চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

হালদা: চাই দখল ও দূষণমুক্তকরণে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ

জহিরুদ্দীন মো. ইমরুল কায়েস

২২ জুলাই, ২০১৯ | ১২:৩৬ পূর্বাহ্ণ

ঐশ্বর্যময়ী নদী হালদা। তাছাড়া এটি কমনীয় নদী। সুমিষ্ট নদী। বহমান নদী। চলমান নদী। প্রাণের নদী। পাড়ের দুকুল সবুজে আচ্ছাদিত গাছের ঢালে বসা অসংখ্য পক্ষির তৃষ্ণা নিবারণের আকাক্সিক্ষত নদী। বাতাবরণের নদী। শস্য ক্ষেতের প্রাণ সঞ্চালনের নদী। পাহাড়ি লতা গুল্মের চঞ্চলতা প্রকাশের নদী। রুই কাতলা মৃগেলসহ অগণিত মৎস্যের বসবাসের নদী। এশিয়ায় কার্প জাতীয় মৎস্যের ডিম প্রজনন উপযোগী একমাত্র নদী। হালদার গুণ আর উপযোগিতার যেন শেষ নেই। তবে, হালদার আর সে সুদিন নেই। হালদার সে সোনালী দিনগুলো এখন অতীত। হালদা এখন দিন দিন কুৎসিত হয়ে যাচ্ছে।
অকাতরে যে হালদা শত শত বছরব্যাপী প্রকৃতির জীব-বৈচিত্র্য প্রেমে সঁপে দিয়েছে সে নদীকে আমরা নিষ্ঠুর অত্যাচার করে বিষাক্ত করে তুলেছি। অত্যাচারে অত্যাচারে এ নদীর অক্সিজেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। হালদা আর হালদা নাই। এভাবে চলতে থাকলে কেবল হালদা নদী নয় – হালদার অববাহিকায় গড়ে উঠা সভ্যতা-সংস্কৃতির ও নিষ্ঠুর বিলুপ্তি ঘটবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানিকছড়ির বাটনাতলী এলাকার হালদার উৎপত্তি। উক্ত জায়গা থেকে কর্ণফুলী মোহনা পর্যন্ত হালদার দৈর্ঘ্য ১০৬ কি.মি.। পুরো এলাকার প্রায় সকল অংশেই হালদা জীবনসংহারের শিকার। এভাবে আঘাতে আঘাতে হালদা হয়তো একদিন বুড়িগঙ্গা নদীর মতোই অবস্থা হবে। হালদার উৎপত্তি স্থলে ব্যাপক তামাকের চাষ হয়। তামাকের বর্জ্য ও তামাকে ব্যবহৃত সার কীটনাশক সরাসরি গিয়ে পড়ে হালদাতে। মানিকছড়ি, যোগ্যাছোলা, রামগড়ে হালদার পাদদেশে কয়েকশ একর জমিতে বেশ কয়েক বছর ধরে তামাকের চাষ হচ্ছে। এসব এলাকাতে তামাকের মূল এবং তামাকের পাতা নদীতে পড়ে। এতে নদীর ব্যাপক দূষণ হয়। বর্ষা শুরুর প্রাক্কালে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে তামাকের পঁচা পাতা, উচ্ছিষ্টগুলো নদীতে মিশে পানিকে বিষাক্ত করছে। এ দূষণ শুরু হয় মাছের ডিম প্রজননের সময়। আর কোথাও দূষিত হচ্ছে শিল্প, আবাসিক, ট্যানারীর বর্জ্য।ে কোথাও দূষিত হচ্ছে নদীর পাড়ে গড়ে উঠা ইট ভাটার বর্জ্য।ে হালদার ফটিকছড়ি অংশে চা বাগানের জন্য পানি যোগান দান কালেও হালদার পানি দূষিত হয়।
নদীর উজান অংশে রাবার ড্যাম নির্মাণের ফলে নদীর ভাটির অংশে পানি অপ্রতুলতা হেতু পানি দূষিত হচ্ছে। তবে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে হাটহাজারীর নন্দীরহাট পর্যন্ত নদীর কাছে গড়ে উঠা বহু শিল্প কলকারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্যই নদীর পানিকে বিষাক্ত করার জন্য সিংহ ভাগ দায়ী। অভিযোগ আছে এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের অনেকেই ইটিপি সক্রিয় রাখেন না। দীর্ঘ ২৫ কি.মি. জুড়ে গড়ে উঠা কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠানের অবিরাম তরল দূষণে হালদার নদী অপেয় হয়ে উঠেছে। শীতলক্ষা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী নদী যেভাবে দূষিত হয়ে মাছদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, হালদাকেও শিল্প-বর্জ্যরে হাত থেকে বাঁচাতে না পারলে ঐসব নদীর মতোই নিষ্প্রাণ নদীতে পরিণত হবে। নদী মাতৃক দেশে নদীই যেখানে বাংলাদেশের প্রাণ সেখানে একে একে সকল নদ-নদী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়া বেশ দুঃখজনক। ফসলাদীতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক-বালাইনাশক ঔষধ ব্যবহার করার কারণেও পানির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। হালদা নদীর পানিতে পাওয়া যাচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত অ্যামোনিয়া। কমছে অক্সিজেন। এটা খুব উদ্বেগজনক যে, অপরিশোধিত ফার্নেস অয়েল বিভিন্ন ড্রেন, খাল ও ছড়ার মাধ্যমে হালদার পানিতে মিশ্রিত হচ্ছে। গত বছর বর্ষায় এরকম বিভিন্ন শিল্পের বর্জ্য হালদাতে মিশ্রিত হয়ে এ নদীর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। ডলফিন এবং অগণিত কার্প জাতীয় মাছ মারা গিয়েছিল। গতবারের মতো পরিস্থিতি এবারও হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অসাধু ব্যবসায়ী/শিল্পের উদ্যোক্তারা গচ্ছিত বিষাক্ত তরল পদার্থগুলো বর্ষার পানির সঙ্গে ড্রেনআউট করে। আর এগুলো বিভিন্ন খাল-বিল হয়ে হালদায় পতিত হয়। এভাবে হালদার পানি ক্রমান্বয়ে দূষিত হচ্ছে।
১৯৫৭ সালে বৃটেনের বায়োলজিক্যাল বিভাগ লন্ডনের টেমস্ নদীকে মৃত ঘোষণা করেছিল। লন্ডন ব্রিজের আশে পাশের কয়েক মাইলজুড়ে পানিতে অক্সিজেনের অস্থিত্ব ছিল না। সে টেমস্ নদী এখন পুরোটাই জীবন্ত। বিগত ত্রিশ বছর টেমস্ নদীতে শীল, তিমি, ডলফিন, শুশুক, বক, পানকৌড়িসহ বিভিন্ন প্রাণির নিরাপদ আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। জার্মানীর বন শহরের রাইন নদীও প্রচ- দূষণের কবলে পড়ে অনেকদিন ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল। কিন্তু রাইন এখন দূষণ মুক্ত। মানুষ দিব্যি রাইন নদীতে সাঁতার কাটছে। মৎস্য ও জীব-বৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে রাইনের পানি। মস্কোর মস্কভা নদীর অবস্থাও বেশ ভালোর দিকে। বিগত পাঁচ বছরে এ নদীর টক্সিক দূষণ অনেকাংশে কমেছে। নিউইয়র্কের হাডসন নদীও ব্যাপক দূষণে কবলিত ছিল। দৈনিক ৩০০ মিলিয়ন গ্যালনের মতো বিষাক্ত পানি হাডসন নদীতে গিয়ে পড়ত। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সুয়ারেজ ট্রিটমেন্টে প্ল্যান্ট বসিয়ে হাডসনের পানিকে নিরাপদ করেছেন। বর্তমানে হাডসনের পানিতে সাতাশ প্রজাতির হাজার হাজার মাছের বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। ফ্রান্সের সেইন নদীও ছিল ততৈবচ। বর্তমানে সেইনে স্যামন ফিস বিচরণ করে। ২০২৪ সালে সেইন নদীকে সাঁতার কাটার জন্য উন্মুক্ত করা হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে বিশ্বের অনেক নদী দূষণ মুক্ত হয়েছে। আর আমাদের দূষণ মুক্ত নদীগুলোকে আমরা জেনে শুনে দূষিত করছি।
এটা মনে রাখা দরকার শিল্পায়ন এবং দূষণ একে অপরের পরিপূরক নয়। বরং পরিপূর্ণ শিল্পায়ন করলে পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং পানির ক্ষতির কোন সম্ভাবনা থাকে না। অপরিপূর্ণ শিল্প কারখানাগুলো শুধু পরিবেশকে সমুন্নত রাখতে অগ্রাহ্য করে। দূষণ ছড়ানো কারখানাগুলো আসলে অপরিপূর্ণ কারখানা। এসব শিল্প দেশের উন্নয়নে সহায়ক নয়। বিশেষ করে নদীর সন্নিকটে গড়ে উঠা পেপার মিলের সঠিক ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট না থাকলে পানির ভয়ংকর ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। আসুন, আমরা সকলে সজাগ হয়ে ¯্রষ্টার অপরিসীম দান হালদাকে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত করি। অমিয় খাদ্য তৈরির মহাকারখানা চিরসবুজ হালদাকে আমরা কখনো নির্জীব হতে দিতে পারি না।

লেখক : প্রাবন্ধিক, পরিবেশকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট