চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৩

সর্বশেষ:

২৩ জুন, ২০১৯ | ১:০১ পূর্বাহ্ণ

মোবাইল টাওয়ার স্থাপনে নীতিমালা না থাকায় বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ফোনের কল্যাণে জনযোগাযোগ ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এই যুগে মোবাইল ফোন ছাড়া একটি মুহূর্তও কল্পনা করা যায় না। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা মোবাইল ফোন টাওয়ারের রেডিয়েশন (বিকিরণ) নিয়ে দুর্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নানা গবেষণাপ্রতিবেদন বলছে, মোবাইল ফোন টাওয়ারের রেডিয়েশন শুধু মানবদেহের জন্যই নয়, পশু-পাখি ও কীটপতঙ্গের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। এ অবস্থায় জনবসতিপূর্ণ এলাকায় স্থাপিত টাওয়ারগুলো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের যাত্রা শুরু হয় দুই দশক আগে। সে সময় তেমন বিধিনিষেধ আরোপ না করায় মোবাইল ফোন অপারেটররা যত্রতত্র টাওয়ার স্থাপন করে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং বাসাবাড়ির ছাদেও টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। সারাদেশে ৫টি মোবাইল অপারেটরের এখন প্রায় ৪০ হাজার টাওয়ার আছে। টাওয়ারের ক্ষতিকর দিকগুলো সামনে আসলে বছরকয়েক আগে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গঠিত কমিটি উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তার প্রমাণ পায়। এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করে। গাইডলাইনে রেডিয়েশন মাত্রা আন্তর্জাতিক নন আয়জনিং রেডিয়েশন প্রতিরক্ষা কমিশন বা আইসিএআইআরপি-এর নির্দেশনা মতো দশ মেগাহার্টজে সীমাবদ্ধ রাখতে বলা হয়। তবে দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব ও পরিবেশ বিবেচনায় তা দশ ভাগের এক ভাগ হওয়া উচিত মনে করেন অনেক গবেষক। কিন্তু কোনো অপারেটরই সে গাইডলাইন মানছে না। প্রসঙ্গত, মোবাইল ফোনের বেস ট্রান্সিভার স্টেশন বা বিটিএস টাওয়ার স্থাপনে বিভিন্ন দেশ নিরাপদ নীতিমালা অনুসরণ করে থাকে। নিরাপদ নীতিমালায় টাওয়ার স্থাপনের স্থান, টাওয়ারের সিগন্যাল আদান-প্রদানে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং বিকিরণমাত্রাসহ নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। তবে বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটররা নিরাপদ নীতিমালা অনুসরণ না করার অভিযোগ আছে। অভিযোগ আছে, কোনো রকম স্বাস্থ্য সমীক্ষা ছাড়াই মোবাইল ফোন অপারেটররা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, বাড়ি, স্কুল এমনকি হাসপাতালের ছাদেও স্থাপন করেছে বিটিএস টাওয়ার। টাওয়ারের সিগন্যাল আদান-প্রদানে ব্যবহার করছে নি¤œমানের যন্ত্রপাতিও। ফলে সাধারণ মানুষ রেডিয়েশনের সরাসরি শিকার হচ্ছে। পড়ছে নানামুখী ঝুঁকিতে।
একই এলাকায় সব অপারেটর আলাদা আলাদা টাওয়ার স্থাপন করায় এ ঝুঁকি আরো বেড়েছে। নানা গবেষণায় স্বাস্থ্যঝুঁকির চিত্র উঠে এসেছে। প্রসঙ্গত, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ প্রকাশিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার থেকে নিঃসৃত রেডিয়েশনের মাত্রা উচ্চপর্যায়ের, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ঝুঁকি নিরসনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃষ্টিগোচর না হওয়া দুঃখজনক। তবে আশার কথা হচ্ছে, মোবাইল ফোন টাওয়ারে বিকিরণমাত্রা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ১০ ভাগের একভাগে কমিয়ে আনাসহ মোবাইল টাওয়ারের স্বাস্থ্যঝুঁঁকি নিরসন বিষয়ে উচ্চ আদালত ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের একটি রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ নির্দেশনা দেন আদালত। এতে মোবাইল টাওয়ারের ক্ষতিকর রেডিয়েশন বিষয়ে সমীক্ষা করে চার মাসের মধ্যে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে আদালতে কমপ্লাইন্স রিপোর্ট দাখিলেরও নির্দেশ দেয়া হয়। আদালতের নির্দেশনা কার্যকর করা গেলে ইতিবাচক ফল আসবে নিশ্চয়ই। উল্লেখ্য, মানুষের শরীরের সেলগুলোর যোগাযোগ দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত করে এক্সটারনাল রেডিয়েশন। এর পরিণতিতে ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকিও তৈরি হয়। আইসিএআইআরপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, মানবদেহের জন্য রেডিয়েশনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে কান ও মস্তিষ্কের টিউমার সৃষ্টি হওয়া। এ ছাড়া রেডিয়েশনের কারণে মাথাব্যথা, হৃদরোগ, ঘুম ঘুম ভাব, নিদ্রাহীনতা কাজের ব্যাঘাত ঘটাসহ অনেক সমস্যা হতে পারে। শিশুদের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও এ রেডিয়েশন ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া জেনেটিক পরিবর্তন, অবসন্নতা, লিউকেমিয়াসহ আরো কিছু রোগের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে রেডিয়েশনের কারণে। মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশন চড়–ই, মৌমাছি, শালিকসহ বিভিন্ন প্রাণীর জন্যও ক্ষতিকারক।
মোবাইল টাওয়ার থেকে মূলত একপ্রকার ত্বরিৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ সৃষ্টি হয়। এই বিকিরণ গন্ধ, বর্ণ ও শব্দহীন এবং অদৃশ্য। মাত্রাতিরিক্ত বিকিরণ জনস্বাস্থ্যকে হুমতি ফেলে দেয়। তাই টাওয়ার স্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করা জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশে মোবাইল ফোনের ৯০ শতাংশ টাওয়ার লোকালয়, বাড়ি, হাসপাতাল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদে স্থাপন করা হয়েছে। আবার মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের মাত্রাও তেমন মনিটর করা হয় না। ফলে জনস্বাস্থ্য রেডিয়েশন ঝুঁকিতে থেকে গেছে। আমরা আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নিরাপদ স্থানে টাওয়ার সরিয়ে নেয়া এবং উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও রেডিয়েশনমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়াসহ এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবান্ধব ত্বরিৎ পদক্ষেপ দেখতে চাই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট