চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

লৌহ যুগ ঃ আর্য-সংস্কৃতি ও গঙ্গারাজ্য

নাওজিশ মাহমুদ

১৬ জুন, ২০১৯ | ১:২৫ পূর্বাহ্ণ

সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহী এবং উন্নত নাসিকার অধিকারী নর্ডিক আর্যরা ভারতবর্ষে ব্যাপক হারে প্রবেশ করে। প্রথমে প্রবেশ করে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালে। ৮০০ খ্রিস্টপুর্ব পর্যন্ত তাঁদের এই আগমন অব্যাহত থাকে। ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম এলাকা দিয়ে নর্ডিক আর্যদের একটি দল প্রবেশ করে। আরেকটি দল ইরানে প্রবেশ করে। আর্যরা ভাষাগোষ্ঠী না জাতিগোষ্ঠী এই নিয়েও এখন মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। আর্যরা মূলত ছিল পশুপালক। ঋকবেদের যুগেও পশুপালক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতো। পশুর মধ্যে গরুর মোষ ছাগলের মাংস ছিল প্রধান খ্যাদ্য। তবে আর্যদের মূলভূমি কোথায় তা নিয়ে প-িতদের মতভেদ আছে। কেউ ইউরোপে, কেউ মধ্য এশিয়া বলে দাবী করেন। তবে একটি অংশ আর্যরা আদি ভারতীয় বলেও দাবী করেন।
সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর এই দাবী দুর্বল হয়ে পড়ে। আর্যরা ভারতের প্রাচীন অধিবাসী অস্ট্রিক এবং দ্রবিড় জনগোষ্ঠীকে হয় পদানত না-হয় তাড়িয়ে দিয়ে উত্তর ভারত দখল করে। ভারতের আদি অধিবাসীদের অনার্য হিসেবে গণ্য করে এবং বর্ণপ্রথার সর্বনি¤œ বৈশ্য ও শুদ্র হিসেবে এদেরকে তাঁদের সমাজে স্থান দেয়। বাকীদের বিরাট অংশ হয় ধ্বংস হয় নতুবা দক্ষিণ ভারতে এবং পূর্ব ভারত তথা বাংলায় আশ্রয় নেয়। আর্যরা একটি উন্নত ভাষা ও সাহিত্য এবং বাহন হিসেবে ঘোড়া নিয়ে আসে। সেই সাথে ঘোড়া বাহিত রথ। আর্যরা মুলত পশুপালক হলেও নতুন ভাষা ও সাহিত্য এবং ধীরে ধীরে জীবিকার জন্য কৃষিকাজের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সেই সাথে ধাতু শিল্প, মৃৎশিল্প এবং বয়নশিল্পেও দক্ষতা অর্জন করে। আর্যদের কারণে ভারতবর্ষে নতুন গ্রামীণ সমাজ গড়ে উঠে। সেই সাথে তাঁরা অশ^মেধ যজ্ঞ বা অশ^কে জবেহ করে মাংস খাওয়ার উৎসব চালু করে। কবরের বদলে আগুনে পুড়ে সৎকার ব্যবস্থাও চালু করে। বর্ণপ্রথাও তাঁদের আমলে সৃষ্ট। তবে বিশে^র অন্যান্য স্থানের মত সর্বজনীন দাসব্যবস্থা চালু করেনি। সিন্ধু সভ্যতাতেও দাস ব্যবস্থা ছিল না। আর্য সমাজেও অনুপস্থিত ছিল। বর্নপ্রথা ছিল ভারতে দাস ব্যবস্থার বিকল্প এবং উন্নত মানের দাস ব্যবস্থা। অভিজাত পরিবারের গৃহকর্মীরা ছিল প্রায়-দাসের মত। অগ্নি উপাসনাও তাঁরা নিয়ে আসে। আর নিয়ে আসে ইন্দো-ইরোপীয় ভাষা সংস্কৃত এবং সাহিত্য। ভারতবর্ষ আসার পর তাদের হাতে রচিত হয় বেদ। যার চারটি অংশ ঋকবেদ, সামবেদ, যজুবেদ ও অথর্ববেদ ।
ঋকবেদ হলো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্য। এই গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত হলেও প্রচুর মুন্ডা ও দ্রাবিড় শব্দ রয়েছে। এই শব্দগুলি সিন্ধু সভ্যতার কারণে ঋকবেদে প্রবেশ করেছে বলে ধারণা করা হয়। ঋকবেদ ভারতবর্ষে বসেই লিখিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে অথবা পুর্নলিখিত হয়েছে। অগ্নি, ইন্দ্র ও মিত্র বরুণ এবং দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে সব প্রার্থনামন্ত্র রচিত হয়েছিল, তারই একটি সংকলন মনে করা হয়। সামবেদ হলো অনেকগুলো মন্ত্র নিয়ে গানের সুরে রচিত । যজুবেদে আছে যজ্ঞ করার নিয়মাবলী ও উপযোগী মন্ত্রাবলী। অথর্ববেদে আছে সৃষ্টি রহস্য, চিকিৎসা, বিপদ থেকে রক্ষা এবং শত্রুদমন প্রভৃতি বিষয়ে মন্ত্র।
নর্ডিক আর্যরা ছিল গৌরবর্ণ এবং এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা ছিল কালো। ফলে রং এর বৈষম্য থেকে জাতি বৈষম্য দেখা দেয়, যা পরবর্তীকালে বর্ণবৈষম্যে রূপ দিয়ে সামাজিক বৈষম্যে পর্যবসিত হয়। আর্য-সমাজ ছিল পুরুষতান্ত্রিক। ধর্ম প্রচলিত হয় মানুষের প্রাকৃতিক ব্যাখ্যার অক্ষমতা থেকে। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য প্রাকৃতিক শক্তির কাছে সাহায্য প্রার্থনা ও পূজার মাধ্যমে নিজেদের নেতৃত্ব বজায় রাখা যেমন অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তেমনি নিজেদের নেতৃত্ব, সাহস ও শক্তি অক্ষুণœ রাখতে মানসিক শক্তি অর্জনে কার্যকর ভূমিকা রাখে। ঋকবেদ যোগে মন্ত্র উচ্চারণ এবং বলির মাধ্যমে পূজা হতো। এই পূজা ব্যক্তিগতভাবে এবং সমষ্টিগতভাবেও হতো। হিন্দুধর্ম, হিন্দুসমাজ ও সাহিত্যের মূল উৎস এই বেদ। ঋকবেদের সময় ধরা হয় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত। এরপর শুরু হয় পরবর্তী বেদের যুগ। প্রতিটি বেদের দুটি অংশ একটি সংহিতা পদ্যে এবং আরেকটি ব্রাহ্মণ গদ্যে। প্রথমে সভা ও সমিতির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলেও পরে একক ক্ষমতার রাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।
ঋকবেদের যুগে আর্যরা তাঁদের পূর্ব সংস্কৃতি বজায় রাখলেও পরবর্তী বেদ যুগে ( ১০০০-৫০০ খৃস্টপূর্ব) এসে ভারতীয় আদিবাসীদের থেকেও নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে বিন্যাস করে। চালু করে বর্ণপ্রথা। লৌহ যুদ্ধাস্ত্রের সরবরাহ বড়ে যায় এবং খাদ্য উৎপাদনেও উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হয়। জঙ্গল পরিষ্কারে লোহার ধারালো কুঠার ব্যবহারের ফলে নতুন নতুন ভূমি সহজ লভ্য হয়ে পড়ে। আর্যরা সরাসরি উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে। ফলে ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রের ব্যাখ্যাদাতা ও রক্ষক হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষত্রিয়দের রাজকার্য চালাবার পদ্ধতি চালু করে। বৈশ্যরা ব্যবসায়ী ও শূদ্ররা কৃষি-শ্রমিক হিসেবে পরিগণিত হয়। পশুপালন সমাজের সাথে কৃষিসমাজের সমন্বয় করা হয়। পশু শুধু মাংস খাওয়া এবং যানবাহনে ব্যবহারের পাশাপাশি এদের দুগ্ধ খাওয়ারও প্রচলন হয়। ফলে দুগ্ধ দোহন এবং খাদ্যের ব্যবহারে মাংস, কৃষিপণ্যের সাথে দুধও গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হয়ে উঠে। সেখান থেকে গোয়ালা বা যাদব গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসেবে গণ্য হয়। উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে যাদবদের প্রাধান্য তারই সাক্ষ্য বহন করে। দুধের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে গাভীকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। কৃষিকাজ অব্যাহত রাখতে ও দুধের সরবরাহে পশু ব্যবহার যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় খাদ্য হিসেবে গোমাংসের উপর নির্ভরতা কমতে কমতে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। কৃষিকাজকে হীন কাজ হিসেবে গণ্য করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের বৈশ্য ও শুদ্রতে নামিয়ে দেয়া হয়। আর্যদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বর্ণ-মর্যাদাটি নিজেদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর বেদের সাহিত্য ভারতের আদি জাতিসমূহের ধ্যানধারণাও আত্মসাৎ করে। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে পূর্বতন অগ্নি, ইন্দ্র, মিত্র ও বরুণের বদলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব (মহাদেব) এই ত্রি-দেবতা তত্ত্ব উদ্ভাবিত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বছর পূর্বে পা-ব ও কৌরবদের আঠার দিনব্যাপী সংঘটিত কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ নিয়ে মহাকাব্য মহাভারত এবং রাবণ কর্তৃক অপহৃতা সীতা উদ্ধারের রামের অভিযানের বীরগাথা নিয়ে মহকাব্য রামায়ণ লেখা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ বছর পরে। এই মহাকাব্য দুটিতে দুটি ধারা প্রবাহিত। একটি বেদের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারা, আরেকটি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব নিয়ে ত্রি-দেবতার তত্ত্ব ধারা। গ্রীস মাইথোলোজী বা পুরাতত্ত্বের ভাবধারার সাথে মহাকাব্যদ্বয়ের অপূর্ব মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই দ্বিতীয় ধারাটি পূর্বতন ঐতিহ্যের সাথে সমন্বয় করে বিকশিত হিন্দুধর্মের প্রধানধারায় রূপান্তরিত হয়। এই দুই মহাকাব্যে বিষ্ণুকে প্রাধান্য দিয়ে সৃষ্টি, রক্ষা এবং ধ্বংসের সক্রিয় দেবতা হিসেবে উপাস্থাপন করা হয়েছে। যা বাংলায় বৈষ্ণবধারা সৃষ্টিতে রসদ যুগিয়েছে। পরবর্তীকালে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের মধ্যে সৃষ্টি, রক্ষা ও ধ্বংসের দায়িত্ব সমভাবে বণ্টিত হয়েছে। বৈদিক সাহিত্য ও মহাকাব্য-সাহিত্য আর্যদের হাতে রচিত অমূল্য সম্পদ। তার প্রভাবে সৃষ্ট নতুন সমাজবিন্যাসকে ভারতীয়দের কাছে অপরিহার্য করে তোলে। এখন পর্যন্ত এই প্রভাব থেকে ভারতীয়সমাজ বেরিয়ে আসতে পারে নি। তবে এই আর্যদের আরেকটি বড় কৃতিত্ব ভাষা হিসেবে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা সংস্কৃত ভাষার প্রচলন। বাংলা ভাষা গড়ে উঠেছে এই সংস্কৃত ভাষা ও প্রাকৃতিক ভাষার অপভ্রংশ থেকে।
বর্ণপ্রথার ভিত্তিতে সমাজে ব্রাহ্মণ আধিপত্য ক্ষত্রিয়রা মেনে নিতে পারছিল না। তারই প্রতিক্রিয়ায় জৈন ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ঘটে। জৈন ধর্মের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বর্ধমান মহাবীর (জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০-৫২৭ বৈশালীতে) এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধ ( জন্ম ৫৬৭ খ্রি. পূ. নেপালের লুম্বিনীতে) উভয়ে ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের অকুন্ঠ সমর্থন পেয়েছিল জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম।
ব্রোঞ্জ যুগের পরেই মানবসভ্যতা প্রবেশ করে লৌহ যুগে। লৌহ আবিষ্কারের ফলে মানবসমাজে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। অস্ত্রের প্রসার ঘটে। তলোয়ার, লোহার কুঠার, বর্শার ফলা এবং তীরের ফলার উৎকর্ষ ঘটে। ব্রোঞ্জের বদলে ব্যাপক হারে লোহার ব্যবহার শুরু হয়। বিশুদ্ধ লোহা হিসেবে প্রথম ব্যবহার শুরু হয় মেসোপটেমিয় সভ্যতায় ৫০০০ বছর খ্রিস্টপূর্বে। এর পূর্বে তামার সাথে লোহা মিশ্রিত হিসেবে পাওয়া যেত। ভারতের লোহার সাহায্যে বিম্বিসারের নেতৃত্বে প্রথম বড় রাষ্ট্র হিসেবে মগধের উত্থান ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ , পঞ্চম, চতুর্থ শতাব্দীতে ভারতে অনেকগুলি রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। ছোট ছোট রাষ্ট্রসমূহের নিজেদের মধ্যে সংঘাতে মগধের উত্থান সহজ হয়ে পড়ে। কারণ হচ্ছে, মগধের প্রথম দিকের রাজধানী রাজগীরের কাছে প্রচুর লোহার সহজ প্রাপ্যতা। ফলে উন্নতমানের অস্ত্রের সাহায্যে বাকী সকল ছোট রাষ্ট্রসমূহকে পরাজিত করে রাজা বিম্বিসার (৫৪৪-৪৯২ খ্রিস্টপূর্ব) মগধের উত্থান ঘটান। পিতাকে হত্যা করে তার পুত্র অজাতশত্রু (৪৯২-৪৬০ খ্রিস্টপূর্ব) শাসনভার নেন। তিনি লিচ্ছবীদের স্বাধীনতা খর্ব করেন। এরপর তার পুত্র উদয়ন শাসনভার নেন (৪৬০-৪৪৪)। যোগাযোগের সুবিধার কথা চিন্তা করে পঞ্চম শতকে রাজধানী পাটালিপুত্রে স্থানান্তরিত হয়। এর পর নাগবংশের উত্থান ঘটে। এরপর নন্দ বংশ মগধের সিংহাসন দখল করে। আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় এই নন্দরা ক্ষমতায় ছিল।
বৈদিক সংস্কৃতির বাহক নর্ডিক আর্যরা বিদেহী বা মিথেলী পর্যন্ত এসে থমকে যায়। কারণ বাংলার অঞ্চলের লোকেরা মাছ খেত। আর আর্যরা মাংস খেত, গরুর মাংস খেত। এই অঞ্চলের লোকেরা সম্ভবত দুধ খেত। এই কারণে মাতৃভক্তি রূপে গরুর মাংস খেত না। শ্রদ্ধা করতো। ঐ সময়ে বাংলা অঞ্চল ছিল আর্যপ্রভাবের বাইরে। আর্যরা তাঁদের ছাড়া বাকীদের অনার্য বা শুদ্র নীচ, অসুর ও দস্যু নামে অভিহিত করতো। তখন এই অঞ্চলে কোন্ ভাষার প্রচলন ছিল জানা যায় না। দ্রাবিড় ও অস্ট্রিকরা নিজেদের ভাষায় কথা বলতো। তবে, মহাভারত এবং রামায়ণে বাংলা দেশের অধিবাসীদের সম্পর্কে কোন নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করা হয় নি। এটাও হতো পারে বাংলার পরাক্রমশালী গঙ্গারাজ্যের সাথে তাঁদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। অথবা, আর্যদের বর্ণপ্রথা বা ভাষাকে গঙ্গারাজ্য স্বাগত জানিয়েছিল। এটাও হতে পারে, সকলের গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য কারো সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয় নি। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করে বহুধাবিভক্ত পাঞ্জাবকে পরাজিত করে যখন ভারতের পূর্ব থেকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করছেন তখন প্রাসিও ও গঙ্গারাষ্ট্রের শৌর্যবীর্য ও পরাক্রমশালী বিশাল বাহিনীর সংবাদে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। প্রাসিও রাষ্ট্রটি নন্দ সম্রাাজ্য বলে অনেকে মনে করেন। তবে গঙ্গারাষ্ট্র সম্পর্কে বিশদ কোন বিবরণ জানা যায় না। ভারতীয় সাহিত্যে গঙ্গারাষ্ট্রের কোনো সংবাদ পাওয়া যায় না। এটা জানা যায় বিদেশেী সাহিত্য থেকে। মিশর , গ্রীক এবং রোমান সাহিত্যে তাদের সাথে বাণিজ্য সম্পর্কের কারণে। সেখান থেকে অনুমান করা হচ্ছে নি¤œ বঙ্গে গঙ্গা নদীর মোহনায় গাঙ্গে বলে একটি বন্দর ছিল। তবে রাজধানী কোথায় ছিল সে সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট করে জানা য়ায় না। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে চব্বিশ পরগনার দেগঙ্গা থানার চন্দ্রকেতুগড়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী ছিল বলে অনুমান করা হচ্ছে।
তবু গঙ্গারাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল। এটা নিয়ে কারো সন্দেহ নাই। তবে তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পাওয়া যায় নি। এখন কারা শাসন করতো, কিভাবে শাসন করতো, কোথায় রাজধানী ছিল, সমাজ জীবন কি ধরনের ছিল, সবকিছু – অস্পষ্ট। তবে এটা সত্যি এই অঞ্চলে অধিবাসীরা সমুদ্র বাণিজ্যের উপর নির্ভর করতো বিদেশী বণিকেরা এখানে আসতো উপনিবেশ স্থাপন করতে। আবার, এখানকার অধিবাসীরা বিদেশে গমন করে উপনিবেশ গড়ে তুলতো। নদী ও সাগরই ছিল তাদের ব্যবসা বাণিজ্য এবং জীবনাচারেরও প্রধান অবলম্বন। এই নদী ও সাগরের ভাঙ্গা-গড়ার কারণে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাঁর অতীত ইতিহাস। বিদেশী ইতিহাস থেকে জেনেই যে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে! এই কৌতুহল থেকে একদিন প্রকৃত ইতিহাস হয়তো জানা যাবে। গঙ্গারাষ্ট্রের শৌর্যবীর্যের ইতিহাস প্রকাশ পাবে। জানা যাবে আলেকজান্ডার কেন তাঁদের ভয়ে তার অভিযান বন্ধ রেখেছিল। তাঁর পূর্ব পর্যন্ত রহস্য হিসেবেই থেকে যাবে।

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট