চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

উপজেলা পর্যায়ে স্থাপিত হোক সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র

মীর নাজমিন

২৯ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:৪৮ পূর্বাহ্ণ

একটি জাতির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ এবং লালন করে দেশের সংস্কৃতি। সংস্কৃতিকে সবার কাছে তুলে ধরার বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে বই, খেলাধুলা, নৃত্য, সংগীত, কবিতা, অভিনয়, আবৃত্তি, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সাংস্কৃতিক কর্মকা-মানুষকে সজীব, সতেজ, কর্মঠ এবং শারীরিক, মানসিকভাবে সুস্থ থাকতেও ভীষণভাবে সাহায্য করে। কিছু কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকা- যেমন মানব চিত্তে বিনোদনের খোরাক জোগানোর পাশাপাশি দেহকেও ভালো রাখে, তেমনি আবার কিছু কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকা- আমাদের প্রাত্যহিক জীবনেও অনেক বেশি প্রভাব ফেলে থাকে। যেমন শিক্ষণীয় বই, নাটক, সিনেমা বা গানের কথা খুব সহজেই বদলে দিতে পারে একজন মানুষের জীবনধারা।
বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান একটি দেশ। এখনো দেশের ৭০-৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করলেও অনেকটা ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের মতোই সংস্কৃতিচর্চার প্রধানতম কেন্দ্রগুলোও এখনো জেলা শহরগুলোই সীমাবদ্ধ। হ্যাঁ, এটা সত্য যে একটা সময় কৃষিপ্রধান গ্রামের অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিবেশ এতোটাই নাজুক ছিল যে, সাংস্কৃতিক কর্মকা-গুলোকে শুধুমাত্র বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই ভাবা হতো না। যেখানে গ্রামের মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে শিল্প, সংস্কৃতির চিন্তা ছিল একেবারেই অহেতুক। তাছাড়া, সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক কর্মকা-গুলো বুঝতে হলে বা এসবের মর্ম উপলব্ধি করতে হলে যে শিক্ষার প্রয়োজন হয়, একটা সময় গ্রামের মানুষের অতোটা শিক্ষাও ছিলো না। যার ফলে শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি গ্রামের মানুষের কোন আগ্রহও ছিলো না। বা আগ্রহ থাকলেও পেটের দায়ে নুন-ভাত জোগাতে গিয়ে এসব শিল্পচর্চার সময় করতে পারতেন না। ‘সাহিত্যের খেলা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী অন্ন বা উদর চিন্তাকে একটা দ্বিতল ভবনের সঙ্গে তুলনা করে উদর চিন্তাকে এর নীচতলা আর চিত্ত বিনোদনকে উপরতলা বলেছিলেন। নীচতলা যদি ঠিক না থাকে সেখানে উপরতলার চিন্তা করবে কিভাবে? তাই তো গ্রামের মানুষ তখন তাদের নীচতলাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রথমে উদর চিন্তা করতেন।গ্রামের মানুষগুলো তখন ঐ চিন্তায় মগ্ন ছিলেন বিধায় শিল্প-সংস্কৃতি তাদের অনুর্বর মস্তিকে ধরা দেয় নি তখনও।
বর্তমানে গ্রামীণ সমাজের চিত্র পুরোটাই বদলে গেছে। আগেকার মত অর্থনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপট কোনটাই এখন নেই গ্রামে। অর্থনৈতিকভাবে এখন অনেকটাই স্বাবলম্বী গ্রামের মানুষজন। আগে যেখানে বাপ দাদার বংশানুক্রমে সবাই শুধুমাত্র কৃষি পেশায় নিয়োজিত হতো, সেখানে বর্তমান প্রজন্ম বংশানুক্রমিক সেই ধারা থেকে বের হয়ে এসে বিভিন্ন পেশায়ও যোগ দিচ্ছে। তাছাড়া আগেকার কৃষকরা যেখানে ফসল ফলানের জন্য কেবল প্রকৃতির উপরই ভরসা করে থাকতো, শিক্ষিত প্রজন্মরা সেখানে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। যার ফলে আগের মতো গ্রামীণ সেই অসচ্ছলতা এখন আর নেই।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে এসব গ্রামীণ সমাজে। মাত্র কিছুদিন আগেও যেখানে গ্রামের মানুষের শিক্ষার হার ছিল অতি নগণ্য, সেখানে এখন নীরবেই ঘটে গেছে শিক্ষা বিপ্লব। গ্রামে গ্রামে স্থাপিত হয়েছে স্কুল, কলেজ, মক্তব। সরকারিভাবে বিনামূল্যে বইপুস্তক বিতরণ করায় বেড়ে গেছে স্কুলগামী শিক্ষার্থী এবং শিক্ষার হার। বর্তমানে এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে শিক্ষার সুবর্ণ আলো পৌঁছেনি।
গ্রামের মানুষ এখন শুধু গ্রামেই নয়, শিক্ষাসহ উন্নত জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার্থে এখন অহরহ পাড়ি জমাচ্ছে শহর পানেও। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই । ফলে আগেকার সেই গ্রামীণ পরিবেশ এখন আর নেই। বেঁচে থাকার জন্য অন্নের পাশাপাশি এখন তাদেরও এখন মনের খোরাক প্রয়োজন। তারাও চায় শিল্প ও সংস্কৃতির সাথে থাকতে। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হল, তাদের মনের চাহিদা মিটানোর বা তাদের সৃষ্টিশীল, মননশীল চিন্তাভাবনাকে কাজে লাগানোর তেমন কোন ব্যবস্থাই এখনো গড়ে উঠেনি গ্রামে। এখানে নেই পাবলিক লাইব্রেরি, স্টেডিয়াম, ক্রীড়া সংগঠন, উন্নতমানের সিনেমা হল, শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি,আবৃত্তি সংগঠন এবং গান বা নৃত্য শেখার স্কুল। যেখানে গিয়ে তারা শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চা করে জোগাতে পারে তাদের মনের খোরাক। ফলে গ্রামীণ মানুষগুলোর জীবন হয়ে উঠছে একঘেয়ে আর বিরক্তিকর। এসবের অভাবে তাই অলস সময় কাটাতে হয় তাদের। ফলে পরিচর্চার অভাবে জং ধরছে গ্রামের শিশুদের মেধা আর মননে। গ্রামভিত্তিক তো নয়ই, এমনকি উপজেলা বা মফস্বল শহরগুলোতেও এধনের কোন ব্যবস্থা নেই। তার জন্য অর্থ যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনি প্রয়োজন সময়েরও। তাছাড়া শিশুদের জন্য তো আরো বেশি কষ্টের ব্যাপার।যদি কোন শিশু এসবে অতিশয় আগ্রহী হয়,তাহলে তাকে সুদূর পথ অতিক্রম করে যেতে হয় শিল্প সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র খ্যাত শহরে। এতে বাবা-মা রাজী হয়না এতোটা পথ অতিক্রম করে তার আদরের সন্তানকে করে একা একা শহরে পাঠাতে।
এখন কথা হলো, বর্তমান সময়ে শহরে থাকতে হলে যে পরিমাণ খরচাপাতির প্রয়োজন হয়, ক’টা পরিবারের সে আর্থিক সামর্থ্য আছে বা রয়েছে? যদিও বা থাকে, তবুও শুধুমাত্র এই একটি উদ্দেশ্যেই বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে ক’জনই বা শহরে থাকতে রাজী হন?আর এইসব সীমাবদ্ধতার কারণেই গ্রামের শিশুরা তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকাশ করার কোন সুযোগই পাচ্ছে না। ফলে, অনুশীলন আর পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এমন হাজার হাজার প্রতিভা।
সবকিছু বিবেচনায় রেখে গ্রাম পর্যায়ে না হলেও সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে যেভাবে প্রতিটি উপজেলা বা থানা পর্যায়ে স্কুল, কলেজ,স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপন করা হচ্ছে, তেমনি প্রতিটা উপজেলা বা থানা পর্যায়ে সরকারি উদ্যোগে অন্তত একটা করে হলেও পাবলিক লাইব্রেরি, খেলার মাঠ, শিশু একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমি ইত্যাদি স্থাপন করা হলে গ্রামের মানুষ শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চায় ব্রত হওয়ার পাশাপাশি চমৎকারভাবে অবসর যাপন করতে পারবে। গ্রামীণ শিশুরা তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন করার সুযোগ পাবে। স্বতন্ত্রভাবে না হলেও প্রয়োজনে জেলাভিত্তিক যে পাবলিক লাইব্রেরি, স্টেডিয়াম,শিশু একাডেমি বা শিল্পকলা একাডেমি রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের শাখা হিসেবে উপজেলা পর্যায়েও তাদের অধীনেই এসব কার্যক্রম পরিচালিত হোক। তাতেও উপকার হবে গ্রামীণ মানুষের। আর বেসরকারি সংগঠন বা সংস্থাগুলোও যদি এই ধরনের মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও উঠে আসতে পারে বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন সংস্কৃতিবান একেকটা সুন্দর মনের মানুষ। আশা করছি যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনা করে তা বাস্তবায়নে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট