চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

জীবন ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা

সঞ্জয় চৌধুরী

২০ জুন, ২০১৯ | ১:০৭ পূর্বাহ্ণ

মানুষের আচরণিক পরিবর্তনই হলো শিক্ষা। মাতৃগর্ভে ভ্রুণ সৃষ্টির পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে প্রক্রিয়া তাকে বলে জীবন আর পূর্ব অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর যে প্রক্রিয়া তা হলো দক্ষতা। জীবন দক্ষতা হচ্ছে মনোসামাজিক দক্ষতা, যা আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতে ও সমস্যা মোকাবেলা করতে এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে। এই দক্ষতাকে কখনো কখনো ব্যক্তিগত দক্ষতা, সামাজিক দক্ষতা, মানসিক দক্ষতা বা আবেগিক দক্ষতা নামেও অভিহিত করা হয়। জীবন দক্ষতা হচ্ছে অপরাপর ব্যক্তি ও সমাজের সাথে ব্যক্তির জীবন সম্পৃক্ত কাজ ও সমস্যা সুচারুভাবে সম্পাদন এবং নিষ্পত্তির দক্ষতা। এই দক্ষতা একজন শিক্ষার্থীকে তার দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবেলা করে যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে সক্ষম করে। এই দক্ষতা শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সকল শক্তি ও সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফল হওয়ার ভিত্তি তৈরি করে দেয়। জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা এমন একটি শিখন শেখানো অভিজ্ঞতা যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জীবনের প্রয়োজনীয় দক্ষতা সমূহ অর্জন করে।
আমাদের জীবন যেমন অসীম ও ব্যাপক জীবন দক্ষতাও তেমনি অসংখ্য। কিন্তু দক্ষতার মৌলিকত্ব বিবেচনায় যে দশটি জীবন দক্ষতা সনাক্ত করা হয়েছে সেগুলো অন্যান্য বহু দক্ষতার ভিত্তি গড়ে দেয়। এই দশটি জীবন দক্ষতা হচ্ছে- ১। আত্ম সচেতনতামূলক দক্ষতা, ২। সহমর্মিতার দক্ষতা, ৩। অন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা, ৪। আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা, ৫। যোগাযোগ দক্ষতা, ৬। চিন্তন দক্ষতা, ৭। সমস্যা সমাধান দক্ষতা, ৮। সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা, ৯। চাপ মোকাবেলার দক্ষতা, ১০ আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা। এই দক্ষতাগুলোই বলে দিচ্ছে যে, এগুলোর কোনটিই জীবিকা অর্জনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নয়। এগুলো একজন ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক এ ধরনের সুস্থতাই নির্দেশ করে। এ দক্ষতা একজন শিক্ষার্থীকে আত্মসচেতন ও আত্মবিশ্বাসী হতে, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সৃজনশীল চিন্তনে কার্যকর যোগাযোগ সৃষ্টিতে, সুস্থ সম্পর্ক গড়তে, অন্যের প্রতি সহমর্মী হতে এবং চাপ ও আবেগ মোকাবেলায় সামর্থ্য অর্জন করে তোলে। এর ফলে একজন শিক্ষার্থীর ইতিবাচক আচরণ আত্মস্থ করার মাধ্যমে নিজেকে দক্ষ এবং বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষার্থীকে সুরক্ষামূলক আচরণ করতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ পরিহার করতে সমর্থ করে। এটি শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও মানসিকতার মধ্যে ভারসাম্য বিধান করে শিক্ষার্থীর আচরণিক পরিবর্তন ঘটায়। এখন আমরা দু’জন সহপাঠি – মুরাদ ও রুনুর জীবনের একটি ঘটনা নিয়ে উপরোক্ত দক্ষতাগুলোর প্রয়োগ সম্পর্কে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করব।
মুরাদ ও রুনু উভয়েই নবম শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। তারা দু’জন একসঙ্গে বিদ্যালয়ে আসে এবং বিকেলে বাড়িতে ফিরে যায়। একদিন বিকেলে বাড়ি যাওয়ার পথে মুরাদ রুনুকে একটি পার্কে গিয়ে বাদাম খাওয়ার ছলে গল্পগুজব করার প্রস্তাব দিলে রুনু তা ফিরিয়ে দেয় এবং সঠিক সময়ে বাড়ি যেতে না পারলে উভয়ের মা-বাবা চিন্তিত হবে এ অভিমত মুরাদের কাছে ব্যক্ত করে। তবুও মুরাদ তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে রুনুকে আবারও পার্কে যাওয়ার প্রস্তাব করলে রুনু ২য় বার মুরাদকে মানুষের চোখে তা দৃষ্টিকটু হবে তা জানিয়ে দেয়। এতে মুরাদ তার সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে পুনরায় পার্কে যাওয়ার প্রস্তাব করলে রুনু তাকে পার্কে গেলে লেখাপড়ার সময় অপচয় হবে এবং শিক্ষক কর্তৃক শ্রেণির-বাড়ির কাজ সমাধা করতে উভয়েই বাধাগ্রস্ত হবে এ কথাটি জানিয়ে দেয়। তাছাড়া, পরের দিন শিক্ষকের কাছে এ ব্যাপারে জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে এই যুক্তিগুলো মুরাদের কাছে উত্থাপন করলে মুরাদ তার ভুলটুকু বুঝতে পেরে রুনুর কাছে পার্কে যাওয়ার প্রস্তাবটি ফিরিয়ে নেয়। নিয়মিত লেখাপড়ার প্রতি আরো অধিক মনোযোগী হয়ে দেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। উভয়েই এই প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয়।
এখন উপরোক্ত ঘটনার মাধ্যমে যে দশটি জীবন দক্ষতার চিত্র ফুটে উঠেছে তা নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করতে পারি।
১। আত্মসচেতনতামূলক দক্ষতা: এখানে মুরাদ ও রুনুর মধ্যে নিজের শারীরিক ও মানসিক সবলতা ও দুর্বলতা, গুণাবলী ও ত্রুটি সমূহ, দায়িত্ব ও কর্তব্য, অধিকার, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা, মন-মানসিকতা, জেন্ডার সংবেদনশীলতা ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট ও সঠিক ধারণা সৃষ্টির সামর্থ্যতা অর্জিত হয়েছে।
২। সহমর্মিতা: এক্ষেত্রে মুরাদের রুনুর কথা মন দিয়ে শোনার সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে সহমর্মিতার চিত্রটি ফুটে উঠেছে।
৩। অন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা: এখানে মুরাদ ও রুনু নিজের আবেগ ও চাহিদা বুঝতে পারার মাধ্যমে সততা, সত্যবাদিতা, বিনয়, সময়ানুবর্তিতা, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা ইত্যাদি গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার মন-মানসিকতায় উভয়েই অঙ্গীকারবদ্ধের মাধ্যমে অন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা প্রকাশ করে।
৪। আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা: মুরাদ কর্তৃক রুনুকে বার বার পার্কে যাওয়ার চাপ দেওয়া সত্ত্বেও রুনু নিজের যুক্তিসঙ্গত মত প্রতিষ্ঠায় অটল থাকা এবং মুরাদের অযৌক্তিক ও অনাকাক্সিক্ষত চাপ প্রত্যাখান করে রুনু নিজের বিচার-বুদ্ধির মাধ্যমে মুরাদকে বুঝানোর চেষ্টা এবং সর্বোপরি তাদের মধ্যে সহপাঠি সুলভ সম্পর্ক স্থাপন ও বজায় রাখার সামর্থ্যতার মাধ্যমে আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতার প্রকাশ ঘটেছে।
৫। যোগাযোগ দক্ষতা: মুরাদ নিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশ করার সামর্থ্যতা অর্জন করে রুনুর যুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে শোনার মাধ্যমে নিজের অনুভূতি সঠিকভাবে প্রকাশ করার মাধ্যমে যোগাযোগ দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
৬। চিন্তন দক্ষতা: পার্কে যাওয়া নিয়ে রুনুর নিজস্ব মতামত প্রদানের সামর্থ্য অর্জন ও পার্কে গেলে সময়ের অপচয় হয়ে উভয়ের লেখাপড়ার স্বাভাবিক গতি নষ্ট হবে মুরাদের মধ্যে এ নতুন ধারণা সৃষ্টির মাধ্যমে উভয়ের চিন্তন দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
৭। সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা: মুরাদ পার্কে যাওয়ার কুফল সমূহ অনুধাবন করে তার মধ্যে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে।
৮। সমস্যা সমাধান দক্ষতা: বিদ্যালয় থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে পার্কে গেলে উভয়েই ক্ষতির সম্মুখীন হবে এ চিন্তা-চেতনা রুনু মাথায় রেখে বিভিন্ন কৌশল অবম্বলন করে সহজ ও গঠনমূলকভাবে সমস্যাটি সমাধান করার দক্ষতা রুনুর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।
৯। আবেগ সামলানোর দক্ষতা: এখানে মুরাদের মানসিক অবস্থাকে রুনু যুক্তি দিয়ে বিচার করে উভয়ের মধ্যে সহজ ও ইতিবাচক সমাধানে পৌঁছানোর দক্ষতা অর্জিত হয়েছে।
১০। চাপ মোকাবেলার দক্ষতা: মুরাদ কর্তৃক রুনুকে পার্কে যাওয়ার যে চাপ এ ক্ষেত্রে রুনু তার মানসিক চাপের উৎস শনাক্ত করে সেই চাপের তীব্রতা হ্রাস করার সামর্থ্য অর্জন করেছে।
উপরোক্ত জীবন দক্ষতার উপাদানসমূহ যদি একজন শিক্ষার্থী ছাড়াও একজন সাধারণ মানুষ তাঁর ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে পারে তবে তিনি সব বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলে সুন্দর ও সাবলীল জীবন-যাপনের সামর্থ্য অর্জন করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত সেসিপের অর্থায়নে চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসের ব্যবস্থাপনায় ও মাননীয় জেলা শিক্ষা অফিসার জনাব জসিম উদ্দিন স্যারের তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী জনাব মোহাম্মদ আজিজ স্যারের দক্ষ সমন্বয়ে এবং প্রধান মাস্টার ট্রেইনার জনাব মোহাম্মদ আকরাম হোসেন স্যারের সহযোগিতায় উপরোক্ত বিষয়গুলো আলোচিত হয়। উপরোক্ত ব্যক্তিত্ববৃন্দ এবং প্রশিক্ষণ কক্ষের দু’জন প্রশিক্ষক মিসেস কমরুনিছা খানম ম্যাডাম ও বাবু বিশ্বনাথ দাশ স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রমে আশা করি, ‘জীবন-দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা’ এ প্রশিক্ষণ সব প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিস্তারের মাধ্যমে প্রত্যেকের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মপ্রতিফলন ঘটিয়ে ২০৪১ সালের আমাদের যে ভিশন তা বাস্তবায়নে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে অনন্য ভূমিকা রাখবে। আমরা সবাই, এই প্রত্যাশায় অপেক্ষায় রইলাম। দেশব্যাপী ‘সেসিপের’ অর্থায়নে মাধ্যমিক শিক্ষকদের তিন দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের আয়োজনের জন্য আমি সেসিপ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট