চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইনসাইড হেল

অদ্ভুত প্রাইভেট টিউশন

ফজলুল হক

২৩ জুলাই, ২০১৯ | ১:০৫ পূর্বাহ্ণ

খোলামেলা সংলাপ
আমার শিক্ষক হিসাবে চাকুরীজীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে চট্টগ্রাম সরকারী কমার্স কলেজে। প্রথম দফায় আমি এই কলেজে ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর অধ্যাপনা করি। আমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক ছিলাম। আমাদের বিভাগে আমার তিনজন সিনিয়র অধ্যাপক ছিলেন, উনারা তখন থেকেই খ্যাতিমান ছিলেন। আমি লেকচারার, আবদুর রহিম চৌধুরী স্যার, শায়েস্তা খান স্যার এবং বিনয় রতন বড়–য়া স্যার ছিলেন সহকারী অধ্যাপক। তিনজনই কৃতি অধ্যাপক। তিন জনের কাছে আমি অনেক কিছু শিখেছি, এই জন্য আমি উনাদের কাছে ঋণী। সরকারী কমার্স কলেজের প্রতি আমাদের একটা বিলংগিংনেস, ওননেস বা “নিজের কলেজ” মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। আমি সব সময় ভাবতাম এটা আমার নিজের কলেজ। এখন বুঝতে পারি, এরকম ভাবা ঠিক নয়। প্রকৃতি নিষ্ঠুর, সে আপনকে পর বানিয়ে দেয়।
রহিম স্যার আমাদের প্রিয় শিক্ষক। তিনি কমার্স কলেজের ছাত্র। আমাদের ধারণা ছিল সবসময় তিনি এখানেই থাকবেন। শায়েস্তা খান স্যার কমার্স কলেজের ছাত্র এবং এক সময়ের ছাত্রসংসদের নির্বাচিত ভিপি। তিনি ছিলেন কলেজের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রাণ। বিনয় রতন বড়–য়া এই কলেজের ছাত্র ছিলেন কিনা স্মরণ করতে পারছিনা, তবে স্যার এ কলেজের সকলের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। তখন আমার অনেক ছাত্রছাত্রী ছিল খুবই প্রিয়। মোহাম্মদ হোসেন লন্ডনে থাকে, কামাল হোসেন মিঠু আমেরিকায় থাকে, আবদুর রহিম আরসেনি থাকে সৌদি আরব এবং ইন্দোনিশিয়াতে তার শ^শুরবাড়ি, নিজাম উদ্দিন হাজারী এমপি, ওয়াসিকা আয়েশা খান এমপি ঢাকায়, মনোয়ার হোসেন ব্যারিস্টার লন্ডনে থাকে। আর কত বলব। এদের সকলের এবং আমারো গুরু ছিলেন রহিম স্যার, আমাদের প্রিয় শায়েস্তা খান স্যার। আমার ১/২ বছরের ছোট হলেও নুরুল ইসলাম আমার বন্ধু, তার ছেলে হীরা আমাদের ছাত্র ছিল, এখন ফ্লোরিডায় থাকে। আমাদের দুই গুরু রহিম স্যার এবং শায়েস্তা খান স্যার বেশ মজার মানুষ ছিলেন। উনাদের কারণে আমার কাছে চাকুরীজীবন উপভোগ্য মনে হতো। মুরুব্বী হিসাবে রহিম স্যার আমাকে বকাঝকা করতেন। আবার খুব ভালবাসতেন। পরে আমি লক্ষ্য করি, রহিম স্যার শুধু আমাকে না, সকলকে বকেন। উনার বকার স্টাইল আকর্ষণীয়। যেমন তিনি আমাদের সিনিয়র সহকর্মী ও উনার ছাত্র প্রিয় বর্ধনকে ডাকতেন হর্ষ বর্ধন। উনার এ ধরনের ঠাট্টা মাখা “গালি” “ধমক” শোনার জন্য আমরা উনার কাছে ঘন ঘন যেতাম। উনি যে কোন সময় যে কারো সম্পর্কে মজার মজার কমেন্ট করতেন। এগুলি ছিল এনজয়এবল। এখনো উনার জনপ্রিয়তা বয়স হয়ে যাওয়া পুরোনো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আছে। প্রবীন ছাত্রছাত্রীরা জানে, রহিম স্যার পেশাগত জীবনে যে হাস্যরসের ফোয়ারা বইয়ে দিতে পারতেন, সেটা আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
আমার দুই ছাত্রের কথা বলি, একজন হচ্ছে ইকবাল, সে পাহাড়তলী কলেজে অধ্যাপনা করত। কয়েক বছর আগে সে তার বাসায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হয়েছে। তার বাড়ি বাঁশখালীর সাধনপুর, জাকের মিয়ার বাড়ির পাশে। তার বাবা কমার্স কলেজে আসতেন এবং আমাদের সিরাজ স্যারের বন্ধু ছিলেন। আরেক ছাত্র হচ্ছে ড. সোলায়মান। সে এখন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। ঢাকায় থাকে। এই দুজন ছাত্র একাধিকবার আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়েছে। ড. সোলায়মানের বাড়ি কুমিরায়। তার বাবাও তার দাদীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। একদিন রহিম স্যার এবং আমাকে সোলায়মান কুমিরায় পৈত্রিক বাড়িতে নিয়ে মজার মজার পিঠা খাওয়ায়। সোলায়মান কমার্স কলেজে শিক্ষকতা করত। পরে সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে। তারপর সে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়। সোলায়মানের বিয়েতে আমি আমন্ত্রিত ছিলাম। ইকবাল তার বিয়েতেও আমাকে দাওয়াত করেছিল। এ দুজন আমার সন্তানের মতো ছিল। ইকবাল বল্ল, স্যার আপনাকে বাঁশখালী যেতেই হবে। তার বিয়ের খানার ব্যবস্থা ছিল দুপুরে। সে সম্ভবত কোন ছাত্রের কাছ থেকে আমাকে ও রহিম স্যারকে বহন করার জন্য গাড়ি নিয়েছিল। অন্যের গাড়িতে চড়া আমার অপছন্দ ছিল। কিন্তু তখন দেখেছি, অনেক শিক্ষক ছাত্রের কাছে গাড়ি চাইত। শিক্ষক ছাত্রের কাছে কোন কিছু চাওয়া রুচিকর ব্যাপার হতে পারেনা। ইকবাল বল্ল, গাড়ি বেলা দশটায় যাবে। রহিম স্যারের বাসায় গাড়ি পাঠাবে, আমি যেন স্যারের বাসায় থাকি। তখন আমি দারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে ছিলাম। আমার বাবা উনার বড় ভাইয়ের সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ এবং টিন কন্টেইনার ফ্যাক্টরী চালাতেন, উনাদের ব্যবসা বাণিজ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী অবাঙালী ব্যবসায়ীদের সাথে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার বাবার ও জেঠার ব্যবসায় ভাটা পড়ে। ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে কিছু মনোমালিন্যও তৈরী হয়। তখন আমি ও আমার স্ত্রী সন্তান এবং আমার আট ভাই বোন, আমার মা-বাবা সকলের দায় দায়িত্ব আমার উপর এসে পড়ে। আমার সীমিত আয়ের উপর পুরো পরিবার নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বহু বছর আমি ভাল খাবার খাইনি। ভাল কাপড় কিনিনি কিন্তু সেটা উনাদের বুঝতে দিইনি।
আমি নির্ধারিত দিনে ইকবালের বাড়িতে তার বিবাহের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য রহিম স্যারের বাসায় যাই। দশটায় আমরা ইকবালের পাঠানো গাড়িতে করে বাঁশখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। তখন বাঁশখালী যেতে হলে কালুরঘাটের ব্রীজ পার হতে হতো। পাঁচুরিয়া, মনসা হয়ে পটিয়া। রহিম স্যারের দুইটা শখ ছিল। (এক) গাড়িতে যাওয়ার সময় বাজার দেখলে গাড়ি থামাতেন। বাজার থেকে যা ভাল লাগে কিনতেন। আনারস, তরমুজ, শসা, সীমের বিচি, গুরা কচু প্রভৃতি কিনে তিনি গাড়ি ভর্তি করে ফেলেছেন। গাড়িটা পরের। (দুই) গাড়িতে রসালো আলাপ আলোচনা। সেদিন স্যার আলাপ করছিলেন বিনয় বড়–য়া স্যারকে নিয়ে। আমাকে বল্লেন, বড়–য়া কেমন পড়ায়? বড়–য়া এমন, বড়–য়া তেমন- স্যার সরল দিলে কথা বলে যাচ্ছেন। পটিয়া প্রপারে এসে গাড়ি থামে। আমাদেরকে কেরানী হাট, ডলু খাল, চুড়ামনি হয়ে যেতে হবে। অনেক পথ বাকী। ড্রাইভার বল্ল, গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছেনা। ইঞ্জিন নষ্ট। বলে ড্রাইভার চা খেতে চলে যায়। আমি মিস্ত্রি খোঁজার জন্য ছোটাছুটি করি। মিস্ত্রি পাচ্ছিনা। এক ঘণ্টা পর ড্রাইভার আসে। তাকে বল্লাম, তোমার ইঞ্জিন নষ্ট। তুমি স্টার্ট নেয়ার চেষ্টা করছনা কেন? সে বলে, আমি পারবনা। আমি ছোটাছুটি করছি। দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। তখন তো মোবাইল ছিলনা। রহিম স্যার তসবিহ বের করে দোয়া পড়ছেন। দুপুরে বিবাহের খানা জুটবেনা। আমি মরিয়া হয়ে ড্রাইভারকে বল্লাম, আপনি গাড়ি এখান থেকে নিবেন কীভাবে? সে বলে, আপনারা বাসে চলে যান। গাড়ি আমি নিতে পারব। তাহলে, স্যারের বাজার? সে বল্ল, স্যারের বাজার রাস্তায় ফেলে দেন। কি ত্যাড়া লোক। কিছুতেই কথায় আসছেনা।
আমি তাকে এক পাশে নিয়ে বল্লাম, তুমি রাগ করেছ? সে বলে, হ্যাঁ। কেন রাগ করেছ? সে বলে, আপনার স্যার বড়ুয়াদের গালি দিচ্ছে। আমি বলি, তোমার নাম কি? সে বলে, তপন বড়–য়া। খাইছে? এ বেটা বড়–য়া। কিন্তু স্যার তো বিনয় বড়–য়াকে নিয়ে ঠাট্টা করেছেন। বিনয় বড়–য়াকে “বিনয়” না বলে বড়–য়া বলায় ড্রাইভার ভেবেছে, স্যার বড়–য়া সম্প্রদায়কে গালি দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আমরা ইকবালের বিবাহে যাই। ইকবালের বাবা উনার পাহাড় থেকে আমাদের জন্য খাসি আনিয়ে তা জবাই করে আমাদের রাতের খাবারের এন্তেজাম করছেন। রাতের খাবারের রান্নাবান্নার কিছু তদারকি আমিও করি। ইকবালদের ঘরে এসে দেখি, রহিম স্যার গল্প বলে যাচ্ছেন, ড্রাইভার গালে হাত দিয়ে স্যারের বয়ান শুনছেন। আমি বলি, স্যার, কি করতেছেন? স্যার হেসে বল্লেন, বড়–য়ার সাথে গল্প করছি। আমি বলি, বড়–য়া বলবেননা, তপন বলেন। ন্যাড়া বেল তলায় কয়বার যায়?
তার কয়েক বছর পর আমি সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে চাটগাঁর পাশ্ববর্তী এক সরকারী কলেজে যোগদান করি। তখন শহরের বহু নাম করা অধ্যাপক শহর থেকে ৪০ মাইল দূরে ওই কলেজে শহর থেকে বদলি হয়ে এসেছেন। কালুরঘাট পুল পার হয়ে তখন প্রতিদিন সে কলেজে যাতায়াত করা কঠিন ছিল। কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন নুরুল আবছার খান। তিনি আমাকে রিলিজ করতে চাচ্ছিলেন না। তবুও আমাকে যোগদান করতে হলো। আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। প্রথম পিরিয়ডে ক্লাস থাকলে কি করে নেব? তখন আমার বিভাগের লেকচারার সেকান্দার সাহেব আমাকে বল্লেন, স্যার, আমি প্রতিদিন ৭টায় কলেজে আসি। ঘোরাঘুরিতে থাকি। যদি আমি দেখি যে আপনি আসেন নাই- আপনার ক্লাস আমি নিয়া নেব। ভেরী গুড এ্যারেঞ্জমেন্ট। আমি সেকান্দার সাহেবের উপর খুব বেশী খুশী। আমার কোন কারণে আসতে দেরী হলে ক্লাস ম্যানেজ হয়ে যায়। পরে দেখলাম, আমি না আসলে শুধু সেকান্দর নয়, একাউন্টিং এর শফি সাহেব, অর্থনীতির তাহের সাহেব আমার ক্লাস নেন। আমি তো ভাবি এরা তো খুব হেল্পফুল? হায়, হায়- এমন দরদী বন্ধু কোথায় লুকাইয়া ছিল?
পরে জানলাম অন্য কথা। ওই এলাকা তখন গ্রাম। দূর-দুরান্তের ছাত্রছাত্রীরা বিকালে বাড়ি চলে যায়। শিক্ষকরা ক্লাস টাইমে প্রাইভেট পড়ান। একটা ক্লাসের সকল অথবা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৩০০/- টাকা করে সাবজেক্ট টিচার নেন। যারা অর্থনীতি পড়বে তারা অর্থনীতির শিক্ষককে টাকা দেয়, যারা ইংরেজি পড়বে তারা টাকা দেয় ইংরেজির শিক্ষককে। যখন কোন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকেন ওই ক্লাসে নেয়া হয় প্রাইভেট পড়ানোর ক্লাস। এরকম অদ্ভুত প্রাইভেট টিউশনের কথা আর শুনিনি। কলেজ চলছে। ক্লাসের ফাঁকে চলছে, প্রাইভেট টিউশন। বাহির থেকে কেউ কিছু বুঝবেনা। এখন ভাবি পবিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আমরা ‘হেল’ বানাতে পারি।

লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট