চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সড়ক দুর্ঘটনা ঃ কে বাঁধবে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা

প্রশান্ত বড়–য়া

২১ জুন, ২০১৯ | ১:২২ পূর্বাহ্ণ

তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, দেশে যত গাড়ি আছে, তত ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। জুনের ১ তারিখ তথ্যমন্ত্রী চট্টগ্রামে একটি সভায় এ মন্তব্য করেছেন। ঠিক সেদিন সকালেই সাদেকুল ইসলাম নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একজন শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ২৩ মে নগরীর পলিটেকনিক্যোল এলাকা থেকে টিউশন শেষ করে ফেরার পথে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় টানা ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে পৃথিবীর মায়া ছাড়েন।
একজন মন্ত্রীর বক্তব্যে যখন এ ধরনের তথ্য উঠে আসে তখন সাধারণ মানুষ এটাকে নিঃসন্দেহে গ্রহণ করবে। মন্ত্রীর কথার সূত্র ধরে বলা যায় রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পরিচালিত সংস্থা বিআরটিএ কর্তৃক চালক হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া চালকরা কিভাবে চালকের আসনে বসে গাড়ি চালাচ্ছে এটাই এখন বড় প্রশ্ন সাধারণের কাছে। চালকের আসনে বসা মানুষটার কাছ থেকে সরকারি অনুমতি পত্র বা লাইসেন্স যাচাই করেন ট্রাফিক পুলিশ। আর, মাঝে মাঝে বিআরটিএর কর্মকর্তারা। রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনে যারা নিয়োজিত তারা কি এ কাজে অবহেলা করছেন? আর, বিআরটিএ কি সঠিক ভাবে অনুমতিপত্র বা লাইসেন্স দিচ্ছে?
সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো দেশের সাধারণ মানুষ এবং সংশ্লিষ্ট মহলেরও জানা। অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে, চালকদের অসাবধানতা ও অদক্ষতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ওভারটেকিং, ছোট যানবাহনের সংখ্যাধিক্য, সড়কের দু’পাশের অবৈধ অস্থায়ী দোকানপাট ও হাটবাজার, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা, অতিরিক্ত মাল ও যাত্রী বোঝাই, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক ইত্যাদি। তবে, সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ চালকের অসাবধানতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী, চলন্ত বাসে চালকের মুঠোফোন ব্যবহারের প্রবণতা এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গাড়ি চালানো। উন্নত দেশের আদলে যানবাহনে গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসালে চালকদের আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ করা যেত। আর, দোষীদের শাস্তি দেওয়া যেতো।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে লেখক সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ তাদের মতামত ব্যক্ত করে সংবাদপত্রে বড় বড় কলাম লেখেন। আর টিভি টকশোতে বিজ্ঞজনদের পরামর্শ প্রদান করতে দেখা যায়। তারা বলেন, কীভাবে দেশের মানুষের যাত্রাপথ দুর্ঘটনামুক্ত করা যায়। সরকার, রাষ্ট্র আর পরিবহন মালিক সমিতি তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি সুখকর বা শান্তিময় যানবাহন ভ্রমণ নিশ্চিত করতে পারেন তবেই মঙ্গল। দুঃখের বিষয় কোন কথাই আসলে কথা থাকে না। সড়ক দূর্ঘটনায় মানুষ মারা যাবেই। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের বাইরেও এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে অনেক মানুষের। ৫ জুন ভোর রাতে চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ান হাট ওভারব্রিজের ওপর পিকআপের ধাক্কায় মোঃ নাসির নামে এক মোটরসাইেকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। এভাবেই কতো পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে।
দেশে নানা ভাবে সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য বুয়েটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বিশেষজ্ঞ দেশচিন্তক ব্যক্তি বা নানা সংগঠন কাজ করছেন। কিন্তু এখনও তেমন একটা মুক্তির সম্ভাবনা দেখছে না সাধারণ মানুষ। যেসব সংগঠন সড়ক দুর্ঘটনা রোধ কল্পে কাজ করে তারা বড় কোন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে মানববন্ধন, আলোচনা-সভা – এসব করেই থেমে যায়। সারাদেশে বহু সংগঠন বা সংগঠক আছে। তাদের কখনোই ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে দেখা যায় নি। শুধুমাত্র গণমাধ্যমে সভা করেছে এমন ছবি প্রকাশ করাতে পারলেই যেনো সাংগঠনিক কাজ শেষ।
সড়ক দুঘর্টনা নিয়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নামে একটি সংগঠন নিজ উদ্যোগে চালকদের নিয়ে সচেতনতা সভা করেছিল কিছুদিন আগে। সেই সাথে রাষ্ট্র, সরকার বা যেসব সংগঠন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করে তাদের যৌথভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণসহ আরো বেশি সচেতনতামূলক সভা করা প্রয়োজন।
স্বপ্নভঙ্গের ফাঁদ হিসেবে পরিণত হয়েছে দেশের প্রতিটা নগরীর বা মহাসড়কের রাস্তা। একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ মানুষ প্রতিদিন গণমাধ্যামে পড়ছে আর দেখছে। এর বাস্তব কোন ধরনের সমাধান করতে পারছে না রাষ্ট্র। সাধারণ জনগণ শুধু দেখবে আর পড়বে, যারা দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে অর্থাৎ বিশেষ করে রক্ষক যখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন যাবার আর জায়গা থাকে না সাধারণের। বিআরটিএ’র কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালযের কঠোর নজরদারী না থাকায় দেশে অদক্ষ আর লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা বাড়ছে। বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধার দায়িত্ব যাদের তারাই আজ দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
সাধারণ মানুষ কতোটা সচেতন? চালকের পাশাপাশি জনগণকে সচেতন হতে হবে। কিছুদিন আগে সিএমপি সদস্যরা সাধারণ পথচারীদের হাত ধরে কিভাবে কখন রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হতে হবে, তা দেখাচ্ছিল। জেব্রা ক্রসিং আর প্রত্যেকটা নগরীর ভেতরে রাস্তা পারাপারের জন্য নানা ভাবে নির্দেশনা দেয়া থাকলেও সাধারণ পথযাত্রীরা সময় বাচানোর জন্য নিজেদের ইচ্ছে মতোই রাস্তা পার হয়। ফিটনেস বিহীন গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে ঈদ আসলে পুরাতন লক্কর ঝক্কর যাত্রীবাহী যানবাহন রং মাখিয়ে আবার রাস্তায় নামায়। দুর্ঘটনাপ্রবণ এ সমস্ত যানবাহন অতঃপর চলতেই থাকে। উৎসব আসলে সাধারণের ভালো খারাপের বিচারের সময় থাকেনা। এতে তারা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দেয় এসব যানবাহনের উপর।
গত বছর ২৯ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনায় দু’জন স্কুলশিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে সারাদেশের স্কুলপড়–ুয়া শিশুরা রাস্তায় নেমে এসে সড়কে শৃঙ্খলা তৈরির যে অনন্য নজির আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছিল, তাতে করে সকল স্তরেই মানুষের ভেতর একটা আশার জায়গা তৈরি হয়েছিল যে এবার নিশ্চয় দিন পাল্টাবে। কিন্তু ২৯ জুলাইয়ের আগে যেমন ছিল,এখনও তেমনই পরিবেশ পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে। দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করুন। তাহলে, কিছুটা হলেও সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বার্তা সম্পাদক, দৈনিক পূর্বতারা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট