চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ই-পাসপোর্টে বয়স্কদের প্রতি বৈষম্য কেন?

আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী

১৭ অক্টোবর, ২০২১ | ৯:৪০ অপরাহ্ণ

একটি পাসপোর্টের লিখিত মেয়াদ যত দিনই হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তা থেকে বাদ যায় শেষের ছয় মাস। প্রায় বেশির ভাগ দেশে যাওয়ার সময় পাসপোর্টের মেয়াদ কমপক্ষে ছয় মাস অবশিষ্ট থাকতে হয়। সে কারণে ৫ বছর মেয়াদি পাসপোর্টের প্রকৃত মেয়াদকাল সাড়ে ৪ বছর আর ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্টের প্রকৃত মেয়াদকাল সাড়ে ৯ বছর।

আমাদের দেশে এ যাবত্কাল ৫ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট চালু থাকলেও সদ্য চালুকৃত ই-পাসপোর্টে এই মেয়াদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সিদের পাসপোর্টের মেয়াদ ইস্যুর তারিখ থেকে দাখিলকৃত ফির ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ১০ বছর করা হয়েছে। ১৮-এর কম বয়সি ও ৬৫-এর অধিক বয়সিদের পাসপোর্টের মেয়াদ নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে ৫ বছরেই।

পাসপোর্ট এখন অনেকের জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। সারা পৃথিবীতে পাসপোর্টের চাহিদা ও ব্যবহার উভয়ই বেড়েছে। চাপ বেড়েছে সব দেশেরই পাসপোর্ট অফিসগুলোর ওপর। ভোক্তার চাহিদা মেটানো ছাড়াও পাসপোর্ট অফিসগুলোর কাজের চাপ কমাতে পৃথিবীর প্রায় দেশই একটি সহজ সমাধান হিসেবে বাড়িয়েছে পাসপোর্টের মেয়াদ। পৃথিবীর অনেক দেশই এখন প্রাপ্তবয়স্কদের পাসপোর্টের মেয়াদ করেছে ১০ বছর। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় প্রাপ্তবয়স্কদের পাসপোর্টের মেয়াদ ১০ বছর, পাকিস্তানে প্রাপ্তবয়স্করা ৫ বা ১০ বছর যে কোনো মেয়াদি পাসপোর্ট নিতে পারেন প্রদেয় ফির ভিত্তিতে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় প্রাপ্তবয়স্কদের পাসপোর্টের মেয়াদ ১০ বছর। জার্মানিতে ২৪ বছরের ওপরের বয়সিদের জন্য মেয়াদ ১০ বছর আর তার কম বয়সিদের মেয়াদ ৫ বছর। যেসব দেশে পাসপোর্টের মেয়াদ প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পৃথক করা হয়েছে, যেখানে অপ্রাপ্তবয়স্ক একেক দেশে একেক রকম ধরা হয়েছে। ১০, ১২, ১৪, ১৬, ১৮, ২৪ এমনকি ৩০ বছর পর্যন্তও কোনো কোনো দেশে ৫ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট দিয়ে পরবর্তী বয়সিদের জন্য ১০ বছর মেয়াদি করা হয়েছে।

পাসপোর্টের মেয়াদ বাংলাদেশও বাড়িয়েছে, তবে ব্যতিক্রমীভাবে ৬৫ বছর ঊর্ধ্ব বয়সিদের পাসপোর্টের মেয়াদ ১০ নয়, ৫ বছরেই থিতু রেখেছে। যুক্তি হচ্ছে, বৃদ্ধদের দ্রুত চেহারার আকার বদলায়। বৃদ্ধদের চেহারায় হয়তো পরিবর্তন আসে, কিন্তু ই-পাসপোর্ট তো আগের মতো হাতে লেখা পাসপোর্ট নয় যে শুধু ছবি দেখে পাসপোর্টধারীকে শনাক্ত করতে হবে। একচল্লিশটি ভিন্ন জৈবিক তথ্য সংবলিত নিরাপত্তা বৈশিষ্ট যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের পাসপোর্টে। হাতে লেখা পাসপোর্ট একসময় প্রায়ই জাল হতো। একজনের পাসপোর্টের ছবি বদলে অর্থাত্ গলাকাটা পাসপোর্টে অন্য কেউ ভ্রমণের কথা বেশ শোনা যেত। কিন্তু ই-পাসপোর্টে নানা ধরনের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য যুক্ত হওয়ায় কোনো ক্রমেই একজনেরটি অন্যজন দ্বারা ব্যবহূত হওয়ার সুযোগ নেই।

যে কুযুক্তিতে ৬৫ ঊর্ধ্বদের পাসপোর্টের মেয়াদ ১০ বছর করা হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, আপাতদৃষ্টিতে একজন বয়স্ক ব্যক্তির পাসপোর্টে গ্রন্থিত ছবির সঙ্গে বাস্তব চেহারার তারতম্য হলেও সব জৈবিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আসতে পারে না। আর পারে না বলেই পৃথিবীর প্রায় সব দেশই প্রাপ্তবয়স্কদের পাসপোর্টের মেয়াদ ১০ বছর করেছে। বয়সজনিত কারণেই ৬৫ ঊর্ধ্ব বয়সিদের অহরহ হয়তো বিদেশে যাওয়া হয় না, সেই একই কারণে বয়স বেড়ে যাওয়ার পর পাঁচ বছর অন্তর পাসপোর্ট অফিসে আসাও কম ঝক্কি নয়। পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়েই বয়স্ক যারা প্রবাসে থাকেন, তারা থাকেন তটস্থ। এই ভয়ের থেকে প্রবীণদের নিষ্কৃতি দিতে স্পেনে ৭০ বছর ঊর্ধ্ব বয়সিদের পাসপোর্টের মেয়াদ অফুরান করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৫৯ বছর, অন্যদিকে স্পেনের মানুষের গড় আয়ু ৮৩ দশমিক ৪৯ বছর।

মেয়াদ ও বইয়ের পাতার সংখ্যার ভিত্তিতে সম্প্রতি চালুকৃত ই-পাসপোর্টের ফি নির্ধারিত হয়েছে। ১৮ থেকে ৬৫-এর কম বয়সি একজন নাগরিক কম ফি দিয়ে ৫ বছর মেয়াদি ৪৮ পাতার পাসপোর্ট পেতে পারেন। তিনি ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট পেতে হলেও সর্বোচ্চ ফি দিলে ৬৪ পাতার বই পাবেন, আবার একটু কম ফি দিলে ১০ বছর মেয়াদি ৪৮ পাতার বইও পেতে পারেন। তেমনি ৫ বছর মেয়াদে ৬৪ পাতারও বই পেতে পারেন প্রয়োজনীয় ফি দাখিল করে। যদি ফির তারতম্যের ওপর ভিত্তি করে কম বয়সিরা ৫ বা ১০ বছর মেয়াদি ৪৮ বা ৬৪ পাতার পাসপোর্ট বই পেতে পারেন, তাহলে সংবিধানের ১৯ (১) অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে একজন ৬৫ বছর ঊর্ধ্ব ব্যক্তিরও বাছাই করার অধিকার থাকতে হবে ৫ বা ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট নেওয়ার।

পাসপোর্টের মেয়াদ পূর্বের ৫ বছরের স্থলে বর্তমানে ১০ বছর করায় তা জনসাধারণের সুযোগ বৃদ্ধি হয়েছে। সংবিধানের ১৯ (১) অনুচ্ছেদে সুযোগের সমতা শিরোনামের বর্ণনা ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’ বহাল থাকা সত্ত্বেও ৬৫ ঊর্ধ্বদের পাসপোর্টের মেয়াদ ৫ বছরে নির্দিষ্ট করায় সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ৬৫ ঊর্ধ্ব বয়সি মানুষের শতকরা হার ৫ দশমিক ১৮ ভাগ। এই হার গত কয়েক বছর ধরে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে সুযোগের সমতা থেকে বঞ্চিত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে অন্যায় করা হচ্ছে। সংবিধানের সুযোগের সমতা সবার প্রতি সমভাবে ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশের পাসপোর্ট ৬৫ ঊর্ধ্ব ব্যক্তিদের জন্য ফি দাখিলের ভিত্তিতে কেবল ৫ বছরের পরিবর্তে ৫/১০ বছর এবং পাসপোর্ট বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যাও তাদের চাহিদা মোতাবেক ৪৮/৬৪ পাতার করা হোক। আইনের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য আইন। সমাজের প্রবীণ নাগরিকের জন্য নিশ্চিত হোক সংবিধানে বর্ণিত সুযোগের সমতা। সূত্র: ইত্তেফাক।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

পূর্বকোণ/মামুন/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট