চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

পাহাড় দখল ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস কি আদৌ বন্ধ হবে?

১৮ জুন, ২০১৯ | ১:৩৯ পূর্বাহ্ণ

ঝড়বাদলের কাল শুরু হয়ে গেছে। শনিবার বৃষ্টি নিয়েই নগরবাসীর সামনে হাজির হয়েছে বর্ষা। আষাঢ়ের প্রথম দিনের ঘণ্টাখানেকের বৃষ্টিতে সয়লাব হয়েছে নগরীর বিভিন্ন এলাকা। জলাবদ্ধতার কারণে কোনো কোনো রুটে ঘণ্টাকয়েক বন্ধ ছিল যান চলাচল। এতে জনদুর্ভোগ যেমন বেড়েছে, তেমনি ভরাবর্ষায় জলাবদ্ধতাজনিত দুর্ভোগচিন্তায় বেড়েছে জনউদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পারদও। সাথে দেখা দিয়েছে পাহাড়ধসে জনমৃত্যুর আশঙ্কাও। পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো বহাল তবিয়তে থাকায় এ আশঙ্কা জোরালো হয়েছে।
পাহাড়-নদী-সাগর বেষ্টিত বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বর্ষামৌসুম মানেই জলাবদ্ধতা আর পাহাড়ধসের পুরনো আতঙ্ক ফিরে আসা। যদিও প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বর্ষামৌসুম শুরুর আগেভাগেই নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে বসবাসকারীদের সরে যাওয়ার নির্দেশনা জারি করেছিল জেলাপ্রশাসন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। দৈনিক পূর্বকোণে শনিবার প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৯তম সভা থেকে বিভাগীয় কমিশনার গত ১৬ এপ্রিল এক মাস সময় দিয়ে নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ১৭ পাহাড় অবৈধ দখলমুক্ত করতে নির্দেশ জারি করেছিলেন। কিন্তু ২ মাস পরও সে নির্দেশ কার্যকর হয়নি। এখনো পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস রয়ে গেছে। কেউ সরেনি। এর মানে হচ্ছে, জেলাপ্রশাসন কঠোর না হলে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস থেকেই যাবে। আর ঘনবরষায় পাহাড়ধসে মর্মান্তিক মৃত্যুর আরো দৃশ্য দেখতে হবে দেশবাসীকে। এটি কি কারো কাম্য হতে পারে? কখনোই না। উল্লেখ্য, অবৈধ বসতিব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনের খামখেয়ালি এবং ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের বেপরোয়া আচরণ, সব মিলিয়ে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার অভিযান সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায় না। পরিণামে পাহাড়ধসে মানবমৃত্যুর করুণ দৃশ্য দেখতে হয় প্রতি বছর। এবার যে তার ব্যতিক্রম হবে, এমনটি ভাবা কঠিন। ফলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকেই যাচ্ছে।
পাহাড়ধসে মৃত্যু যেন একটি অপরিবর্তনীয় চক্রাকার নিয়মে পরিণত হয়েছে। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুন চট্টগ্রামে স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১২৭ জনের প্রাণহানির পর পাহাড়ধস ও মৃত্যুর মিছিল থামাতে উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছিল। তখন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত মনিটরিং কমিটি ২৮টি কারণ চিহ্নিত করে পাহাড় কাটা বন্ধ করা, সামাজিক বনায়ন, পাহাড়ের পাদদেশের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরিয়ে নেয়া, নিয়মিত অভিযান পরিচালনাসহ ৩৬টি সুপারিশ পেশ করেছিল। অপরদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পাহাড়ধস ঠেকাতে পাহাড় ও টিলা সংরক্ষণে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ কঠোরভাবে প্রতিপালন, পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস ও ভূমিক্ষয় রোধে বনায়ন, পাহাড় সংরক্ষণে টেকসই কৃষির প্রবর্তন, পানি সংরক্ষণব্যবস্থা গড়ে তোলা, ম্যাপিং, জোনিংসহ পাহাড়ি এলাকার বিস্তারিত তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা, পাহাড় সংরক্ষণ, পাহাড়ি এলাকার ব্যবহার সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, টেকসই পাহাড় ব্যবস্থাপনা, নির্বিচারে গাছকাটা বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া, পাহাড়ের গায়ে থাকা গুল্ম জাতীয় গাছ ও জঙ্গল পোড়ানো বন্ধ করাসহ বারো দফা সুপারিশ করা হয়। পার্বত্য জেলাগুলোতে ধস ঠেকাতে পাহাড়ের ঢালে সিমেন্ট ব্লক বা ঘাসের আচ্ছাদন লাগানো, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ বসতি স্থাপন নিরুৎসাহিত করতে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সংযোগ না দেয়ার সুপারিশও আছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে তেমন কোনো পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয়নি কখনো। ফলে পাহাড়ধস এবং মৃত্যুর মিছিল থামছে না।
প্রতি বছরই বর্ষামৌসুমে পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ ও জনগণকে সরিয়ে নিতে প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপ লক্ষ্য যায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। জেলাপ্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নগরীর সরকারি-বেসরকারি ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ১৭টি পাহাড়ে এখনো বসবাস করছে ৮৩৫টি পরিবার। এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এসব পাহাড়ে অবৈধভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির সংযোগও দেয়া হয়েছে। এমনকী কয়েকটি পাহাড়ে সরকারি টাকায় প্রকল্প গ্রহণ করে সড়ক ও ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। সন্দেহ নেই, এসবের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী মহল। আর তাদের দাপটেই বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উচ্ছেদ কার্যক্রম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো আইন ও নীতির প্রশ্নে অটুট থাকতে পারলে কি পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে অবৈধ বসতিবাণিজ্যের বিস্তার ঘটতে পারতো?
জেলাপ্রশাসক এবারও বলেছেন, এখন ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা হবে। উচ্ছেদ অভিযানের পর যাতে কেউ ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে ফিরে যেতে না পারে, সে ব্যবস্থাও নাকি তিনি করবেন। তার কথা ও কাজের মিল দেখাতে চাই আমরা। আমরা পাহাড়ধসে মৃত্যুর মতো আর কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা দেখতে চাই না। আমাদের বিশ্বাস, পাহাড়ধসের ভয়াবহতা থেকে মানুষকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই গ্রহণ করা হবে। একইসঙ্গে পাহাড়খেকো ও পাহাড়ের মাটিবাণিজ্যের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান দেখতে চাই আমরা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট