চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আজমীরে যেয়ারতকারীর কল্যাণে ভারত সরকারকে আরও এগিয়ে আসতে হবে

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

২৪ জুন, ২০১৯ | ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের ধর্মীয় মুরব্বি সুলতানুল হিন্দ গরীবে নাওয়াজ হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী আজমীরি (রহ.)। বাংলাদেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেয়ারত প্রেমিকগণ আজমীরে এসে থাকেন। অবস্থাভেদে কেউ ২/১ ঘন্টা, কেউ বা ২/৪ দিন। এমন আশেকের সংখ্যাও কম নয়,যারা দীর্ঘ সময় যেয়ারতের উদ্দেশ্য থেকে থাকেন। শত বছর বা তারও আগে সম্মানিত খাদেমগণ যেয়ারতকারীগণের কল্যাণে ভূমিকা রাখতেন। খাদেমগণ তাদের ঘরে যেয়ারতকারীগণের অবস্থানের পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতেন।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে উপ-মহাদেশ বিভাগের পর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ মাজার কমপ্লেক্সের দিকে দৃষ্টি দেন। ফলে, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে কেন্দ্রীয় সরকার এ মাজার কমপ্লেক্স নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ভারত সরকারের পক্ষে একজন প্রশাসক নিয়োগ দেয়। যাকে নাজিম পদবী বলা হয়। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে জওয়াহেরলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভারতীয় লোকসভায় উধৎমধয শযধলিধ ঝযধযবন অপঃ ঙৎ উকঝ অপঃ নামে একটি আইন পাস করা হয়। সে আইন অনুযায়ী ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক কমিটি দ্বারা মাজার কমপ্লেক্স নিয়ন্ত্রিত। কমিটির মুখপাত্র তথা প্রতিনিধি অর্থাৎ প্রশাসক থাকবেন, কেন্দ্রীয় সরকারের উপ-সচিব মর্যাদার একজন কর্মকর্তা।
কমিটি থাকলেও আইন অনুযায়ী প্রশাসক তথা নাজিম পদবীধারী সরকারী প্রতিনিধি হয়ে মাজার কমপ্লেক্সের যাবতীয় কিছু তদারক তিনিই করে থাকে। তার সহযোগী হিসেবে একাধিক ইমাম, মুয়াজ্জিম, ঝাড়–দার,অফিসিয়াল কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে ১৫০ -এর অধিক লোকবল রয়েছে। তারপরেও মাজার কমপ্লেক্সে ত্রিমুখী প্রতিনিধিত্ব রয়েছে বলা চলে। যেমন- (১) নাজিম ও তার সহকর্মীবৃন্দ ভারত সরকারের প্রতিনিধি হয়ে, (২) সুলতানুল হিন্দের বংশধর রাষ্টীয়ভাবে স্বীকৃত হযরত ছৈয়দ জয়নুল আবেদ্বীন আলী খান ধর্মীয় মুরব্বি হিসেবে সাপ্তাহিক এবং বাৎসরিক বিশেষ মাহফিলসমূহে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে, (৩) খাদেমগণ, তাদের বর্তমান সন্তানাদির সংখ্যা কয়েক হাজার। অধিকাংশ খাদেম এ মাজার কমপ্লেক্স কেন্দ্রিক আর্থিকভাবে লাভবান বলা যায়। তারাও সমিতি করে মাজার কমপ্লেক্সে প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রাখতে তৎপর। তবে মাজার কমপ্লেক্সের যাবতীয় ব্যয় সরকারী প্রশাসক তথা নাজিমের মাধ্যমে হয়। মাজার কমপ্লেক্স ব্যবস্থাপনায় দৈন্দদিন, মাসিক, বাৎসরিক খরচে সরাসরি সরকারের প্রশাসক নাজিমের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এতে দান বাক্সসহ নানান আয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিবর্গ এবং সুলতানুল হিন্দের আশেকগণ ভারত সরকারের প্রশাসক তহবিলে বিভিন্ন অংকের অর্থ দান করে থাকেন। সৌদি আরবের পর আজমীরে যে হারে প্রতিনিয়ত মানুষের ঢল থাকে, তা বিশ্বের বুকে অন্য কোন মাজারে আছে বলে মনে হয় না।
যুগে যুগে সব কিছু পরিবর্তনশীল। সুুফিজমেও অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসে যাচ্ছে বা এসে গেছে। যোগাযোগসহ নানা দিক দিয়ে বিশ্ব উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেছে। এরপরেও আজমীর কেন্দ্রিক মাজার কমপ্লেক্সে দূর-দূরান্ত থেকে আসা যেয়ারতকারীগণের রয়েছে নানান প্রতিকূলতা। যা, ভারত সরকারের কাছে গুরুত্বের অভাব রয়েছে বলে মনে করি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে সুফিজমে তথা তরিক্বতে যেয়ারতের পক্ষের লোক। ভারতে আজমীরসহ বিভিন্ন স্থানে যেয়ারতের উদ্দেশ্য গমন করে থাকি । এবং তা করতে হবে শরীয়তের মানদ- রক্ষা করে। প্রথমত আসি যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক দিয়ে। আজমীরে একটি বিমানবন্দর সময়ের দাবি ছিল। বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা করে গত বছর তা চালু করা হয়। নাম দেয়া হয় কিষানগড় (করংযধহমধৎয) বিমানবন্দর। যা কোন মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিষানগড় আজমীরের নিকটে একটি ছোট শহর মাত্র। এ বিমান বন্দরটির নাম সুলতানুল হিন্দের নামে হওয়া সময়ের দাবি। ভারতবর্ষের ৯০-৯৫% বা তারও বেশি ভোট-এর পক্ষে পড়বে। অর্থাৎ ১৩০ কোটি ভারতবাসীর মধ্যে সব ধর্মাবলম্বী গরীবে নাওয়াজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দিল্লী- কলকাতাসহ ভারতের অনেক বিমান বন্দর বিভিন্ন প্রখ্যাত ব্যক্তিগণের নামে রয়েছে। ভারত সরকার আন্তরিক হলে এখনও গরীবে নাওয়াজের নাম সংযুক্ত করে দিতে পারে। আজমীরের এ বিমান বন্দরের সাথে কলকাতার কোন ফ্লাইট নাই। অন্যান্য প্রাইভেট বিমান রাজি না হলেও সরকারী বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার কলকাতা-আজমীর সরাসরি ফ্লাইট দিতে অনীহা কেন বোধগম্য নয়।
কলকাতা-আজমীর কোন ট্রেন সার্ভিস ছিল না। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে ভারত সরকার শিয়ালদহ-আজমীর সপ্তাহে একবার ট্রেন সার্ভিস দিয়েছিল। আজ এ ট্রেন দৈনিক ভিত্তিতে চলছে। জয়পুর বিমানবন্দর থেকে জয়পুর সিটি হয়ে আজমীর প্রায় ১৪০ কি.মি। এ মহাসড়কে প্রায় ২৪ ঘন্টা শত শত ট্রাক লরি যাতায়াতে থাকে। ফলে জয়পুর বিমান বন্দর থেকে আজমীর পৌঁছতে ৩/৪ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় লাগে।
আজমীর মাজার কমপ্লেক্সে খাদেমগণের উঠতি বয়সী সন্তানদের মধ্যে অনেকে বা অধিকাংশই বেকার বলা যায়। যেহেতু বর্তমান মাজার কমপ্লেক্স কেন্দ্রিক শত শত হোটেল গড়ে উঠে, যেয়ারত পক্ষের বর্তমান প্রজন্ম হোটেলে থেকে ও খেয়ে যেয়ারত করার পক্ষে। অপরদিকে, যারা ধর্মীয় দিক দিয়ে জ্ঞানী নামাজী তারা ফুল, গিলাফ এ সব থেকে মুক্ত থেকে শরীয়ত সম্মতভাবে যেয়ারতের পক্ষে। এতে দূর-দূরান্ত থেকে যেয়ারতে যাওয়া এবং তাদের মধ্যে মহিলা থাকলে, উঠতি বয়সি খাদেমগণ তাদেরকে টার্গেট করে বেশি। তাদেরকে ভয় দেখায় ফুল, গিলাফ ইত্যাদিতে খরচ না করলে বেয়াদবী হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
একবার এক দম্পতি জয়পুর থেকে একটি রিজাভ গাড়ি নিয়ে আজমীর এসেছিলেন। খাদেমগণের একাধিক সন্তান তাদের পেছনে ভয়ভীতি দেখাতে থাকলে শেষ পর্যন্ত তারা ভয়ে সমস্ত টাকা দিয়ে আসে।
১০/১৫ বছর আগে এক প্রশাসক (নাজিম) আমাকে দুঃখ করে বলেন, মাজার শরীফের অভ্যন্তরে কোটি কোটি রুপি আয় করে নেয়। কিন্তু মাত্র ১০০ রুপির খরচ পড়লে তা সরকারের প্রশাসকের তহবিল থেকে করতে হয়।
প্রতিকূলতার অভিজ্ঞতা : পরিবারের কয়েকজন সদস্য নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার যেয়ারতের উদ্দেশ্য ঢাকা থেকে আজমীরে যাওয়ার সুযোগ হয়। ঢাকা থেকে ১০.৩০ মিনিটের ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছি। বিমান বন্দরে সমস্যায় পড়ি ওযু করতে গিয়ে। আগেও অনেকবার হয়েছে। এখানে ওয়াশ রুমগুলোতে বেসিন এ হাতমুখ ধোয়া যায়। কিন্তু বেসিন-এ পা তুলে ধোয়াটা সম্ভব হয় না। অপরদিকে মূল টয়লেটে গিয়ে পা ধুয়াটাও কঠিন। যা আমাদের কাছে এক কঠিন সমস্যা হয়ে ওঠে। সেখান থেকে ২.৩০ মিনিটের ফ্লাইটে জয়পুর বিমান বন্দর রওনা হই। বিমানবন্দর থেকে জয়পুর শহর হয়ে আজমীরে পৌঁছতে ৪/৫ ঘন্টা লেগে যায়। জাতীয় মহাসড়কে শত শত ট্রাক লরির কারণে আমাদের টেক্সি গতি পাচ্ছিল না। ফলে আজমীরের অভিষ্ট হোটেলে পৌঁছতে রাত প্রায় ৯ টা পার হয়ে যায়। আমরা ছিলাম মাজার কমপ্লেক্সের দেড় কি.মি দূরত্বের হোটেলে। আধা ঘন্টা ব্যবধানে ঐ ট্যাক্সি নিয়ে যেয়ারতে গমন করি। আমাকে বারে বারে উঠতি বয়সের খাদেমগণের সন্তানদের সাথে কথা বলতে হচ্ছিল। পরদিন জুমায় এবং আছরের সময়ও। এ রকম পরিবেশ আগে এত ছিল না। তারা কথার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করতে চায়। এখানে যেয়ারতে আসলে নানান আনুষঙ্গিক নিয়ম-কানুন মানতে হবে। কোন মতে একজন সরাতে পারলে আরেকজন এসে যায়। আমি না থাকলে পরিবারের সদস্যদের বিরুপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত। এখানে মাজার কমপ্লেক্সে জুমায় মহিলারা বসে থাকবে,জুমার নামাজ পড়বে না। যার কোন গ্রহণযোগ্য সদুত্তর নেই।
আগেই উল্লেখ করেছি,ভারতবর্ষে যেয়ারতের ব্যাপারে বড় ধরনের মত পার্থক্য নেই। যারা তরিক্বত প্রেমিক এবং শিক্ষিত সচেতন নামাজী তাদের মধ্যে অধিকাংশ যেয়ারত করতে গিয়ে শিরকের কার্যকলাপ থেকে দুরে থাকে।
পর দিন সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে জয়পুর থেকে আমাদের কলকাতা ফ্লাইট। ফলে, মাগরিবের টাইমে আজমীরের হোটেল ছেড়ে দিয়ে জয়পুর হোটেলের উদ্দেশ্য রওনা দিই। শত শত ট্রাক লরির কারণে গাড়ির গতি কম থাকায় জয়পুর সিটি ও বিমান বন্দরের মাঝামাঝি আমাদের বুক করা রেডিসন ব্লু হোটেলে পৌঁছতে গভীর রাত হয়ে যায়। হোটেলে রাত্রিযাপন করে ভোরে বিমান বন্দরে গিয়ে ২ ঘন্টার যাত্রায় কলকাতা রওনা হই। আমি কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম রওনা হই। পরিবারের অপর সদস্যরা ঢাকা যাবে। ইমিগ্রেশন ও চেকে লম্বা লাইন। যেহেতু কলকাতা বিমান বন্দরে অভ্যন্তরীণ বহির্গমনের জন্য একাধিক ব্লক থাকলেও আন্তর্জাতিক বহির্গমনের জন্য একটি মাত্র ব্লক। এখানে চট্টগ্রাম-ঢাকার ৩/৪ টি ফ্লাইটে কয়েক শ’ যাত্রীর লম্বা লাইন পড়ে যায়। যেমন ইমিগ্রেশনে তেমনি চেকিং-এ। প্রায় ১ ঘন্টা মত সময় নেয়। এটাকে কলকাতা বিমান বন্দরে বাংলাদেশী যাত্রীদের ক্ষেত্রে এক প্রকার দুর্ভোগই বলা যায়। কলকাতা-ঢাকা দৈনিক ১০/১২ টি ফ্লাইট এবং কলকাতা-চট্টগ্রাম ২টি ফ্লাইট রয়েছে। এসব ফ্লাইটের প্রতিটির ধারণ ক্ষমতা ১৭০/১৮০ জন মত। অর্থাৎ কলকাতা থেকে বিদেশগামী যাত্রীদের মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যা অর্ধেক বা তারও বেশি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিমান কাউন্টার বাড়িয়ে দেয়া কোন কঠিন কিছু না। দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম একাধিক কাউন্টার বন্ধ রাখা আছে। যা গ্রহণযোগ্য নয়।
অতএব ভারত সরকারের কাছে সুপারিশঃ
১.আজমীর বিমানবন্দরকে গরীবে নাওয়াজের নামকরণ করা হোক ।
২.সরকারের প্রতিনিধি প্রশাসকের (নাজিম) ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়া হোক।
৩.নিরাপত্তাকর্মী তথা পুলিশ সংখ্যা আরও বাড়ানো হোক।
৪.খাদেমগণের সন্তানগণকে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করা হোক।
৫.আজমীর-কলকাতা সরাসরি ফ্লাইট চালু করা হোক ।
৬.ভারতের বিমান বন্দরসমূহে মুসলমানেরা যাতে ওযু করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হোক।
৭.কলকাতা বিমান বন্দরে বাংলাদেশী যাত্রীদের ভোগান্তি কমানো হোক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট