চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ঈদের বাজার এবং অর্থনীতির স্বরূপ

অধ্যাপক ড. নারায়ণ বৈদ্য

২২ জুন, ২০১৯ | ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ

অর্থ নীতিকে দুই দৃষ্টি কোণ থেকে আলো চনা করতে হয়। কোন কোন সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রভাবে, যাকে বলা হয় ব্যষ্টিক অর্থনীতির আলোচনা। আবার, কোন কোন সময় একসাথে (অং ধ ডযড়ষব) বা বৃহৎভাবে। যাকে বলা হয়, সামষ্টিক অর্থনীতির আলোচনা। বুঝানোর সুবিধার্থে বলা যায়, একজন উৎপাদকের আয়-ব্যয়, মোট উৎপাদন, মোট মুনাফা নিয়ে যখন আলোচনা করা হয় তখন সেই আলোচ্য বিষয়কে ব্যষ্টিক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় বলা হয়। আর, একটি অর্থনীতির সকল উৎপাদকের আয়-ব্যয়, মোট উৎপাদন, মোট মুনাফা যখন আলোচনা করা হয় তখন সেই আলোচ্য বিষয়কে সামষ্টিক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় বলা হয়।
ঈদের বাজার নিয়ে যখন আলোচনা করা হয় তখন একটি দেশের সকল জনগণের ঈদের বাজার সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়োজন হয়। অতএব তা হয় সামষ্টিক অর্থনীতির বিশ্লেষণ। সামষ্টিক অর্থনীতিতে সকল ভোক্তাকে একত্রে, সকল উৎপাদককে একত্রে আলোচনা করা হয়। একটি সামষ্টিক অর্থনীতিতে দুইটি খাত বিদ্যমান থাকে। এদের একটি হয় উৎপাদক খাত আর একটি হয় পরিবার বা ভোক্তা খাত। উৎপাদক খাত মুনাফা অর্জনের জন্য বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করে।
আবার, উৎপাদন করতে চারটি উপাদান (ভূমি, শ্রম, মূলধন, সংগঠন)-এর প্রয়োজন হয়। এ চারটি উপাদানের মধ্যে উৎপাদক তিনটি উপাদান (ভূমি, শ্রম ও মূলধন) নিয়োগ করার কারণে উৎপাদককে খাজনা (ভূমির জন্য), মজুরী (শ্রমের জন্য), সুদ (মূলধনের জন্য) পরিশোধ করতে হয়। উৎপাদক কর্তৃক পরিশোধিত অর্থসমূহ ভূমি মালিকের আয় (খাজনা), শ্রমিকের আয় (মজুরী) এবং মূলধনের আয় (সুদ) বলে পরিগণিত হয়।
এই কারণে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বলা হয় একজনের ব্যয় হলো অপরজনের আয়। অতএব বলা যায়, ভূমি, শ্রম ও মূলধনের মালিকেরা পরিবার বা ভোক্তার অংশ বলে খাজনা, মজুরী ও সুদ হয় পরিবার বা ভোক্তাদের আয়। পরিবারের আয় যখন হাতে আসে তখন পরিবারসমূহ বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করার জন্য তা ব্যয় করে। উৎপাদক দ্বারা উৎপাদিত পণ্য বাজারে আসে আর পরিবারসমূহ বাজার থেকে নিজ নিজ প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করে। ফলে পরিবারের আয় ঘুরেফিরে আবার উৎপাদকের নিকট চলে যায়।
এভাবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে আয়প্রবাহ উৎপাদক থেকে একবার ভোক্তা বা পরিবারসমূহের নিকট আসে। আবার, ভোক্তা বা পরিবার থেকে তা উৎপাদকের নিকট চলে যায়। এটাকেই সামষ্টিক অর্থনীতিতে জাতীয় আয়ের আন্তঃপ্রবাহ বলে। এই আন্তঃপ্রবাহ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) বা আয়কে বৃদ্ধি করে।
বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান একটি দেশ। এ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশই মুসলিম। মুসলিম প্রধান এদেশে দুইটি উৎসব জনগণ জাঁকজমকভাবে পালন করে। এদের একটি হয় ঈদুল ফিতর বা রমজান শেষে ঈদ। আর অপরটি হয় ঈদুল আজ্হা বা কোরবাণীর ঈদ। এই দুই ঈদের তাৎপর্য ভিন্ন। ফলে, অর্থনীতিতে দুই ঈদের প্রভাবও দুই রকম। তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দুই ঈদের মধ্যে ঈদুল ফিতরের প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ে বেশি। ১৭ কোটি মানুষের দেশে যেখানে প্রায় ১৬ কোটি লোক (১ কোটি অন্যান্য ধর্মাবলম্বী) ঈদুল ফিতর পালন করে এবং যাদের বর্তমান মাথাপিছু জিডিপি পরিমাণ এক হাজার ৮২৭ মার্কিন ডলার, সেখানে প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদ্যাপনে লাখো কোটি টাকার নগদ লেনদেন হয় শুধু নতুন পোশাক ও বিশেষ খাদ্যসামগ্রী ক্রয়ে।
মূলত ঈদকে ঘিরে চাঙ্গা হয় দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাব মতে, সারা দেশে প্রায় ২৫ লাখ দোকান (সব ধরণের) রয়েছে। এসব দোকানে সাধারণ সময়ে প্রতিদিন তিন হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়। রোজার মাসে সেটা তিনগুণ বেড়ে যায়। অর্থাৎ রোজার মাসে এসব দোকানে প্রতিদিন বিক্রি হয় প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে রোজার একমাসে বিক্রি হয় প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
ঈদুল ফিতর উৎসবে সবচেয়ে বেশি টাকা লেনদেন হয় পোশাকের বাজারে। আশা করা হয় যে, পোশাকের দোকানেই ঈদের কেনাকাটা এবার ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, চাকুরীজীবীরা এবার ১২ হাজার কোটি টাকার ঈদ বোনাস তুলেছে। এর প্রায় ৯০ শতাংশ খরচ হয়েছে ঈদের বাজারে। জাকাত ঘিরে গরিব ও অসহায় মানুষের মধ্যেও ঈদ অর্থনীতির ছোঁয়া লেগেছে।
সারা বছরের মধ্যে রমজান ও ঈদকে ঘিরে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আসে সবচেয়ে বেশি। এই রেমিট্যান্সের অধিকাংশ এসেছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। গ্রামে বসবাসরত লোকদের হাতে রেমিট্যান্স আসার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়েছে অধিক। শুধু মে মাসে (২০১৯) রেমিট্যান্স এসেছে ১২৬ কোটি ৭৬ লাখ ডলার যা চলতি অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ‘এফবিসিসিআই’-এর দেয়া তথ্য অনুসারে ঈদে পোশাকসহ যাবতীয় পরিধেয় খাতে লেনদেন হয়েছে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা। জুতা, কসমেটিক্সে লেনদেন হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। ভোগ্যপণ্য লেনদেন হয়েছে ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা। জাকাত-ফিতরা ও দান খয়রাতে ৩৮ হাজার কোটি টাকা, যাতায়াত ও যোগাযোগ খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা, সোনা-ডায়মন্ড পাঁচ হাজার কোটি টাকা, ভ্রমণ খাতে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা, ইলেকট্রনিক্সে চার হাজার কোটি টাকা, স্থায়ী সম্পদ ক্রয়ে এক হাজার কোটি টাকা, পবিত্র ওমরাহ পালনে তিন হাজার কোটি টাকা ও আইন-শৃঙ্খলাসহ অন্যান্য খাতে লেনদেন হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া অর্থনীতির আরো অনেক খাত রয়েছে যেখানে ঈদকে কেন্দ্র করে বড় ধরণের লেনদেন হয়ে থাকে। বিশেষ করে ফার্নিচার, গাড়ি ও আবাসন শিল্পে বড় ধরণের কেনাকাটা হয়ে থাকে। অনেকে কেনাকাটার জন্য বিদেশ যাচ্ছে। বিত্তশালীরা ১৫ হাজার কোটি টাকা যাকাত প্রদান করেছে। এছাড়া উচ্চবিত্তের প্রায় এক লাখ মানুষ দেশের বাইরে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে কেনাকাটার জন্য পাড়ি জমিয়েছে। এদের গড়ে ৫০ হাজার টাকা খরচ হলেও ঈদে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে।
রমজানের আগে অর্থনীতি সচল থাকে ভোগ্যপণ্য কেন্দ্রিক। রোজার মাসে সব ধরণের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। রোজা শুরুর প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই মূলতঃ শুরু হয় রোজাকেন্দ্রিক অর্থনীতি। কেননা রোজার মাসের জন্য পণ্য আমদানি কার্যক্রম অনেক আগে থেকে শুরু করতে হয় ব্যবসায়ীদের। এমনকি সরকারি পর্যায়েও অনেক পণ্য আমদানি করতে হয়। আর, রোজার এক সপ্তাহ আগে থেকে মূলত শুরু হয় ভোগ্যপণ্যের বেশি বেচাকেনা। এরপর শুরু হয় পোশাকের বেচাকেনা। আর এর প্রভাব শহর থেকে গ্রাম পর্যায়েও চলে।
অর্থনীতিতে আর্থিক কর্মকা-ের প্রসার তথা মুদ্রার লেনদেন হয় অর্থনীতির জন্য আয়। অর্থ লেনদেনের আন্তঃপ্রবাহ অর্থনীতিতে জিডিপি-এর পরিমাণকে বৃদ্ধি করে। যে কোন কারণে অর্থনীতিতে লেনদেন বাড়লে অর্থনীতির গতি বাড়ে। ফলে, জাতীয় আয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এতে অর্থনীতির স্বরূপ বদলে যায়।
ঈদের বাজার ও অর্থনীতির স্বরূপ সংক্রান্ত নিবন্ধটি আম-জনতার জন্য একটু জটিল হতে পারে। তবে, বাস্তবতার দিকে তাকালে দেখা যাবে, আপনিও সামষ্টিক অর্থনীতির একটি অংশ যা আপনার ব্যয় দ্বারা অর্থনীতি প্রভাবিত হচ্ছে। কিছুদিন আগে জিইসি মোড়ে একটি সরকারি কলেজের ইফতার মাহফিলে যোগদান করেছিলাম। আমি একটু আগে ভাগে গিয়ে ড. ইদ্রিস আলী সাহেবের (বর্তমানে মহসিন কলেজে কর্মরত) সাথে বসে কথা বলছি। এমন সময় আমার একসময়ে অধ্যক্ষ প্রফেসর তাহের স্যার ঢুকে আমাদের দুইজনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, ‘দুইজন লেখক একসাথে বসে আছে, একজনের লেখা খুবই কঠিন, তাছাড়া অর্থনীতি আমি বুঝি না’।
বুঝতে আমার দেরি হলো না। কথাটা স্যার আমাকেই বলছেন। উত্তরে বললাম, স্যার- অর্থনীতি কঠিন হলেও তা বাস্তব। একটু ধৈর্য ধরে পড়লে আপনার চলমান জীবনে তার প্রতিফলন দেখবেন। তাছাড়া, আমি তো আম-জনতার জন্যই যে অর্থনীতি লিখি। যাই হোক, ঈদের বাজার যে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে তা সত্য এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর প্রতিফলন দেখা যায়।

লেখক : ট্রেজারার, বিজিসি ট্রাষ্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট