চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে তামাকের পরোক্ষ বিজ্ঞাপনও বন্ধ করা জরুরি

এস এম নাজের হোসাইন

২৯ জুন, ২০১৯ | ১:১৮ পূর্বাহ্ণ

তামাকজাতপণ্য সেবন স্বাস্থ্যের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর বিধায় সরকার নানাভাবে সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে নিরোৎসাহিত করছে। তবে আইনের কঠোর প্রয়োগ না হওয়ায় এবং এ বিষয়ে বলিষ্ঠ জনসচেতনতা কর্মসূচি না থাকায় সুফল মিলছে না। তামাকজাতপণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার আইনত নিষিদ্ধ হলেও পরোক্ষে নানাভাবে প্রচার চলছে। এ ধরনের প্রচারে পরোক্ষভাবে অংশ নিচ্ছেন অনেক তারকাশিল্পীও। এটা দুঃখজনক। এসব ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর অবস্থানের বিকল্প নেই।
একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, তামাকজাতপণ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এবং এর বিজ্ঞাপন বন্ধে আইন থাকা সত্ত্বেও লাগাম টানা যাচ্ছে না। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা (৫) ও তামাক নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার ধারা-৩ অনুসারে কোনো বই, ম্যাগাজিন, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, পোস্টার, ফিল্ম বা ভিডিও টেপসহ সবক্ষেত্রে তামাকজাতদ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা দ-ণীয় অপরাধ। কিন্তু আইন থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র প্রয়োগের অভাবের সুফল আসছে না। দেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই তামাকপণ্যের বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। গ্রাহকদের তামাকপণ্য সেবনে আকৃষ্ট করতে সেসব বিক্রয়কেন্দ্রে বিজ্ঞাপন সংবলিত শোকেস, ফেস্টুন, চায়ের কাপ, ছাতা ইত্যাদি দেয়া হয়। এ ছাড়া টিভি, ফ্রিজ, ডিনার সেট, বাল্টি, মগ ইত্যাদি পুরস্কার ঘোষণা করেও বিভিন্ন প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
এর সত্যতা মিলেছে সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব থিয়েটার আর্টস (বিটা) (বিটা, ইলমা ও ক্যাব কনর্সোটিয়াম) পরিচালিত একটি জরিপেও। অথচ আইনে স্পষ্ট বলা আছে, স্বল্পমূল্যে, জনসাধারণকে দেয়া বা এর প্রস্তাব করা, তামাকজাতদ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বা তা ব্যবহার, উৎপাদন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কোনো পুরস্কার, বৃত্তি প্রদান বা কোনো অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার বহন করা আইন বহির্ভূত এবং দ-নীয়।
অভিযোগ আছে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের প্রচারণার জন্য বেছে নিচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চল। নগরে কিছু ক্ষেত্রে রয়ে-সয়ে বিজ্ঞাপন বা প্রচারণা চালালেও গ্রাম, পাহাড়ে অনেকটা প্রকাশ্যেই সাধারণ মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করতে তাদের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তামাকে উৎসাহ নয়, অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে সহজ সরল এসব মানুষকে তামাক চাষেও উদ্ধুদ্ধ করছে কোম্পানিগুলো। প্রসঙ্গত, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ধুমপান করা ১০টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪ কোটি ১৩ লাখ (৪৩.৩%) তামাক সেবন করে। পুরুষদের মধ্যে তামাক সেবনের হার ৫৮% এবং নারীদের মধ্যে ২৮.৭%। এবং এই হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ২৫ বছরে তামাকজনিত কারণে বিশ্বে ২৫ কোটি শিশুকিশোরের মৃত্যু হবে। বর্তমানে সারাবিশ্বে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ১১০কোটি ধূমপান করছে। এসব ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে গ্লোবাল টোব্যাকো সার্ভে রিপোর্টে। আরো হতাশ হওয়ার মতো তথ্য হলো, ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন (আইএইচএমই) ২০১৩ গবেষণা অনুসারে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ অকালমৃত্যু বরণ করে। তামাকখাত থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায় তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় সরকারকে স্বাস্থ্যখাতে তার দ্বিগুণ ব্যয় করতে হয়।
আইন থাকলেও প্রয়োগের অভাব, কিংবা যৎসামান্য প্রয়োগ হলেও তা এতটাই সামান্য যে এতে রাঘববোয়াল কোম্পানিগুলোর কিছুই যায় আসে না। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে কোন প্রকার জবাবদিহির মধ্যে যেতে হচ্ছে না। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো যেভাবে অভিনব কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করছে, সুদুরপ্রসারি চিন্তাভাবনা করছে, সে অনুসারে আইনের প্রয়োগ কোন অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারছে না। শক্তিশালী আইন থাকার পরও মূলত বাস্তবায়নের অভাব এবং দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে তামাকপণ্যের প্রচার প্রচারণা বেড়েই চলেছে। তামাকের বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণ বন্ধ করা গেলে তামাক সেবনের পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে নিমোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ এর বিজ্ঞাপন প্রচারণা অথবা পৃষ্ঠপোষকতা সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে। বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকপণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করতে হবে এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধে শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ করা হলেও তামাক কোম্পানিগেুলোকে সিএসআর কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ফলে আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রচারণামূলক কার্যক্রম চলছে। এ বিষয়ে সুচিন্তিত উদ্যোগ নিতে হবে। তামাকপণ্য বিক্রেতার জন্য আইন প্রতিপালনের শর্তসহ লাইন্সেস প্রথা প্রচলন করাও দরকার। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাও বৃদ্ধি করা।

লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কেন্দ্র্রিয় কার্যকরী পর্ষদ, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট