চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

আল্লাহ হাজীদের গুনাহ মাফ করুন, আর তাদের গুনাহ মাফ করুন যারা হাজীদের জন্য দুআ করে ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

২০ জুন, ২০১৯ | ১:০৭ পূর্বাহ্ণ

মাহে রমজানের পর নতুন এক ফাঁলি চাঁদের আলো আমাদের জীবন আকাশে প্রভাব বিস্তার করছে। ক্রমেই হারিয়ে গেল ঈদুল ফিতরের আমেজ। শাওয়ালের ৬ রোজা রাখার সৌভাগ্যও অনেকে ইতোমধ্যে লাভ করেছেন। আস্তে আস্তে মুসলিম জাহানের লক্ষ্য বিদ্ধ হচ্ছে হজ্ব অনুষ্ঠানমালার দিকে। সৌভাগ্যবান তারা যারা সময় মতো শারীরিক আর্থিক ও মানসিক সুস্থতার সময় হজ্ব সম্পন্ন করতে পারছেন। অসুস্থ বয়স্ক মানুষের জন্য কোন কালে হজ্ব সহজ পালনীয় বিষয় নয়।
বর্তমান আধুনিক যুগে আধুনিকতার নামে হজ্ব যাতায়াত কালে এমন কতিপয় নিয়মকানুন সংযুক্ত হয়েছে যা সবল হজ্বযাত্রী, হজ্ব সর্ম্পকীত এজেন্সিগুলোও নাকানি চুবানি খেয়ে ওঠে। নানা বিড়ম্বনার মধ্যেও মুমিনকে অবিচল থাকতে হয় তার দৈনন্দিন ইবাদাত রিয়াজত ও খিদমাতগুলো আনজম দিতে। আল্লাহ সুবহানাাহু তায়ালা দিন রাত মাস বছর এমনভাবে সেট করে রেখেছেন যেন তার বান্দা জন্ম থেকে বৃদ্ধি, নওজোয়ান থেকে বার্ধক্য এবং মৃত্যু থেকে আখিরাত পর্যন্ত সুশোভিত জীবন লাভ করতে পারে। দুনিয়া আখিরাতে মুক্তির জন্য কত সুন্দর ব্যবস্থাই না ইসলাম আমাদের জন্য রেখেছে।
কথায় আছে, আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝি না। তদ্রুপ সুস্থ থাকতেও অসুস্থতার যন্ত্রণাদায়ক ভবিষ্যতের কথা আমলে আনা হয়না। হায়াতের উন্মত্ততায় ভুলে বসি মৃত্যুর অনিবার্য পরোয়ানার কথা। মৃত্যুর অতীব উপলব্ধির জন্য নবীজী বলেছেন, প্রকৃত মৃত্যু আসার আগে তুমি নিজের মধ্যে একবার মরার প্রকৃত দৃশ্যপট বিনির্মাণ কর।’ যান্ত্রিক এ যুগে আমাদের সেই মহামূল্যবান উপলব্ধি অর্জনের সময়টুকু কোথায়? সবাই যেন দুনিয়ার শতভাগ প্রাপ্তির জন্য এমনকি অন্যকে ডিঙ্গিয়ে হাজার ভাগ প্রাপ্তির জন্য দিন রাতকে সমান করে ফেলেছি। প্রতিবছর প্রতিমাসেই যেন আমরা রানিংয়ে থাকি। আসলে কুরআনুর কারীমের বর্ণনামতে এ পার্থিব প্রাপ্তির প্রতিযোগিতাই আজ ধ্বংস ধর্মচর্চা, ধ্বংস ব্যক্তিত্বের পরিচিতি আর ধ্বংস দানবের পদাঘাতে বিনাশ হচ্ছে সমাজ সভ্যতা। আসুননা এ জীবন বাঁকে নিজেকে দুনিয়ার মোহন্ধতা থেকে একটু নিষ্কৃতি দেই, ভাবি পরকালের নাযাত আযাব নিয়ে, স্ত্রী পরিজন সংসারের আদর্শ ভবিষ্যত নিয়ে।
স্মর্তব্য, গত ২১/৬/১১ইং তারিখ ছিল আমার জীবনের করুণতম দিন। এমনকি আমার পরিবারের জীবনেও। এদিন চট্টগ্রাম হালিশহর কে ব্লক জি ব্লক সড়কে এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় আমি আহত হই। বিষয়টা এখন অনেকেরই জানা। জীবন বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টায় পরিবারের সদস্যবৃন্দ মুসল্লিবৃন্দ, চিন্তাশীল বন্ধুমহল আমাকে প্রথমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে এবং পরবর্তীতে ঢাকা এপোলোতে ভর্তি করান। দীর্ঘ দেড়মাস পর কোনমতে সুস্থ হয়ে ওঠার আলামত পরিলক্ষিত হয়। এ কয়দিন আমার জীবন ভিক্ষা চেয়ে মুসল্লিবৃন্দ, প্রিয়জন আলিম ওলামা, হজ্বের সময়ের আরাফাতের সাথী ভাইবোনদের সাহায্য সহযোগিতা, দেশে বিদেশে দোয়ার মাহফিল, রোজা পালন প্রভৃতির মাধ্যমে যারা অজ¯্র লোনা অশ্রু ঝরিয়েছেন, তাদের মনে আসে কিছুটা স্বস্তি। আমি নিজেও যখন হাসপাতালের বেডে হুঁশ ফিরে পাই তখন দেখি একে একে সে বছরের শবে মিরাজ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। শবে বরাত চলে যাচ্ছে। আমি নিজেকে নিয়ে এবং নিজের পরিবার নিয়ে অন্তহীন পেরেশানীর সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। অক্ষমতা ও মৃত্যুর হাতছানিতে গুণাহ ও পাপ তাপের বোঝায় যখন ভারাক্রান্ত, তখনই ক্রমাগত পরওয়ার দিগার দান করেন সাকিনা বা প্রশান্তি, শিফা বা নিরাময়, সুস্থতা।
আজ ৮ বছরের ব্যবধানে নিজেকে ৭০-৮০ভাগ সুস্থ অনুভব করার পর সেই দু:সহ স্মৃতি আমাকে নানা চিন্তা ও শিক্ষার রাজ্যে নিয়ে যায়।
প্রিয়নবী হযরত রাসূলে কারীম (স.) বলেছেন, মাই য়ুরিদুল্লাহু খয়রান ইউসিবাহু’ যাকে আল্লাহ কল্যাণ দান করতে চান, তাকে কষ্ট দেন। মহানবী (্স.) আরও ফরমায়েছেন আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে কোন মর্যাদার স্থানে উন্নীত করতে চান তখন তা হয়ে উঠেনা তার আমলের কারণে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাকে শারীরিক আর্থিক কিংবা সন্তানের দিক দিয়ে পরীক্ষায় ফেলেন। অত:পর আল্লাহ তাকে এর মধ্যে অবস্থান করান। যতক্ষণ না তার কাঙ্খিত মানযিলে পৌঁছানো হয়। (খুতবাতুল আহকাম, সবর শোকর)। আমার বিশ্বাস নানা পাপতাপই আমাদের বিপদাপদকে ত্বরান্বিত করে। এজন্য প্রতিনিয়ত তাওবা ও ইস্তিগফার, অনুশোচনা ও ক্ষমা প্রার্থনাই আমাদের আদর্শিক জীবনে মজবুত রাখতে পারে।
আমাদের জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে সমুদয় লোক দেখানো কর্ম ও ইবাদত। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত হিসাব করতে হবে আখিরাতের খাতায় কিছু জমা হচ্ছে কিনা। ইমামতি সাংবাদিকতা সামাজিক খিদমত এসব থেকে আমাদের পরকালীন পাথেয়’র প্রাপ্তির পরিমাণ কতটুকু? নামাযের প্রতিটি রাকাআতে রুকুতে সিজদাতে পরওয়ার দিগারের ক্ষমাপ্রাপ্তি ও সন্তুষ্টি খুঁজতে হবে। বান্দা যখন সিজদায় যায় আর যখন বলে ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ তখন সে আল্লাহর নৈকট্য লাভের খুব কাছেই পৌছে যায়। আমাদের নামায কালামে তাসবীহ তাহলীলে প্রাণ আনতে হবে। মৃত নামায অচেতন নামায দুনিয়া আখিরাতে ফায়দা দেয়না। আত্মোপলব্ধিমূলক আত্মপরিবর্তনমূলক খোদা তায়ালার রিজামন্দি হাসিলের জন্য সমর্পিত হৃদয়ের ইবাদত প্রকৃত বুজুর্গানে দ্বীনের চর্চিত সাধনা।
আসুন প্রিয় পাঠক, এ মৌসুমে প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং বিপদ আপদ থেকে মুক্তির তামান্নায় ফরিয়াদ করি:
‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা হুব্বাকা ওয়া হুব্বা মাইঁয়ুহিব্বুকা ওয়াল আ’মালাল লাযি ইয়ুবলিগুনি হুব্বকা, আললাহুম্মাজ আল হুব্বাকা আহাব্বা ইলাইয়্যা মিন নাফসি, ওয়ামালি ওয়া আহলি ওয়ামিনাল মা-য়িল বা-রিদ’-অর্থাৎ হে আল্লাহ খোদাওয়ান্দ কুদ্দুস! আমি আপনার ভালবাসা চাই এবং ভালবাসা চাই ঐসব আল্লাহওয়ালাদের, যারা আপনাকে ভালবাসে। আরো ভালবাসা চাই, এমন আমলের প্রতি যা আপনার ভালবাসা পর্যন্ত আমাকে পৌঁছে দেয়। হে আল্লাহ ! আপনার ভালবাসাকে আমার নিকট আমার নফস, সম্পদ, পরিবার-পরিজন এবং ঠান্ডা পানি হতেও অধিক প্রিয় করে দিন।
‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল হাম্মে ওয়াল হুযনে, ওয়াল আজযে ওয়াল কাচলে, ওয়াল জুবনে ওয়াল ভুখলি, ওয়া দ্বলয়িদ দায়নি, ওয়া গালাবাতির রিজাল’-অর্থাৎ হে আল্লাহ পরওয়ারদিগার! নিশ্চয় আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুশ্চিন্তা, পেরেশানী, অক্কমতা, অলসতা, কাপুরষতা, কৃপণতা, ঋণের বোঝা ও লোকজনের অন্যায় আধিপত্য থেকে। ( বুখারী ও মুসলিম, সূত্র: মিশকাত, পৃ. ২১৬)। ‘আল্লাহুম্মা আ-তি নাফসি তাক্বওয়াহা, ওয়াযাককাহা, আনতা খাইরুন মান যাক্কাহা আনতা ওয়ালিয়্যুহা ওয়া মাওলাহা। আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিন ইলমিন লা ইয়ানফায়ু, ওয়া মিন ক্বলবিন লা ইয়াখশাউ ওয়ামিন নাফসিন লা তাশবাউ ওয়ামিন দা’ওয়াতিন লা ইয়াছতা জা-বু লাহা’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমার নফসকে তাক্বওয়া দান করুন এবং তাকে পরিশুদ্ধ রাখুন। আপনি তো এর শ্রেষ্ঠ পরিশুদ্ধকারী এবং আপনিই তো ওলি-অভিভাবক। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট পানাহ চাই ঐ ইলম থেকে যা কোন উপকারে আসেনা, ঐ কলব থেকে যার মধ্যে আপনার ভয়ভীতি নেই, ঐ নাফস থেকে যা তৃপ্ত হয় না এবং ঐ দু’আ থেকে যা (আপনার দরবারে) কবুল হয় না।-( মুসলিম শরীফ, সূত্র: মিশকাত, পৃ. ২১৬)।
পরিশেষে প্রিয় নবীজির (স.) ভাষায় এ মৌসুমে একটি বরকতপূর্ণ দুআ করি: আল্লাহুম্মাগ ফিরিল হাজ্ব, ওয়ালিমান ইস্তাগফির লাহুম – হে আল্লাহ পরওয়ার দিগার হজ্বযাত্রীদের মাফ করে দিন আর যারা তাদের জন্য দুআ করে শুভকামনা করে তাদের গুনাহও মাফ করে দিন।’

লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট