চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রাজনীতির জহুরী জহুর আহমদ চৌধুরী

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

১ জুলাই, ২০১৯ | ১২:৩৫ পূর্বাহ্ণ

জহুর আহমদ চৌধুরী রাজনীতির পাকা জহুরী ছিলেন। তিনি রাজনীতি বুঝতেন, জানতেন; তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন রাজনীতিতে, রাজনীতিও তাঁকে উজাড় করে দিয়েছিলো। তাঁর কোন পিছুটান ছিলো না। যেমন পকেট হাতড়ে দেখতেন টাকা-পয়সা আছে কিনা। থাকলে সে টাকা কিভাবে অন্যকে দিয়ে পকেট খালি করে ফেলবেন সেজন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। রাজনীতিও যখন করতেন, সামনেটাই দেখতেন, পেছনটা দেখতেন না, কারণ পেছনে তো তাঁর কিছু নেই। না কোন বন্ধন, না কোন সঞ্চয়। তিনি বর্তমানপন্থী ছিলেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেন না। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে উদ্বেগাকুল হতেন না। তাই ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চিত রাখতেন না।
পিজি হাসপাতালের কেবিনে যখন তাঁর বুকের খাঁচা থেকে শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গিয়েছিলো, তখন তাঁর পদতলে বসা মহিউদ্দিন চৌধুরী (সাবেক মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি আলহাজ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী) বুকফাটা আর্তনাদ আর কান্নাকাটির পর যে পুরাতন ব্রিফকেসটি সেখানে পেয়েছিলেন, তাতে একশ বা দুইশ টাকা ছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চার চারটি মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী মন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরীর আর কোন টাকা-পয়সা বা ধন সম্পদ ছিলো না। ঢাকা-চট্টগ্রামেও কোথাও পাওয়া যায় নি। তাঁর নিজের বাড়িও ছিলো না, বাড়িভিটাও ছিলা না। চট্টগ্রামে দামপাড়া পল্টন রোডে যে বাড়িতে থাকতেন, সেটি তাঁর স্ত্রীকে প্রদত্ত তাঁর শ্বশুরের উপহার। তাঁর মতো এমন নিষ্কাম, নির্মোহ, সর্বস্বত্যাগী যোগী গৃহী মানুষের মধ্যে একান্তই দুর্লভ। প্রাচীনকালে হিমালয়ে কিংবা পাহাড়ে-জঙ্গলে নির্জনে ধ্যানমগ্ন মুনি ঋষিরা এমন যোগী হতেন। মুসলমানদের মধ্যেও মধ্যযুগে ও প্রাগাধুনিক যুগে এমন সর্বস্বত্যাগী অলি-দরবেশদের পাওযা যেতো। রাজনীতিবিদরা ঘর সংসার করেন, তাদের মধ্যে তো এমন ত্যাগের তুলনা বিরল। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীও এমন ত্যাগী নেতা ছিলেন। তাঁরা অকাতরে মানুষকে সাহায্য করতেন। হাতে টাকা-পয়সা না থাকলে কাউকে সাহায্য করার জন্য একটি মামলা হাতে নিয়ে যা’ ফি পেতেন তা’ ঐ সাহায্যপ্রার্থীকে দিয়ে দিতেন। মামলাও না পেলে ধার করে সাহায্য করতেন।
মুক্তিযুদ্ধে তিনি কোরবাণী দিয়েছেন আপন সন্তানকে, যে ছিলো তাঁর প্রথম সন্তান-সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী। পাঞ্জাবীরা তাঁর ঘরবাড়ি লুট করে তারপর গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিয়েছিলো।
এই সর্বস্ব ত্যাগের বিনিময়ে জহুর আহমদ চৌধুরী যা’ পেয়েছেন, তা’ আর কেউ পান নি বাংলাদেশে, এমনকি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুও নন। জহুর আহমদ চৌধুরী রাজনীতি থেকে যা’ পেয়েছেন তার হিসাবটা নেওয়া যাক। ১৯৫২ সালে জীবনের প্রথম নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। সেটা ছিলো পৌরসভার কমিশনার নির্বাচন। প্রতিদ্বন্দ্বী তৎকালীন চট্টগ্রামের শ্রেষ্ঠ ধনী, রেয়াজুদ্দিন বাজারের মালিক শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকী। সেই অসম নির্বাচনেও জহুর আহমদ চৌধুরী জয়লাভ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। বাঙলার রাজধানী তখন কলকাতা, চট্টগ্রাম পৌরসভার একটি ওয়ার্ডের নির্বাচন সেখানেও তুমুল হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলো। স্টেটসম্যান পত্রিকা সংবাদটি পরিবেশন করলো একটি মন্তব্য যোগ করে “মক্ষিকার কাছে হস্তীর পরাজয়।”
৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে রফিক মিয়াকে আবারো হারালেন জহুর আহমদ চৌধুরী। ষাটের দশকে পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের অনেকগুলো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হয়েছে। চট্টগ্রামে এসব সর্বদলীয় আন্দোলনে সাধারণত জহুর আহমদ চৌধুরীই হতেন আহবায়ক বা সভাপতি। মনে রাখতে হবে তখন নবী চৌধুরী, আজিজ মিয়া, আবুল কাশেম সাবজজ, গোরা আজিজ, রফিক মিয়া সক্রিয় না থাকলেও তাঁর পুত্র মঞ্জু মিঞা (ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী) এসে গেছেন রাজনীতিতে। এরাই তখন চট্টগ্রামে বিরোধী দলের বড় নেতা। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সবাই জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বই মেনে নিতেন।
সত্তরের নির্বাচনে এমএ আজিজ এমএনএ এবং জহুর আহমদ চৌধুরী এমপিএ নির্বাচিত হলেন। কিন্তু এমএ আজিজ আকস্মিকভাবে ১১ জানুয়ারি ’৭১ মারা গেলেন। এম এ আজিজকে দাফন করে এসে রেস্ট হাউসে বসে জহুর আহমদ চৌধুরী কেঁদে কেঁদে নিজে নিজে বলছেন-“আজিজ, আল্লাহর একি বিচার, তুই কোনদিন পার্লামেন্টে যেতে পারলি না। ৫৪ তে নমিনেশন পেলি না, স্বতন্ত্র নির্বাচন করে সামান্য ভোটে হেরে গেলি। এবার জিতলি, কিন্তু পার্লামেন্ট বসার আগেই আল্লাহ তোকে নিয়ে গেল”।
অবশ্য সেই পার্লামেন্ট আর বসে নি। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই পার্লামেন্ট গঠন করে প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলো।
বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ ’৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। কিন্তু সে ঘোষণা দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য পাঠালেন চট্টগ্রামে তাঁর বন্ধু জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে। সেটা প্রচারের ব্যবস্থা করে জহুর আহমদ চৌধুরী দৌঁড়ালেন সীমান্তের উদ্দেশ্যে। তিনি এমআর সিদ্দিকী ও আবদুল্লাহ আল হারুনকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে পৌঁছে গেলেন সবার আগে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের মাধ্যমে দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছে দিলেন বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর। তখনো তাজউদ্দিন ভারতে যান নি। ম্যাডাম গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য এম আর সিদ্দিকীকে পাঠিয়ে দিলেন দিল্লিতে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীই নিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁরা যখন দিল্লির সাউথ ব্লকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পৌঁছলেন ২ এপ্রিল, তখন সেখানে তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামও পৌঁছে গেছেন। এম আর সিদ্দিকী যখন সেটা জানতে পারলেন, তখন তিনি ভাবলেন, দলের সাধারণ সম্পাদক যখন এসেছেন, তখন তাঁরই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসা সঙ্গত। সেকথা মুখে বলে তিনি চলে এলেন আগরতলায়।
ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে জহুর আহমদ চৌধুরী ত্রিপুরায় মুক্তিযোদ্ধা ও শারণার্থীদের আশ্রয়, ট্রেনিং ও অস্ত্র শস্ত্র প্রদানের জন্য যে বন্দোবস্ত করেছিলেন, তারই ফলে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের মধ্যে অন্তত ৬টির হেডকোয়ার্টার ত্রিপুরায় স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিলো। ত্রিপুরায় বসে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লার এমএনএ ও এমপিএরা ভোটাভুটি করে জহুর আহমদ চৌধুরীকে ইস্টার্ন লিবারেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছিলেন।
জহুর আহমদ চৌধুরী অধিকৃত দেশ থেকে যেমন প্রথম ভারতে গিয়েছিলেন, তেমনি মুক্ত স্বদেশেও প্রত্যাবর্তন সবার আগেই করেছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর কসবা ম্ক্তু হলে তিনি বাংলাদেশে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন এবং মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। ভারতীয় বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় কিভাবে যেন তিনি ঢাকায়ও আগে পৌঁছে যান ১৬ ডিসেম্বর সকালে। তিনি যখন ঢাকায় বিজয়ের পতাকা উত্তোলিত করেন এবং ঢাকা রেডিও থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন, তখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনী আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করেনি।
দেশে ফেরার কয়েকদিনের মধ্যেই তাজউদ্দীন তাঁকে মন্ত্রিসভায় নিয়ে নেন। ১০ জানুয়ারি ’৭২ বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর প্রথমে রাষ্ট্রপতি ও পরে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যে ক্যাবিনেট গঠন করেন, তাতে তিনি জহুর আহমদ চৌধুরীকে চারটি মন্ত্রণালয়য়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
মৃত্যুতেও জহুর আহমদ চৌধুরী কত মহান। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছেন। তাঁর জানাজায় সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে নিয়ে অংশগ্রহণ করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু। তিনি প্যারেড ময়দান থেকে খাটিয়া কাঁধে করে বহন করে দামপাড়া পল্টন রোডে নিয়ে আসেন। এবং দাফন অনুষ্ঠান তদারক করেন। জিয়াউর রহমান গার্ড অব অনার অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এবং কবরে নেমে মাটি দেন।
বঙ্গবন্ধুর কথা দিয়ে লেখা শেষ করি। জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর সংসদে আনীত শোক প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশগ্রহণ করে সংসদ নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন-
“তাঁর একটা গুনের ইতিহাস আছে। তিনি যা কিছু উপার্জন করতেন না গরীবদের খাইয়ে দিতেন। আজকাল এটা একটা ‘ফ্যাশন হয়ে গেছে, মন্ত্রী হলেই তাঁর উপর বদনামী এসে যায়। আজ এটা প্রমাণ হয়ে যাক। দেখুন বাঙলাদেশের মানুষ যে, মন্ত্রী হলেই তাঁর বদনাম হয় না। জহুর আহমদ চৌধুরীই দিকে চেয়ে দেখুক। তাঁর চাওয়া পাওয়ার কিছুই নাই। তারা খোঁজ করে দেখুক জহুর আহমদ চৌধুরীর ছেলেপিলের খাওয়ার পয়সা পর্যন্ত নাই। এটা আজকাল আমাদের দেশের একটা ‘ফ্যাশন’ যে, আমরা নিজেদের সমালোচনা করে নিজেদের সর্বনাশ করি। দেখুন তার ছেলেপিলের দিকে তাকিয়ে। কি করে যে তারা বাঁচবে, সে চিন্তা করতে আমার ভয় হয়। কারণ, স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর সর্বস্ব লুণ্ঠিত হয় এবং তাঁর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর বাড়িতে তাঁর যে কর্মঠ ছেলে ছিল সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, তাকে নিমর্মভাবে হত্যা করা হয় রাঙ্গুনিয়াতে। কারণ সে তখন আমার মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের খাবার ‘সাপ্লাই’ করছিল। সে জন্য সে সময় তাকে রাস্তায় হত্যা করা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আগরতলায় একটা স্কুলঘরে বসে এই অঞ্চলের ভার তিনি গ্রহণ করেন এবং সেখানে বসে তিনি তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালনা করেন”।
তিনি সবাইকে বলেছিলেন না কাঁদার জন্য, আসলে কাঁদার জন্যই বলেছিলেন-
“কাঁদিব না আর আমি
কাঁদিব না আর,
আমার দুঃখের দিন
রহিবে না চিরদিন।
দু’দিন কেন তবে
কেঁদে অবসান হবে,
দুঃখেরও হাসিব আজি
লীলা বিধাতার।
কাঁদিব না আর আমি
কাঁদিব না আর।”
আসুন, জহুর আহমদ চৌধুরীর জন্য কাঁদি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট