চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মানুষের জীবনে লাগুক মধুমাসের ছোঁয়া

চলমান জীবন

আবসার হাবীব

২৬ জুন, ২০১৯ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

মধুমাসের বাজার ……..
এখন বাজারে, ফলের দোকানে, ফুটপাতে, অলিতে-গলিতে শুধুমাত্র আম-জাম-কাঁঠাল-আনারসের ডাক শোনা যায়। মধুমাসের নানান ফল নিয়ে ফেরিওয়ালারাও ব্যস্ত – মাথায় করে, ঠেলা গাড়ীতে, ভ্যান গাড়ীতে বিক্রি করছে। অনেকে আছে, সারা বছরে শুধু এই মধুমাসেই রসালো ফল বিক্রি করে আনন্দ পায়। সুদূর রাজশাহী-কুষ্টিয়া-রংপুর অঞ্চল থেকে তারা ছুটে আসে। বিক্রি করতে ভালো লাগে নানান ফল। আয়ও ভালো হয়। রাজশাহীর আম, ময়মনসিংহের কাঁঠাল, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর কালিপুরের কিংবা রাজশাহীর লিচু। জ্যৈষ্ঠের মধুমাস প্রকৃতি এক অকৃপণ দান। মধুমাসের সব ফলই খেতে তৃপ্তির আস্বাদ। আমরা সবাই মিলে এই মধুমাসকে উপভোগ করতে চাই, স্বাস্থ্য-মন সব দিক দিয়ে। খেয়ে আনন্দ পেতে চাই। জীবনে সুখের আনন্দ যেন ছড়াতে পারি – প্রতিটি মানুষের জীবনে ছোঁয়া লাগুক মধুমাসের। তৃপ্তিতে ভরে উঠুক মান-প্রাণ।
মধুমাসের রসনা …..
মধুমাস জ্যৈষ্ঠ মাস। রবীন্দ্রনাথ বাল্যরচনায় লিখেছিলেন :
আমসত্ত্ব দুধে ফেলি
তাহাতে কদলী দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুস হুপুস শব্দ
চারিদিক নিস্তব্ধ
পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।
এই মধুমাসে রসনা তৃপ্তির ক্ষেত্রে বাঙালির অন্যতম প্রিয় মিষ্টি সন্দেশের বদলে রসালো কাঁঠালসহ আমসত্ত্ব দুধ-ভাত অত্যন্ত প্রিয়। যদিও বর্তমানে এইসব প্রিয় ফল আম-কাঁঠাল-লিচু এখন অনেকের জন্যই দেখার জিনিস। রসনা নিবৃত্তির নয়।
কেননা দিন দিন দামই বাড়ছে। আর চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অথচ, এখন ফলের দোকানে এইসব ফল থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেখেই যেন তৃপ্তিতে পেট ভরে। মধুমাসে তারপরও সকলে সামর্থ্য অনুযায়ী একবার হলেও এই ফল কিনে খেয়ে তৃপ্তি মেটায়। আগে দেখা যেতো ক্রেতাকে ঝাঁকাভর্তি আম কিনে ঘরে ফিরতে। এখন কেজি হিসাবে কেনে দু’চার-পাঁচটি আম কিংবা বিশ-পঁচিশটি লিচু। যা আগে কল্পনা করা যেত না।
গরমের দিনে সাধারণত: খরায় সারাদেশ খাঁ খাঁ করে। কাল বৈশাখী হাওয়া, হঠাৎ দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি, আবার রোদ, প্রচ- রোদ এক নাগাড়ে আট-দশ দিন। এবারের গরম মানুষের শরীরে ও মনে দ্রব্যমূল্যের মতো আগুন ছড়িয়েছে। তাই বলে, বাঙালিরা এই মাসের রসালো খাওয়া কেউ বন্ধ রাখেনি। প্রকৃতির ফসল আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, জামরুল, তালের শাঁস এবং কলার প্রাচুর্য আমাদের মন ও স্বাদকে তৃপ্ত করেছে। মধুর মতো মিষ্টতা দিয়ে।
মধুমাস আগের মতো নেই ….
মধুমাস এখন আর আগের মত নেই। বদলে গেছে প্রকৃতিও। গ্রাম-বাংলার চিত্রও। এখন আর বর্ণনা দিয়েই মন ভরিয়ে তুলবে তেমন রচনাকার কই? ফলের স্বাদ, প্রকৃতির ছবি কে আর বর্ণনা করে। এখন হয়তো অনেকে কাঁঠালের রস দিয়ে ভাত খাওয়ার কথা শুনে অবাক হবে। ভাববে, এই হয়তো রূপকথার গল্পের মতোই কোনো গল্প। কিংবা বাড়ির উঠোনে উঠোনে আম পড়ে থাকতো – এরকম সময় ও এমন প্রাচুর্য ছিল বাংলাদেশে তা অনেকেরই অজানা। এখন মধুমাস স্মৃতি, উপভোগে, মিলনে সত্যিই দুর্লভ। এখন বৃক্ষ নিধন। গাছের পরিচর্যার অভাব। অনাবৃষ্টি, প্রকৃতির তান্ডব, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে বসতবাটির চাহিদা, সবমিলিয়ে আমাদের সেই গ্রাম বাংলা আম কুড়ানোর সেই সুখ, অনেককিছু হারানোর মতো আমরা হারিয়েছি। একসময় এই গরমের দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি দেয়া হতো গ্রামের ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে গিয়ে মৌসুমী ফল উপভোগ করার জন্য। এখন যদিও ছুটি দেয়া হয়, গ্রামে আর যেতে পারে কে?
মধুমাস এবং আম ……..
মধুমাস মনে আসে আম দেখে কিংবা খেয়ে। এবার আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। আম বাংলাদেশের সব জেলাতে হলেও সাধারণত: আম-বাগান করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আম উৎপাদন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলেই বেশী হয়ে থাকে। স্বাদে-গন্ধে সেসব আমের তুলনা হয় না। তবে, রাজশাহীর আমের সুনামই বেশী। যে কোনো আম বিক্রেতা সব আমই রাজশাহী আম বলে চালিয়ে দিতে চায়। এছাড়া আম উৎপন্ন হয় দিনাজপুর, নবাবগঞ্জ, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরায়।
আমের বাহারি নাম ……..
আমের বৈজ্ঞানিক নাম হলো ম্যাংগিফেরা ইন্ডিকা। সেই থেকে এলো ইংরেজী ম্যাংগো। আম বিশেষভাবে উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে, ভারতের পূর্বাংেশ, মিয়ানমার ও মালয়শিয়ায়। আমের নামের বাহারও কম নয়। যেমন: ফজলী, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, খিরসাপাতি, আশ্বিনা, সার্টিনার করা, হিমসাগর, কুয়ানাহাড়ি, বোম্বাই, মোহনভোগ, রাজভোগ, বৃন্দাবনী, কিষাণভোগ, লতা বোম্বাই ও ফনিয়া। আর কিছু আম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে এই দেশে উৎপন্ন করার জন্য। সে সব আমের মধ্যে রয়েছে গৌরজিত, চৌসা, আলফনসো, আ¤্রপালি, মল্লিকা, ইরউইন, কেইট, কেন্ট, জিল, রুবি, কারবাও ও পাহুতান। এই সব আম ভারতের, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার এবং ফিলিপাইনের। নাম থেকেই আমরা বুঝতে পারি। এর মধ্যে কিছু আম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যেমন, চৌসা। এবার খেলাম কয়েকদিন আগে ম্যাংগো ব্যানানা খেতে বেশ ভালো লাগলো।
আম উৎপাদন প্রতি বছর একরকম হয় না। বলা হয়, এই বছর গাছে মুকুল পরের বছর গজাবে নতুন পাতা। বাগানের আম গাছ দু’ভাবে বিক্রি হয়। গাছের পাতার উপর ভিত্তি করে, আবার গুটি আসার পর আম গাছ ইজারা দেয়া হয়। আম পাকতে পাকতে চার-পাঁচ মাসে দু’তিন-চার-পাঁচ হাত গাছ বদল হয়। এ অনেকটা বাজিকরদের বাজি ধরার মতো। কখনো কখনো আমের মুকুল ও গুটি ঝরে যায়। এই নিয়ে রাজশাহীতে একটি চমৎকার প্রবাদ আছে । মাছের ৬৪ পয়সার ১ পয়সাও যদি থাকে এবং আমের মুকুলের ১৬ আনার ১ আনাও থাকে তাহলেই আর ভাবতে হয় না। উত্তরবঙ্গের এই অর্থকরী ফসলের দিকে আমাদের নজর দেয়া দরকার। ঐ অঞ্চলের মানুষের জীবনধারণ অর্থাৎ আয়ের জন্যও এটা জরুরী। তাতে শহরমুখী মানুষের স্রোতও কমবে। সরকারী খাস জমি আম চাষীদের বিলি করে তাদের আম বাগান গড়ে তোলার জন্য উৎসাহিত করা উচিত। এতে আমরা জাতীয়ভাবে লাভবান হবো।
পুনশ্চ : মধুমাস ও সম্ভাবনার কথা …..
মধুমাসের এইসব ফল বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দিতে পারে নতুন সম্ভাবনায় এক পথ। ঋতু ভিত্তিক বিভিন্ন ফল অনেকটা প্রাকৃতিক নিয়মে এদেশে হয় বলে এইসব ফলের প্রতি আমরা যত্নবান নই। নিয়ম করে বা ভাবনা-চিন্তা করে একটি গাছ মরে গেলে আরেকটি গাছ লাগানো হয় না। পচনশীল এইসব ফল সংরক্ষণের বা টিনজাতকরণের তেমন কোনো উন্নত ব্যবস্থা এখনো এদেশে গড়ে উঠেনি। অথচ, বিদেশী ফলের টিনজাত খাবার বাজারে চেয়ে গেছে। এমন কি লিচুও টিনজাত করে বাংলাদেশে এসে গেছে। প্রতিদিন টিভিতে এসব প্রসেস করা বিদেশী ফলের বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হয়। বিভিন্ন রকমের বিদেশী ফলের জুস খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। এখনও সময় আছে বছরের এই বিশেষ সময়কে উপভোগ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এইসব ফলের রোপণ, উৎপাদন ও সংরক্ষণের দিকে নজর দেয়া। না হলে আমাদের ছেলে-মেয়েদের জীবনে কৃত্রিম লিচি খাওয়ার মৃত্যু-ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হবে। খেয়ে মরে জানতে পারবো এই কৃত্রিম ফল খাওয়া ঠিক নয়।
তাই, আসুন আমরা দেশী ফল খেয়ে জীবনকে উপভোগ করি যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট