চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পশু-পাখি ও উদ্ভিদ বাজারের রাজ্যে মানবপ্রকৃতির কিছু কথাচিত্র

সমকাল দর্পণ

ড. মাহফুজ পারভেজ

২২ জুন, ২০১৯ | ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ

গ্রামে-গঞ্জে-হাটে-বাজারে মোরগের লড়াই, পায়রার কসরত, পাখির খেলা এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না। টিয়া পাখির ঠোঁটে ভাগ্য গণনার লোকায়ত জোতিষীরাও কদাচিৎ আসেন পথের ধারে পসরা সাজিয়ে। বানর নাচের বিচিত্র খেলা দেখানো যাযাবর শ্রেণীটিও হাল আমলে অবলুপ্ত হয়েছে। এন্তার পশু-পাখি আজকাল বিক্রি হয় বাজারে ও নির্ধারিত মার্কেটে।
একদা ডাহুক, শালিক, ময়না, খঞ্জনা, সারস পাওয়া যেতো সপ্তাহান্তের গ্রাম্যহাটে। প্রাচীন ঢাকাবাসীর স্মৃতিতে কাজী আলাউদ্দিন রোডের পশু হাসপাতালের সামনে কদাচিৎ বিভিন্ন পশু ও পাখ-পাখালি কেনা-বেচার ঘটনা স্মরণীয় হয়ে আছে।
ঢাকায় আনুষ্ঠানিক পশু-পাখির মার্কেট জমতে থাকে মধ্য আশি দশকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল-সূর্যসেন হলের গা ঘেঁষে কাঁটাবন-নীলক্ষেত মার্কেটে কয়েকটি দোকানে নানা জাতের পাখি, জীবজন্তু বিক্রি শুরু হয়। এখন তো সেখানকার মার্কেট ভীষণ জমজমাট। চট্টগ্রাম শহরের আছে এমনতরো পক্ষীবাজার।
তবে বৃহৎ বঙ্গদেশে পশুপাখির হাট প্রথমে শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের ব্রিটিশ শাসিত ঔপনিবেশিক কলকাতায়। ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট নব্য-জমিদাররা পূর্ববঙ্গের জমিজমা থেকে আহরিত কাঁচা টাকা মৌজ-মাস্তিতে খরচ করতো, কলকাতার বাগানবাড়িতে।
এইসব বাবু বাঙালিদের বিনোদন ছিল মোরগ লড়াই, বাজের যুদ্ধ, পায়রার উড়ালে টাকা-পয়সা বাজি ধরার খেলা। তখন বাবুদের কাছে সরবরাহের জন্য উত্তর কলকাতার হাতিবাগানের বিখ্যাত ‘পাখির হাট’ বসে। পরে একসময় তা আরও বিস্তৃতি লাভ করে চলে যায় পাশের বাগবাজার সংলগ্ন গ্যালিফ স্ট্রিটে।
লোকশ্রুতিতে পাখির হাট নামে পরিচিত হলেও আসলে তা উদ্ভিদ এবং পশুরও হাট। শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড় থেকে বি.টি. রোড (ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড) ধরে উত্তরে এগোলে টালা পোস্ট অফিস। সেখান থেকে বাগবাজার বাটার দিকে যেতে রাস্তার ডানদিকে ট্রামলাইন বরাবর বসে এই পাখির হাট। সপ্তাহান্তে ছুটির দিন রোববারের পাখির হাট নজর ও মনোযোগ কেড়ে নেয় রঙিন-বাহারি পাখির কলকাকলিতে।
ঢাকার কাঁটাবন-নীলক্ষেতের মতো স্থায়ী ঠিকানা না পেলেও কলকাতার পাখির হাট পেয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা নির্বিশেষে প্রতি রোববারে সকাল ছ’টার আগেই শুরু হয় হাট। চলে প্রায় বারো ঘণ্টা।
বি.টি. রোড থেকে গ্যালিফ স্ট্রিটে ঢুকলে প্রথমেই নজরে আসে অসংখ্য রঙিন পাখির সম্ভার। দেশি-বিদেশি, চেনা-অচেনা পাখির কিচিরমিচির কানে আসে। নানা জাতের বদ্রী, কত রকমের টিয়া, কতশত পায়রা ইত্যাদি। সকলকে ছাড়িয়ে এগোলে নজরে আসবে বিভিন্ন জাতের বিদেশি কুকুরের মেলা।
উত্তর কলকাতার বেলঘড়িয়া থেকে যাতায়াতের সময় এ হাটের মাঝ দিয়ে অনেক বার আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। হাটের সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখেছি কুকুর বিক্রির জায়গাটুকুতে। কে না জানে কুকুর মানুষের প্রিয় বন্ধু এবং নির্ভরযোগ্য সহচর। এখান থেকে মানুষ বিপুল অর্থ খরচ করে বিভিন্ন প্রজাতির ছোটো ছোটো কুকুরছানা বাড়ি নিয়ে যান। পরম যতেœ সন্তান¯েœহে লালন-পালন করেন পরিবারের সদস্যের মতো।
আরও এগিয়ে গেলে দেখা যায় বিভিন্ন ছোটো প্রাণী, যেমন – খরগোশ, গিনিপিগ, হ্যামস্টার, সাদা ইঁদুর নিয়ে বসেছেন কিছু মানুষ। বিক্রিবাটাও ভালো থাকে এইসব জায়গায়। লোহার খাঁচা, মাছের ট্যাঙ্ক, অ্যাকোরিয়ামের গাছ-সরঞ্জাম-সামগ্রী, হাঁস-মুরগির ছানা এইসব ছাড়িয়ে এগিয়ে দেখা পাওয়া যায় মাছের জায়গা। অসংখ্য প্রজাতির নাম-না-জানা মাছের সম্ভারে ভরপুর জায়গাটি।
জনবহুল রাস্তার দু’ধারে সজ্জিত ট্যাঙ্কগুলোতে ছোটো-বড়ো-মাঝারি মাছের ওঠানামা দেখলে মনে হয় যেন পানিতে রঙের জীবন্ত খেলা চলছে। বিভিন্ন রকমের ফাইটার-গোল্ডফিশ-অস্কার-ফ্লাওয়ার হর্ণ ইত্যাদি সমস্ত মাছের স্টলগুলোতে ভিড়ও প্রচুর।
কেউ মাছ কিনছেন, কেউ জেনে নিচ্ছেন মাছের পরিচর্যার সাতকাহন। এখানেই শেষ নয়। ‘মাছ হাট’ শেষ হলে শুরু হয় গাছ ও উদ্ভিদের সবুজ জগত । পৃথিবীর মাটি থেকে হারাতে বসেছে যে সবুজ, তা যেন পরম যতেœ লালিত হচ্ছে। অতি যান্ত্রিক, কল্লোলিনী কলকাতা মহানগরীর বুকেও যে গাছপ্রেমী মানুষের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়, তা টের পাওয়া যায়।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে যেমন চলতি পথের ধারে সাজানো নার্সারিতে নানাপ্রকার সুগন্ধি ও গন্ধহীন ফুলগাছ থেকে শুরু করে সবজি বা ফলের গাছ, অর্কিড থেকে শুরু করে ক্যাকটাস-সাকুল্যান্ট, বনসাই থেকে শুরু করে ইন্ডোর প্ল্যান্ট সমস্ত রকম গাছের দেখা মেলে, কলকাতার দৃশ্যও তেমনি। পার্থক্য হলো, পশু-পাখির হাটে – মাছ আর গাছ-গাছালিও এখানে চলে আসে সগৌরবে, প্রতি সপ্তাহান্তের রোববারে।
নানা বয়সের বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষ ভিড় জমান হাটে। সবাই যে কেনাকাটা করেন, তা নয়। অনেকের জটলা করে আড্ডা মারেন গাছ, মাছ, পশু, পাখি বিষয়ে। অনভিজ্ঞ বা স্বল্প অভিজ্ঞকে শিখিয়ে-বুঝিয়ে দেন পশু ও প্রকৃতি সম্পর্কে। অভিজ্ঞ গাছপালক, মাছ বা পশু-পাখি ব্যবসায়ী জানান নানা নিগূঢ় তত্ত্ব।
পাখির হাটের হৈ চৈ আর হট্টগোলের মাঝে গড়ে উঠে নজিরবিহীন বন্ধুত্ব, সামাজিক সুসম্পর্ক। চলতে থাকে লেনদেন আর ব্যবসাও। হাটেই পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের গাছের জন্য প্রয়োজনীয় মাটি, সার, রকমারি টব, রাসায়নিক ইত্যাদি সমস্ত কিছুই।
কলকাতার সামাজিক কাঠামো ও নাগরিক সংস্কৃতির পরশে বেচাকেনা, আলাপ-আড্ডা, প্রকৃতি, পাখি, পশু বিষয়ক ব্যবসা ও চর্চায় অবধারিত ভাবে চলে আসে মাটির কাপের বিখ্যাত চা। পাওয়া যায় কাটা ফল। আশেপাশে থাকে চলমান ভ্যান ভর্তি খাবারের আয়োজন। ডাবের সুমিষ্ট পানিতে গলা ভিজিয়ে কিংবা খাবারের গুমটিতে দাঁড়িয়ে খিদে মেটানোর পাশাপাশি চলতে থাকে পশু, পাখি, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক রচনার যাবতীয় উদ্যোগ।
অনেক বার জায়গা বদলালেও ‘পাখির হাট’ তার ভোল বদলে ফেলে নি। প্রাচীন কলকাতার ঐতিহ্য বহন করে এগিয়ে চলেছে বেচাকেনা, দরদাম। কখনো জমাটি আড্ডায় আবার কখনো বা চিরকালীন বন্ধুত্ব। তবে, খাঁচায় বন্দী করে দূর-দূরান্ত থেকে আনা পশু, পাখি দেখলে বুকে ব্যথা জাগে। জীবিকার প্রয়োজনে বিক্রেতারা কিছু লাভের আশায় অবোধ পাখি বা পশুদের বিক্রি করে দেওয়ার দৃশ্যও হৃদয় বিদারক।
মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে শিল্প-সাহিত্য-দর্শনে যে পশু ও পাখিদের শাশ্বত অবস্থান, সে আসন চিরস্থায়ী। তাদের খাঁচায় বন্দী দেখলে কষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। আশার কথা হলো, বধ করার জন্য কোনও হন্তারক নয়, পরম মমতায় লালন-পালনের জন্য মানবিক মানুষজনই তাদেরকে ঘরে নিচ্ছেন, পরিবারের একান্ত সদস্য রূপে।

লেখক : কবি, শিক্ষাবিদ। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট