহার করছে। পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও কিছু পলিথিন বাজারে ছিল, যেমন দু’টাকা দামের পলিথিন। সেই পলিথিনের হাত ধরে আবার পলিথিনের অনুপ্রবেশ ঘটে বাজারে। তরকারী, মাছের আর বাজেমালের দোকানে পলিথিনের ব্যবহার এখন আগেরই মতো। শুধু এই পলিথিনের ধরার কোনো সুবিধা রাখেনি। এই ব্যবধান দেখিয়ে পলিথিন আবার বাজার চেয়ে গেছে। এ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এটাও অতিসত্বর নির্মূল করা উচিত না হলে পলিথিন সমস্যা থেকে যাবে। পলিথিন যেহেতু পচনশীল না। যত দিন যাবে এ পলিথিনও আগের পলিথিনের জায়গা দখল করেছে।
এখনো কোনো কোনো বাজেমালের দোকান মালিক কাগজের ঠোঙা এবং বিপনি কেন্দ্রের কোনো কোনো দোকানে এখন দেখা যাচ্ছে চমৎকার সব ডিজাইনের শপিং ব্যাগ। দেখতেও ভালো লাগছে। তাও হয়তো অন্যের দেখা-দেখিতে বেশী দিন থাকবে না। পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে জাতীয় সংসদে যে আইন পাস হয়েছে, তার যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় কিংবা এ ব্যাপারে সংশিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো সচেতন না হওয়াতে পলিথিন আবার বাজার দখল করেছে। দেশের অন্যান্য আইনের মতো এই আইনেরও অপমৃত্যু ঘটেছে।
পলিথিন ব্যাগ কম দামী, ওজনে হালকা, সহজলভ্য, আর একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেয়া যায়। এসব কারণেই পলিথিন নাগরিক জীবনের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে ওঠে। মাছ, মাংস, আলু-পটল থেকে শুরু করে বই বহনেও পলিথিন ব্যবহৃত হয়। পলিথিনের তীব্র চাহিদার মুখে বিদায় নেয় চটের থলি, কাগজের ঠোঙা প্রভৃতি। ব্যক্তির এ পলিথিনপ্রীতি সমষ্টির জন্য ডেকে আনে ভয়ানক সর্বনাশ।
পলিথিন দানব ……. ‘পলিথিন দানবকে রুখতে হবে’ এই শিরোনামে দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে মাহবুব হোসেন ও এ. কে. আজাদ খান পলিথিনের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। হাতের নাগালের ভেতর থাকা এক পরিবেশ দানবের নাম পলিথিন। প্রতিদিনই আমরা পলিথিন ব্যবহার করছি। জেনে-না-জেনে বিপণœ করছি আমাদের পরিবেশ – বায়ু, মাটি, পানি। এ পলিথিন দানব ড্রেনেজ ব্যবস্থা, স্যুয়ারেজ লাইন অচল করে দিয়েছে। চলার পথের পাশে তৈরী করেছে ক্ষতিকর জাীবাণুর অসংখ্য ভাগাড়। খাদ্য করছে বিষাক্ত, ছড়িয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত নানা রোগ। প্রাণঘাতি ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার আবাসস্থলও তৈরী করেছে পলিথিন ব্যাগ। ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের ঝুঁকি তৈরী করেছে। পলিথিন পোড়ানোর সময় বাতাসে ভেসেছে কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড ও হাইড্রোজেন সায়ানাইড। এসব বিষের সমান। নিঃশ্বাসে গ্রহণ করছি আমরা। নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে রাজধানীতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে পরিবেশশত্রু পাতলা পলিথিন। এ উদ্যোগ আমাদের পরিবেশ রক্ষায় এক মাইল ফলক।
পলিথিন এবং রোগ-জীবাণু ……. বেসরকারী সংস্থা এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) নির্বাহী পরিচালক ড. হোসেন শাহরিয়ার বলেছেন, পলিথিন তৈরীর কারখানায় যারা কাজ করেন, তাদের ক্যান্সার ও চর্মরোগসহ অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধি হওয়ার আশংকা বেশী থাকে। কোরিয়ার ইনস্টিটিউট অব হেলথ রিসার্চ এর পলিথিন বিষয়ক এক গবেষণায় এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। মাছ, মাংস তরিতরকারী পলিথিন ব্যাগের মধ্যে বেঁধে রাখলে এক ধরনের তাপ উৎপাদিত হয়। এই তাপ থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। ফলে খাদ্যদ্রব্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। পলিথিনে মাছ ও মাংস প্যাকেট করে রাখা হলে এনারোবিক নামে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়। ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত খাদ্যদ্রব্য বহন করলে চর্মরোগ এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে পলিথিনে যে রং ব্যবহার করা হয়, তা খাদ্যে বিষক্রিয়া তৈরী করবে না, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ পলিথিনে ব্যবহৃত রং মোটেই পরীক্ষিত নয়। এ ধরনের রং স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা. শাশ্বতী রায় তার এক গবেষণায় বলেছেন, প্লাস্টিক বা পলিকাপে লেবু চা খেলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। কারণ গরম চা ও লেবুর সাইটিক এসিড সহজেই প্লাস্টিক বা পলিকাপের সঙ্গে মিলে স্বাভাবিক হজম প্রক্রিয়ায় বিঘœ সৃষ্টি করে। এতে আলসার ও ক্যান্সার রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। পলিথিন ব্যাগ ও অন্যান্য প্লাস্টিক জাতীয় আবর্জনা সাতশ’ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে পোড়ালে ডায়োক্সিন জাতীয় বিষ সৃষ্টি হয়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা মানুষের জন্মগত সমস্যা – একজিমা, ক্যান্সার ইত্যাদি মারাত্মক রোগের জন্য ডায়োক্সিনকে দায়ী করেন। তা ছাড়া বিষাক্ত হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাস নির্গত হয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে দীর্ঘদিন পলিব্যাগ ব্যবহারে ক্যান্সার ও চর্মরোগসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। এ ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায় যখন রুটি, বিস্কুট, আলুর চিপস এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য প্যাকেট করার কাজে পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে খাদ্যদ্রব্য প্যাকেট করা হয় এমন ধরনের প্লাস্টিক বা পলিথিন দিয়ে, যাতে খাদ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া না হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সে ধরনের পলিথিন উৎপাদিত হয় না এবং অধিকাংশ খাদ্য, বিস্কুট প্যাকেট করা হয় সাধারণ পলিথিন দিয়ে, যা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
অর্থনীতি ও পলিথিন ……. বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কর্মসূচী সংগঠক এবিএম সাইফুল ইসলাম তার এক নিবন্ধে বলেছেন, পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় পাটের/চটের ব্যাগের ব্যবহার একেবারেই কমে গেছে এবং দেশে পাটের উৎপাদনও আশংকাজনকভাবে কমে গেছে। ফলে পাটশিল্পে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক এবং পাট বা চটের ব্যাগ, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী, কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙা তৈরীর সঙ্গে জড়িত হাজার-হাজার দরিদ্র মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। এখন আবার তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে।
আর এক জরিপে দেখা গেছে, শহর এলাকায় প্রতিটি পরিবারকে কেনাকাটার কাজে দিনে গড়ে ৫টি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করতে হয়, যার মাসিক ব্যয় ১৫০ টাকা। অথচ এই ১৫০ টাকার কাজটিই মাত্র ১৫-২০ টাকার একটি পাট বা চটের ব্যাগের মাধ্যমে সম্ভব হতে পারে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শহরের প্রতিটি পরিবারে শুধু পলিথিন ব্যাগের জন্যই মাসিক অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে ১৫০ টাকা এবং বার্ষিক ১৮০০ টাকা। গ্রামাঞ্চলে পলিথিন ব্যাগের জন্য শহরের সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় না হলেও তার পরিমাণও নেহায়েত কম নয়। সার্বিকভাবে এ অর্থ এক ধরনের অপচয়, যা অর্থনীতিতে অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এখন হয় আমরা এ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবো।
আসুন, আমরা পলিথিন বর্জন করি ……. পলিথিন একটি অপচনশীল ক্ষতিকর দ্রব্য। অথচ আমরা প্রতিদিন চাল-ডাল, মাছ তরি-তরকারি, কাপড়-চোপড় আনা-নেয়াসহ নানা কাজে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করি। ব্যবহার শেষে তা ছুঁড়ে ফেলে দেই যেখানে সেখানে। এভাবে আমরা প্রতিদিন সারা দেশে কোটি কোটি পলিথিন ছুঁড়ে ফেলি। পরিত্যক্ত পলিথিন জমে জমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শহরে-বন্দরের নালা-নর্দমা ও পয়:নিস্কাশনের লাইন। ফলে পানি সরতে পারছে না। সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। আর এই আবদ্ধ পানিতে মশা-মাছি বংশ বিস্তার করছে। গ্রাম-গঞ্জের মাটিও পলিথিনে ঢেকে যাচ্ছে। পলিথিন পঁচে না। তাই, পলিথিন আছে এমন মাটিতে আর ফসল ফলে না। পলিথিনযুক্ত মাটি খুবই দুর্বল। এ মাটিতে দালান-কোঠা তৈরী করলে তা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। পুরোনো ও ব্যবহৃত পলিথিন ব্যাগ গলিয়ে পুনরায় তৈরী করা হয় কালো পলিথিন ব্যাগ। এ ছাড়াও তৈরী হয় নানা ধরনের প্লাস্টিকের দ্রব্যসামগ্রী, যেমন বাটি, গ্লাস, মগ ইত্যাদি। এগুলো ব্যবহার করাও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সুতরাং, আমরা আমাদের স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতি এবং পরিবেশের ওপর পলিথিন ব্যাগের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা ভেবে বন্ধ করি পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার।
আসুন, আমরা সকলে পলিথিন বর্জন করি। পলিথিনের পরিবর্তে কাগজ, চট, কাপড় বা পরিবেশ সম্মত যে কোনো উপকরণের তৈরী ব্যাগ ও অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী ব্যবহার করি। অন্যকেও পলিথিন ব্যাগ বর্জনে অনুপ্রাণিত করি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট