চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

লক্ষ্য সমৃদ্ধ বাংলাদেশ : যুগ-চাহিদা পূরণে প্রস্তাবিত বাজেট কতোটুকু সক্ষম?

১৫ জুন, ২০১৯ | ১:২৭ পূর্বাহ্ণ

‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ স্লোগানকে সামনে রেখে জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনে পেশকৃত এই বাজেট শুধু ১ বছরের জন্য নয়, তৈরি করা হয়েছে ২০৪১ খ্রিস্টাব্দকে টার্গেট করে। সংগতকারণে বলতে হয়, এ বাজেট প্রস্তাবে উন্নয়ন-সমৃদ্ধির পথ ধরে বাংলাদেশের দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার পথকে মসৃণ করা লক্ষ আছে। তবে প্রবৃদ্ধিতে অসমতা, বিনিয়োগ সংকট, সুশাসনের ঘাটতি, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা, অর্থনীতির আকারে রাজস্ব আদায় কম হওয়া, বৈদেশিক লেনদেন ঘাটতিসহ নানা কারণে এ বাজেট সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হবে।
‘স্মার্ট বাজেট’ হিসেবে পরিচিত এই বাজেটপ্রস্তাবে দেখা যায়, বেতন-ভাতা, ভর্তুকি, সুদ, পেনশন ইত্যাদি নিয়ে গঠিত অনুন্নয়ন খাতে সরকারের বরাদ্দ মোট বাজেটের শতকরা প্রায় ৫৯ দশমিক ৫ শতাংশ। আর বাকি শতকরা প্রায় ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে দেশের উন্নয়ন খাতগুলোতে। বাজেটে উন্নয়ন খাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। বাজেটে কাস্টমস আইন ও আয়কর আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন এনে সহজবোধ্য ও ব্যবসাবান্ধব করা, সব আমদানি-রফতানি পণ্য শতভাগ স্ক্যানিং করা, শিক্ষা ও আর্থিক খাত সংস্কার, শেয়ার বাজারে সুশাসন ও প্রণোদনা প্রদান বিষয়ে দিকনির্দেশনা আছে। বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ। এছাড়া নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ৫.৫ শতাংশে আটকে রাখার পরিকল্পনা আছে। প্রথমবারের মতো উদ্যোগ থাকবে বেকারদের ‘স্ট্যার্ট আপ ফান্ড’ নামে একটি তহবিলের। ১০০ কোটি টাকার এ তহবিল থেকে স্বল্পসুদে সহজশর্তে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন নতুন উদ্যোক্তারা। তবে এই ফান্ড হাজার কোটি টাকার বেশি হলেই ভালো হতো। শিক্ষার ওপরও বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রবাসীদের জন্য বীমা সুবিধার প্রস্তাবও আছে। বিস্তৃত করা হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাতাও বেড়েছে। নারী বাজেটের সাথে যুক্ত করা হয়েছে শিশু বাজেটও। প্রবীণদের সুরক্ষায়ও আছে নির্দেশনা। আছে গ্রামগুলোকে শহরের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার চেষ্টাও। ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা দূরীকরণেও আছে কিছু প্রস্তাবনা।
ধরা হয়েছে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঙ্কের ভ্যাট বা মূসক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা। এতে কিছু খাতে কর অব্যাহতি, কিছু খাতে কমানোর প্রস্তাব করা হলেও আওতা ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। ভ্যাটের অভিন্ন হারের পরিবর্তে ৫, সাড়ে ৭, ১০ এবং ১৫ শতাংশ হারে চারটি স্তর করা হয়েছে। তবে ভ্যাটের স্ট্যান্ডার্ড বা আদর্শ হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ শতাংশ। যারা ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দেবে, তাদের রেয়াত সুবিধা বা ক্রেডিট দেয়া হবে। আর ১৫ শতাংশের নিচের স্তরগুলোতে কোনো রেয়াত থাকবে না। এটি বৈষম্যমূলক। এতে পণ্য ও সেবার খরচ বাড়ার কারণে ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়ার শঙ্কা আছে। ভ্যাট আদায়েও জটিলতা তৈরি হবে। নতুন আইনে সংকুচিত মূল্যভিত্তি বাতিল করায় সেবার বেশ কয়টি খাতে খরচ বাড়বে। অন্যদিকে, ট্যারিফ মূল্যের ভিত্তিতে ভ্যাট আদায় করার নিয়ম তুলে দিয়ে বাজার মূল্যের ওপর ভ্যাট আদায় করার নিয়ম চালু করায় বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়বে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনে খরচের চাপ তৈরি হবে। শিল্পে বিনিয়োগের জন্য মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার প্রস্তাবও দেশের জন্য হিতকর হবে কিনা প্রশ্ন আছে। ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ার কারণে ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও দুর্বল হয়ে যাবে। বাজেটে সংবাদপত্রশিল্পের জন্যও নেই কোনো সুখবর। আন্তর্জাতিক বাজারে নিউজপ্রিন্টের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, স্থানীয় উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে সংবাদপত্রের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। ফলে বর্তমানে সংবাদপত্রশিল্প গভীর সংকটে আছে। সংকট থেকে উত্তরণে সরকারের তরফ থেকে শুল্ক ও কর ছাড়ের বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাজেট প্রস্তাবনায় এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই।
যদিও ধনীদের জন্য আরও উদার হয়েছেন অর্থমন্ত্রী, তবে বাজেটে গরিবদের তুষ্ট করার নানা পদক্ষেপ থাকলেও অনেক পদক্ষেপ মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে চাপে ফেলবে। বাজেটের আকার বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়। সে তুলনায় মধ্যম ও সীমিত আয়ের মানুষের আয় তেমন বাড়ছে না। সংসারের ব্যয় মেটাতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে নামতে হয় মধ্যবিত্তশ্রেণিকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। আবার প্রতিবছরই বছরের মাঝামাঝি গিয়ে বাজেট কাটছাঁট করতে হয়। যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির কথা বাজেটে উল্লেখ করা থাকে, তা বাস্তবায়িত হয় না শুধু সক্ষমতার অভাবে। তবে এবার এমনটি হবে না, তা আশা করতে চাই আমরা। একইসঙ্গে যেসব বিষয় গরীব ও মধ্যবিত্তশ্রেণিকে চাপে ফেলবে সংশোধিত আকারে বাজেট চূড়ান্ত করার আগে সেসব বিষয়ও বিবেচনায় নেয়া দরকার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট