চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভারতে মৌর্যদের উত্থান ও পতন এবং বাংলায় তার প্রভাব

নাওজিশ মাহমুদ

৩০ জুন, ২০১৯ | ১:০৫ পূর্বাহ্ণ

নন্দ বংশের পর মৌর্যরা মগধের সিংহাসন দখল করে। প্রথম মৌর্য স¤্রাট চন্দ্রগুপ্ত খৃস্টপূর্ব ৩১৭ সালে সিংহাসনে বসেন। ২৪ বছর পরে চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যূ হলে খৃস্টপূর্ব ২৯৩ সালে সিংহাসনে বসেন ছেলে বিন্দুসার। ২৫ বছর রাজত্ব করার পর ২৬৮ খৃস্টপূর্বে বিন্দুসারের মৃত্যু হলে সিংহাসন নিয়ে ভাতৃসংঘাতে জয়লাভ করে মগধ তথা পাটালিপুত্রের (আধুনিক পাটনা) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী বিখ্যাত স¤্রাট অশোক। মৌর্যরাই ভারতে সর্বপ্রথম সুসংগঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠার মূলে ছিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার মূল অবদান ছিল চানক্য বা কৌটিল্যের পরামর্শ। মৌর্য সা¤্রাজ্যের ক্ষমতা প্রতিপত্তি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে অশোকের আমলে। অশোক ভারতবর্ষের প্রতিকী হয়ে উঠেন। এতো বড় সা¤্রাজ্য আর কেউ গড়ে তুলতে পারে নি। এতো রক্তক্ষয়ও কারো আমলে হয়নি। আবার শান্তির বাণী প্রচারে কেউ অশোককে ছাড়িয়ে যেতে পারেন নি। মৌর্য সা¤্রাজ্যে প্রধান ধর্ম কোনটি ছিল বা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কোনটি ছিল, তা নিয়ে পরিষ্কার কিছু বোঝা না গেলেও অশোক এসে বৌদ্ধ ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। অশোকের পুর্বে মৌর্য সা¤্রাজ্যের শাসকেরা বৌদিক ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈন ধর্ম- এই তিনটি ধর্মকেই সমান গুরত্ব দিতেন। অথবা ভারসাম্য রক্ষা করতেন। ফলে মৌর্য সা¤্রাজ্য অশোকের পুর্বেই কোন ধর্ম পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও সকল ধর্মকে সমান গুরুত্ব¡ দিত। কোন ধর্মের প্রতি বিরাগের বা রাষ্ট্রীয় নির্যাতন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। স¤্রাট অশোক এসে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ফলে হিন্দু ব্রাহ্মনরা যেমন তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেন, তেমনি জৈনদের উপর নির্যাতনের ফলে ধর্মীয় ভারসাম্য বিনষ্ট হয়।
মৌর্য রাজাদের সামরিক বিজয়ের ফলে ক্ষমতা নিরংকুশ হয়ে উঠে। বিজয়ী রাষ্ট্রসমূহের প্রজাদের উপর সামরিক নিয়ন্ত্রণের ফলে দমননীতি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। জীবনের সবক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বিশাল আমলাতন্ত্র গড়ে তুলতে হয়। মৌর্যদের আমলে সবচেয়ে বেশী কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁদের আমলেই সুসংগঠিত অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা হতো। কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ওজন পরিমাপ, সুতোকাটা, তাঁতবোনা এবং খনি পরিচালনা তত্ত্ববধান করা হতো। কৃষিজীবীদের সুবিধার জন্য রাষ্ট্র থেকে সেচের পানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হতো। জমি পরিমাপ এবং বড় খাল থেকে ছোট খালে পানির সরবরাহ জন্য রাষ্টীয় কর্মচারী নিয়োজিত থাকতো। সমাজ ব্যবস্থা ছিল বর্ণপ্রথাভিত্তিক। বৈশ্যরা ব্যবসা ও কৃষিকাজে জড়িত থাকলেও মূূলত শুদ্ররাই কৃষিকর্মে শ্রমে নিয়োজিত থাকতো বংশ পরস্পরায়। গৃহভৃত্য এবং পশুপালনেও এই শুদ্ররা দাসদের মতো শ্রম দিত। তবে ইউরোপীয়দের ন্যায় পশুদের মতো বাঁধা দাস না থাকলেও শুদ্ররা যেহেতু অন্য কোন পেশায় যেতে পারতো না, তাই বাধ্য হয়ে এ সকল শ্রমে নিয়োজিত হতো। তবে কার অধীনে কাজ করবে এই বিষয়ে এবং মজুরী নিয়ে দরকষাকষিও করতে পারতো। যা ইউরোপীয় বা মধ্যপ্রাচ্যের দাসদের ছিল না। অনাবাদি জমিকে আবাদি জমিতে রূপান্তর করলে কর থেকে অব্যাহত দেয়া হতো। সে সাথে গরু বীজ এবং অর্থ দিয়ে সাহায্য করতো। এই খরচ একদিন সুদে আসলে উঠে আসবে এই ভরসায় এই নীতি গ্রহণ করেছিল। যে সকল অঞ্চলে লোহার লাঙল ছিল না সেখানে এই পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে নতুন নতুন কৃষিজমির বিস্তার লাভ করেছিল এবং জনবসতির গোড়া পত্তন হয়েছিল।
অশোকের ধর্মীয় সংকীর্ণতা না থাকায় সকল নাগরিকদের ধর্ম ও নীতিবোধের সমন্বয়ে কিছু সামাজিক অনুশাসন প্রচার করা হতো। প্রচারে ভাষা ছিল বৌদ্ধদের প্রাকৃতিক ভাষা। যা ছিল সংস্কৃতি ভাষার তুলনায় জনগণের কাছে অধিকতর গ্রহনযোগ্য। এই সামাজিক অনুশাসনে বিষয় ছিল পিতামাতাকে মান্য করতে হবে। ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সম্মান বা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে, দাস ভৃত্যসহ সকল শুদ্র ও গরীবদের প্রতি দয়াবান হতে হবে।
মৌর্য আমলে বস্তুগত সংস্কৃতির ভিত্তি ছিল লোহার ব্যাপক ব্যবহারলিপির প্রচলন, অংকচিহ্নিত মুদ্রা , শিল্পসুষমাম-িত মৃৎপাত্রের ব্যবহার, পোড়া ইটের ব্যবহার এবং সুপেয় পানীয়ের জন্য কুয়োর প্রচলন উল্লেখযোগ্য। উত্তর এবং পূর্ব ভারতের নগরসমূহের উত্থানের ভিত্তি ছল ঐ সকল বস্তুগত সংস্কৃতির বদৌলতে। অংক শাস্ত্রের বিকাশও এ যুগোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লৌহ এবং চাকার ব্যবহার সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। নগরসংকৃতির বিশেষ বিকাশ ঘটেছিল। সবচেয়ে অবাক কা- ইস্পাতের ব্যবহার ঐ সময় চালু হয়েছিল। মৌর্য যুগে গণিত শাস্ত্র, জোতির্বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞান আলাদাভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল। গণিতে প্রাচীন ভারতীয়দের তিনটি অবদান সংখ্যাতত্ত্ব, দশমিক পদ্ধতি এবং শূন্যের ব্যবহার। তার মধ্যে যুগান্তকারী হলো শূন্যের ব্যবহার, যা মৌর্য আমলে আবিস্কৃত হয়েছিল। পরবর্তীকালে আরবদের মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল।
মৌর্যসা¤্রাজ্যে রাজপ্রতিনিধি বা রাজপুত্র দ্বারা কয়েকটি রাজ্য শাসিত হতো। তেমনি কয়েকটি প্রজাতন্ত্র ছিল। প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল উত্তারাধিকারের বদলে বা রাজপ্রতিনিধির বদলে গণতান্ত্রিকভাবে নেতা নির্বাচন। বৈশালী লিচ্ছবীদের প্রজাতন্ত্র ছিল তার অন্যতম। মৌর্য সা¤্রাজ্যের বড় কৃতিত্ব কলিঙ্গকে (আধুনিক উড়িষ্যা) নিজের সা¤্রাজ্যভূক্ত করা। কলিঙ্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ১ লক্ষ লোক নিহত, কয়েক লক্ষ আহত এবং দেড় লক্ষ লোক বন্দি হয়েছিলেন। এর পর অশোককে বড় কোন যুদ্ধ করতে হয় নি। যুদ্ধের ভহাবহতা এবং মানুষের অবর্র্ণনীয় দুঃখ তাঁর মনকে নাড়া দেয়। অশোক বৌদ্ধ ধর্মগ্রহণ করেন। বৌদ্ধ ধর্মের অহিংস নীতির কারণে সা¤্রাজ্যের পতন হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অশোক তাঁর কৃতিত্বের জন্য বিশে^র কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ইতিহাসে পরমসহিষ্ণু রাজা হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। জোর করে প্রজাদের উপর বৌদ্ধ ধর্ম চাপিয়ে দেন নি। বৌদ্ধ ধর্মের বিরোধী সম্প্রদায়কেও তিনি দান-দক্ষিণা থেকে বঞ্চিত করেন নি। অশোকের অহিংসা নীতির ফলে উপজাতি সম্প্রদায়, করপ্রদানকারী, কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার সাথে সন্নাসী, পুরোহিত এবং রাজকর্মচারীদের সাথে সুষম সম্পর্ক গড়ে উঠে। শিকারী মৎসজীবীরা প্রাণী হত্যার বদলে অহিংস নীতির গ্রহণ করে কৃষিজীবনে অভ্যস্থ হয়ে উঠে।
রাজধানী পাটালিপুত্রকে কেন্দ্র করে নিকটবর্তী জনবসতি অশোকের এই সুশাসন বজায় থাকলেও তার অধিনস্থ প্রাদেশিক শাসকেরা অনেকে ছিলেন ব্রাহ্মণ। সুশাসনে বদলে অনেক দমননীতির মাধ্যমে প্রশাসন চালাতেন। বিশাল সা¤্রাজ্য সুশাসন বজায় রাখার জন্য যে ধরণের যোগাযোগ এবং তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যম গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল, তখন তা সম্ভব ছিল না। তবু অশোক এক ধর্ম, এক ভাষা এবং এক জাতির ভিত্তিতে ভারতেকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন। হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈনদের নিয়ে একটি ধর্মীয় অনুশাসনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন।
অশোক ব্রাহ্মণদের যজ্ঞ অনুষ্ঠানাদি এবং পশুপাখী বলি অনুমতি দেন নি। এ সকল অনুষ্ঠানে দান-দক্ষিণা ছিল ব্রাহ্মণদের আয়ের প্রধান উৎস। তিনি নারীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি থেকে বিরত রাখতেন। তবে তাঁর অহিংসা নীতি এবং নারীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি থেকে বিরত থাকার ফলে ব্রাহ্মণদের প্রভাব প্রতিপত্তি এবং আয় কমে যায়। তারা মৌর্য শাসনের বিরুদ্ধে চলে যায়। তাঁর পরবর্তী শাসকেরা জৈনদের প্রতি বিরূপ আচরণ করে। ফলে তাঁরাও বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। যুদ্ধ এবং বিজয়ের পরিবর্তে শান্তির বার্তা প্রচারের ফলে সেনাবহিনীর দক্ষতা এবং শৌর্যবির্য হ্রাস পায়। অশোকের জীবদ্দশায় বৌদ্ধসংঘগুলিতে দান করতে গিয়ে রাজকোষ শূন্য করে ফেলেন। অমাত্যদের সহযোগিতায় তার পরবর্তী উত্তারিধিকার পৌত্র (নাতি) সম্পাদি (সম্প্রতি) হাতে কার্যত রাজ্য ও ক্ষমতা দুই হারিয়ে অশোক ২৩২ খৃস্টপূর্বে অবসরে যান। অশোকের অবসরের পর পর যোগ্যতাসম্পন্ন শাসকের অভাবে অশোকের শান্তিনীতি বজায় থাকেনি। তার উত্তরাধিকারীরা সা¤্রাজ্য দৃঢ় হাতে শাসন করতে ব্যর্থ হন। ফলে মৌর্য সাম্রাজ্যে ভাঙন ধরে। ১৮৫ খৃস্টপূর্বে শেষ মৌর্য স¤্রাট বৃহদ্রথ নিজের সেনাপতি পুষ্যমিত্রের সুঙ্গের হাতে নিহত হন। এর মধ্য দিয়ে মৌর্য সা¤্র্রাজ্যের অবসান ঘটে।
এই সময় বাংলা অঞ্চলে কোন শাসকের নাম পাওয়া যায় না। সমগ্র বাংলা অঞ্চল তাঁর অধীনে ছিল কি না তারও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে বগুড়া এবং দিনাজপুরে খননের ফলে অশোকের অনুশাসনের প্রমাণ পেলেও অশোকের অধীনে ছিল কিনা তা এখনও প্রমাণিত হয় নি। পাটালিপুত্র (বিহারের পাটনা) থেকে এতো কাছে একটি আলাদা রাজ্য থাকা যেমন সম্ভব ছিল না। তেমনি কলিঙ্গযুদ্ধের পর এই অঞ্চলে রাজা বা রাজারা স্বেচ্ছায় অশোকের শাসন বা বৈশ্যতা মেনে নিতে পারে। অথবা করদরাজ্য হিসেবে থেকে যেতে পারে। গঙ্গারাজ্যের পর শশাংকের পূর্ব পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া সময় উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। উত্তর বঙ্গ এবং পশ্চিম বঙ্গে মৌর্যদের প্রভাব থাকলেও মধ্যবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ এবং পুর্ব বঙ্গ মৌর্য বা অশোকের শাসনের বাহিরে ছিল। পাটলিপুত্র ও তার আশে পাশে অনেক নগর গড়ে উঠলেও বাংলা অঞ্চল ছিল গ্রামীণ সমাজের প্রাধান্য। এই গ্রামীণ সমাজের বৈশিষ্ট্য ছিল কৃষিপ্রাধান্য। এই কৃষিব্যবস্থায় বর্ণপ্রথা ছিল অনেকাংশে শিথিল। ফলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্রের বিভাজন খুব একটা ছিল না। মৌর্য সা¤্রাজ্যের বস্তুগত সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলা অঞ্চলে পুন্ড্রগরীর মতো নগরের গোড়া পত্তন হয়েছিল।
ঋগবেদ, বেদ, রামায়ন মহাভারতের পরবর্তীযুগে ব্রাহ্মণ প্রাধান্যের বিরোধীতা করতে গিয়ে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ঘটে। বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈন ধর্মে উত্থানের ফলে ভারতীয় সমাজে বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে একটি সাম্যসমাজ ও অহিংস সমাজের অবস্থানের ফলে বর্ণপ্রথা এবং দাসব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। তবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েও বৌদ্ধ ধর্ম জনগণের ধর্ম হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেনি। মৌর্যদের পতনের ফলে বৌদ্ধ ধর্ম আর টিকে থাকতে পারে নি। পারেনি জৈন ধর্মের বিকাশ লাভ করতে। কারণ বৌদ্ধ এবং জৈন উভয়ে ছিল অহিংস মতবাদের ধারক। শুদ্র তথা গ্রামের কৃষিশ্রমিকদের, পাশুপালনের শ্রমিকদের এবং গৃহভৃত্যদের মুক্তির কোন নির্দেশনা দেখাতে পারে নি। কারণ বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম মৃত্যুর পর কোন শুদ্র এবং শ্রমদাসদের জন্য কোন শুভ সংবাদ দিতে পারে নি। কারণ এই দুই ধর্ম মৃত্যুর পর কোন জগতের অস্তিত্বে বিশ^াস করতো না। এদেরকে রাষ্ট্রবিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের রাস্তাও দেখাতে পারে নি। ফলে কোন আশায় নিগৃহীত এই শ্রেণি বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম গ্রহণ করবে। বরঞ্চ হিন্দু জন্মান্তর মতবাদের ফলে ভাল কাজ, নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় হিসেবে জন্ম নেওয়ার সুযোগ আছে, এতেই তাঁদের কাছে কিছুটা আশার বাণী হলেও ছিল। ফলে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম সাধারণ মানুষের এবং নিগৃহীত মানুষের ধর্ম হিসেবে আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়। ব্রাহ্মণদের ক্ষমতার বিপরীতে ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের মাঝে এই দুই ধর্ম জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণরা ক্ষমতায় আরোহনের ফলে এ ধর্মদ্বয়ের বিকাশ রূদ্ধ হয়ে যায়।
জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম মোকাবিলায় এই সময় হিন্দু ধর্মের বৈষ্ণবধারার জন্ম নেয় মৌর্য যুগে। সেই সাথে জন্ম নেয় শৈবধারা ও শক্তিধারা। সেই সাথে বিকশিত হয় বস্তবাদী ষড়দর্শন এবং চার্বাকধারা, যা লোকায়ত দর্শনের ধারা হিসেবে পরিগণিত। ভাববাদের এবং বস্তুবাদের দোলাচলে ভারতীয় সমাজ এগিয়ে যেতে থাকে। সুনির্দিষ্ট কোন ধর্ম বা দর্শনের ভারতীয় সমাজে একচেটিয়া হতে পারে নি। মৌর্যযুগের প্রভাবে বাংলায় আর্যসমাজ বা ভারতীয় সমাজের প্রভাবে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম যেমন জনমানস গড়ে উঠে, তেমনি চার্বাক দর্শন, ষড়দর্শনসহ লোকায়ত দর্শনচর্চাও অব্যাহত থাকে। সে সাথে হিন্দু ধর্মের বৈষ্ণবধারা, শৈবধারা এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে সহজিয়া ধারারও বিকাশ ঘটে। ফলে ঐ সময় একক কোন ধর্মের প্রাধান্যের ইঙ্গিত পাওয় যায় না। তবে মৌর্য আমলেই ভারতীয় সভ্যতা, ভাষা, ধর্ম ও সামাজিক প্রথা বাংলা অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে। বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি, জীবনাচার, আচরণের মিশ্রণে নতুন সভ্যতা, নতুন ভাষা, নতুন সামাজিক প্রথার ভিত্তি তৈরী হয়। পরবর্তীকালে ভারত থেকে আলাদা হয়ে বাংলার নিজস্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই মিশ্র সংস্কৃতি গুরত্বপূর্র্ণ ভূমিকা পালন করে।

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট