চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেস দল হারল কেন?

ফজলুল হক

২৫ জুন, ২০১৯ | ১:০৭ পূর্বাহ্ণ

এক. রাজনৈতিক নেতারা “বাস্তব-পরিস্থিতি” থেকে শিক্ষা নেন না, এরকম একটা ধারণা আমাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে গেছে। যখন তারা ক্ষমতায় থাকেন তখন উনারা ভাবতে পারেন না, একদিন তাকে আবার জনতার কাতারে ফিরে যেতে হবে। ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখলে আপনার মনে প্রশ্ন আসবে, কংগ্রেস এভাবে হারল কেন? কেন মোদি বিশাল জয় পেল? ভারতের জনগণ কি পরিবারতন্ত্রকে প্রত্যাখান করল?
২০১৪ সালের ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস আসন পেয়েছিল ৪৪টি। এবার ২০১৯ সালে আসন পেয়েছে ৫২টি। নির্বাচনে দল কেন ব্যর্থ হলো, সে বিষয়ে ময়নাতদন্ত করতে গত ২৫ মে দিল্লীতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকা হয়। বৈঠকে রাহুল গান্ধীর ঘনিষ্ট উপদেষ্টা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া কংগ্রেস দলের তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী নেতৃত্ব গড়ে তোলার কথা বলেন। বৈঠকে রাহুল গান্ধী কারো নাম উল্লেখ না করে বলেন, বেশ কিছু জ্যেষ্ঠ নেতা ভোটে প্রার্থী করেছেন তাদের ছেলে ও মেয়েকে। ফলে, ভোটারদের কাছে কংগ্রেস পারিবরিক দল হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে। রাহুল গান্ধীর এই উপলব্ধি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
“পরিবারতন্ত্র”- গণতন্ত্রের সামনে এক ধরনের অদৃশ্য কলো পর্দা। ভারতের সর্ব বৃহৎ রাজনৈতিক দল- জওয়াহেরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী পরিবারের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না। ভারতীয় কংগ্রেস ভারতে গণতন্ত্রের বিকাশে অবদান রেখেছে সন্দেহ নাই। এখন ভারতীয় জনতা কেন জানি না, কংগ্রেসকে প্রত্যাখান করছে। মোদিঝড়ে কংগ্রেস ভেসে যাচ্ছে, এটা অবাক ব্যাপার।
২০১৯ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে রাজস্থানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলেটের ছেলে বৈভব গেহলেট, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার ছেলে মাধবরাও সিন্ধিয়া, সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর ছেলে অভিজিৎ মুখার্জিসহ কংগ্রেসের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার ছেলে-মেয়েও ঘনিষ্টজনেরা ভারতের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। তাদের প্রায় সকলেই পরাজিত হয়েছেন। ডাইনেস্টিক মানুষ- না বলছে। পরিবারতন্ত্রকে- নো।
ভারতীয় কংগ্রেসের ৫২ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় রাহুল গান্ধী নির্বাচনে পরাজয়ের দায়-দায়িত্ব তার নিজের কাঁধে নিয়ে দলের পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। রাহুলের পদত্যাগের কথা শোনার পর পরই ওয়ার্কিং কমিটির সভায় উপস্থিত কংগ্রেস নেতারা সমস্বরে প্রত্যাখান করেন।
সভায় এক আবেগঘন বক্তৃতায় পি চিদাম্বরম রাহুল গান্ধীকে দলের শীর্ষ পদে থেকে যেতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, “ আপনি যদি পদত্যাগ করেন. তাহলে বেশকিছু সমর্থক, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের লোকজন, যারা কংগ্রেসকে ভোট দেন তারা চরম পদক্ষেপ নেবেন।
কিন্তু রাহুল গান্ধী, এই বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, এটা খুবই পরিষ্কার যে তিনি একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবেন না। দলের জন্য তিনি কাজ করে যাবেন। তবে রাহুল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা থেকে ফিরবেন না। রাহুল বলেন, “গান্ধী পরিবার থেকেই সভাপতি হতে হবে , তার কোন মানে নেই”। রাহুলের বিকল্প হিসাবে প্রিয়াংকার নাম আলোচনায় উঠলে, রাহুল বলেন, এর মধ্যে আমার বোনকে টানবেন না। রাহুল গান্ধীর এই উপলব্ধি এবং কংগ্রেস দলকে পরিবারতন্ত্র থেকে বের করে আনার এই চিন্তাভাবনা ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে হবে এক বিরাট ঘটনা। ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির সভাপতির পদ ছেড়ে দিলে রাহুল গান্ধী ক্ষমতাহীন, প্রভাব প্রতিপত্তিহীন হয়ে পড়বেন তা নয়। ভারতের জনগণ তার এই গণতান্ত্রিক পদক্ষেপের মূল্য দেবে। অতীতে সোনিয়া গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ না করে মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন।
দুই. ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচনে মোদির বিশাল বিজয়ের পেছনে রহস্য কি? নির্বাচনে মোদি ভূমিধস বিজয় পেল- কারণ কি? মোদি সরকারের ভবিষ্যত কেমন হবে?
ভারতের লোকসংখ্যা এখন ১৩০ কোটির মতো । এর তিন ভাগের দুই ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। ভারতে নাকি প্রতিবছর ১২ লক্ষ তরুণ চাকুরীর বাজারে প্রবেশ করে। তার বিপরীতে চাকুরীর বাজার সীমিত। ফলে অনেকে চাকুরী পাচ্ছে না। ২০১৪ সালে মোদি প্রথম মেয়াদে যখন সরকার গঠন করেন, তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভারতে বছরে ১ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন। গত ৫ বছরে সে প্রতিশ্রুতি কথার ফুলঝুরি হয়ে থেকেছে। এখন প্রশ্ন আসে, তাহলে মোদিকে ভারতের জনগণ তারপরেও এত ভোট কেন দিল? কেন ভারতের জনগণ কংগ্রেসকে প্রত্যাখান করল? এখন ভারতীয় কয়গ্রেসকে হিসেব কষে দেখতে হবে, কেন ভারতের জনগণ তাদের ভোট দেয় নি।
এবারের নির্বাচনে মোদি ঘরে ঘরে চাকুরী দেবেন, এমন প্রতিশ্রুতি দেন নি। গত দুই বছর ধরে ভারতের বিজেপি সরকারের সরকারী পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে না। ফাঁস হওয়া ভারত সরকারের এক তথ্যে দেখা যায় ভারতে এখন বেকারত্বের হার ৬.১ শতাংশতে’ পৌছে গেছে। ভারতে গত ৪৫ বছরে এটাই সর্বোচ্চ। গত বছর ভারতীয় রেলের ৬৩ হাজার লোক নিয়োগের বিজ্ঞাপনের বিপরীতে আবেদন পড়েছিল – ১ কোটি ৯০ লক্ষ।
তিন. গ্রামীণ ভারতের জন্য মোদি সরকার বছরে ১০০ দিনের কাজের কর্মসূচী নিয়েছিল। যাতে ভারতের গ্রামাঞ্চলের ৭ কোটি লোক কাজ করেছেন। ভারতের শহরের তরুণরা এই সুবিধা পায় নি। এক রিপোর্টে দেখা গেছে, গত বছর ভারতে নারী শ্রমশক্তি ২৬ শতাংশে নেমে আসে। ২০০৫ সালে এটা ছিল ৩৬ শতাংশ। ২০১৫ সালে মোদি “স্কিল ইন্ডিয়া”নামে একটি কর্মসূচী শুরু করেন। তারা ২০২২ সালের মধ্যে ৫০ কোটি ভারতীয়কে প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়। গত বছর দেখা গেছে, এ কর্মসূচী থেকে এক চতুর্থাংশ লোক চাকুরী পেয়েছে।
চার. মোদীর এবারের নির্বাচনী প্রচারণার কৌশল ছিল ভিন্ন। তার সুফল হিসেবে তিনি ভারতীয় লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৩০৩টি আসন পেয়েছেন। তার জোটের অন্য শরীকদের হাতে এসেছে আরো ৫০টি আসন। ২০১৪ সালে মোদী ভারতবাসীকে বলেছিলেন, তার যুগ হবে “আচ্ছে দিন” এর যুগ। তার নীতি হবে “মিনিমাম গর্ভমেন্ট ও ম্যাক্সিমাম গর্ভনেন্স” এর উপর দাঁড়িয়ে থাকা। তিনি “সাবকা সাথ, সবকা বিকাশ” করবেন। ভোটাররা তাকে বিশ্বাস করেছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি জিতেছিলেন।
এবার মোদি আওয়াজ তুলেছেন, ভারতের ভিতরে ও বাইরে শত্রু গিজগিজ করছে। একমাত্র মোদির বুকের পাটা আছে, শত্রু ঠেকানোর। মোদির এই “খাকি” প্রচারণা এবার তাকে বিশাল বিজয় এনে দিয়েছে।
পাঁচ. আধুনিক ভারতের ইতিহাসে সব চাইতে ব্যতিক্রম ভাবমূর্তির মানুষ হলেন মোদি। তিনি পরিবারতন্ত্রের প্রডাক্ট নন। গত ৫ বছরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজেপির লাখ লাখ সাইবার যোদ্ধা মোদিকে অবতারের সম্মান দিয়ে প্রচার চালিয়েছে। গণমাধ্যম মোদিকে প্রচুর কভারেজ দিয়েছে। জনগণকে বোঝানো হয়েছে, এই প্রধানমন্ত্রী একেবারে“ভিন্নজাতের”। তাকে এমন উচ্চতায় তোলা হয়েছে, এটা তাকে দেবত্ব আরোপের শামিল।
ছয়. আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব আছে। সেটা কেবল আওয়ামী লীগের উপর আরোপ করা যাবে তা নয়- বিএনপি, জাতীয়পার্টিসহ অন্যান্য দলেও আছে। বিএনপিতে তারেক জিয়ার প্রাধান্য এবং জাতীয় পার্টিতে কখনো এরশাদের ভাই, কখনো এরশাদের বউ- এর প্রাধান্য দেখা যায়। পরিবারতন্ত্রের ব্যপ্তি নীচের দিকে লক্ষ্য করা যায়। পার্লামেন্ট সদস্য বা অন্যান্য জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন দেবার সময় বয়োবৃদ্ধ বা দলের প্রয়াতদের সন্তানদের বেছে নেয়া হয়। রাজনীতিতে এভাবে পরিবারতন্ত্রের ব্যাপ্তি ঘটে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কৌশল কিছুটা ভিন্ন মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলেও সরকারে চৌকষ তরুণদের টানছেন। এটা ভাল পদক্ষেপ। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের উপর যে চাপ এসেছিল, তা থেকে দলকে বাঁচাতে শেখ হাসিনার হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দেয়া ছাড়া, তখন অন্য কোন পথ আওয়ামী লীগ নেতাদের সামনে ছিল না। এখন দলে নেতা তৈরী হওয়া উচিত দক্ষতার ভিত্তিতে পরিবারতন্ত্রের ভিত্তিতে নয়।

লেখকঃ সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট