চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

বাংলাদেশের ২০১৯-২০ সালের বাজেট এবং কিছু প্রস্তাবনা

অধ্যাপক ড. নারায়ণ বৈদ্য

১৪ জুন, ২০১৯ | ১:০২ পূর্বাহ্ণ

বাজেট শব্দটি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের নিকট পরিচিত। কারণ সরকার যখন বাজেট ঘোষণা করে তখন আম-জনতা প্রচন্ড আতংক অনুভব করে। তাঁরা মনে করে বাজেট মানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস, আর্থিক অবস্থার ক্রমাবনতি। ফলে আম-জনতা খুব ভয়ে ভয়ে বাজেটকে অবলোকন করে। একজন সচেতন ব্যক্তি যখন বাজেট ঘোষণার পর তা পত্রিকায় পড়তে শুরু করে তখন উক্ত ব্যক্তি তথা চাকুরীজীবীর কান দিয়ে গরম গরম বাতাস বের হয়, কপাল কুঁচকে দীর্ঘশ^াস ফেলে মনে মনে বলে এবারও বুঝি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেল। অপরপক্ষে ব্যবসায়ী শ্রেণী এতে আতংকগ্রস্ত হয় না। বরং মনে মনে বেশ খুশি হয়। কারণ বাজেটের মাধ্যমে পণ্যের দাম বৃদ্ধি মানে ব্যবসায়ীর পকেটে অতিরিক্ত প্রাপ্তি যা ব্যবসায়ী মহলের চেহারাকে আরো সুন্দর করে দেয়।
সরকারি বাজেটের সুবিধা নিয়ে কতদিক থেকে যে ব্যবসায়ীর আয় বৃদ্ধি পায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাজেট ঘোষণার পর থেকে ব্যবসা বাণিজ্যে, জীবনযাত্রায় নানা ধরণের প্রভাব পড়ে। বাজেটের দিকনির্দেশনার নানা কার্যক্রমে, কোন না কোন পক্ষ লাভে, আবার কোন না কোন পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ততায় বা সর্বনাশে পতিত হয়। অথচ সবাইকে নিরবচ্ছিন্ন ও টেকসই উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়াই প্রত্যেক বাজেটের মূল লক্ষ্য। সরকারের ভিশন ২০২১-৪১ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখছে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশে রূপান্তরিত হবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সরকার নেতৃত্ব দিচ্ছে। অবশ্য, এর মধ্যে বেশ কিছু অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি, কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রগতি, সিনিয়র নাগরিকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা, অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নয়ন ইত্যাদি। কিন্তু অর্থনীতির অগ্রগতি বিভিন্ন খাতের সাথে জড়িত। অন্যান্য খাতের অগ্রগতি হলেও এখনো বেশকিছু খাতের বা বিষয়ের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হয়নি। যেমন- মাদক, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি খাতে রয়েছে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাজেটকে পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য দুইটি বিষয় বিবেচনা করতে হয়। এদের একটি হয় আর্থিক ব্যবস্থাপনা আর অন্যটি হয় আইনগত কাঠামো। বাজেট ঘোষণায় আর্থিক বিষয়াদির বিশ্লেষণ থাকলেও আইনি কাঠামোর তেমন বিশ্লেষণ নেই। বাজেটের কাঠামোগত দুর্বলতা নিয়ে একশ্রেণির শিল্পপতিরা বিদেশে টাকা পাচার করছে। এতে দুইদিকে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই পাচারকারীরা দেশে স্থাপিত শিল্প কারখানাকে আস্তে আস্তে বন্ধ করে দেয়। আর বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দ্বারা স্ত্রী-পুত্র পরিবার নিয়ে বিদেশে বসবাস করা শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে কানাডায় ‘বেগম পাড়া’ সৃষ্টি হয়েছে। এরূপ টাকা পাচারের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে বন্ড সুবিধা। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার দেশের ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে একটি অভিশাপ। এর অপব্যবহারে প্রায় দুই হাজার শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ডের অপব্যবহারের কারণে সরকার বছরে এক লাখ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে গার্মেন্ট ও প্যাকেজিং শিল্পে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ঠেকাতে হবে। অন্যথায় দেশের সম্ভাবনাময় বস্ত্র, কাগজ, প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের বাজেটে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করা খুবই প্রয়োজন তা নি¤েœ তুলে ধরা হলো-
১) শুধুমাত্র বন্ড সুবিধা নিয়ে যে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে তা নয়। আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে। ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পাশ্চাত্যের আরো দেশে ‘বেগম পাড়া’র পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
২) সঞ্চয়পত্রে উচ্চ সুদের হার বলবৎ রয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে মোট বিক্রীত সঞ্চয়পত্রের ৯০ শতাংশ হলো সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তারা- তা সত্য বলে মনে হয় না। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক (চট্টগ্রাম) ও জিপিও-তে গেলে বুঝা যায় এদেশের সাধারণ জনগণ যাঁরা আগে স্কুলে কলেজে বা অন্যান্য অফিসে কর্মকর্তা বা চাকুরীজীবী ছিল তারাই সঞ্চয়পত্রের সুবিধা ভোগ করছে। যেহেতু তাদের বয়স ৬৫ বছরের উর্ধ্বে সেহেতু তাদেরকে সিনিয়র সিটিজেন বলা যায়। সুতরাং এই সিনিয়র সিটিজেনের ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুবিধার্থে সঞ্চয়পত্রের বর্তমান হার বজায় রাখা উচিত। দেশের সাম্য অবস্থা তথা সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধির জন্য প্রত্যেক দেশ এরূপ নানা সুবিধা সিনিয়র সিটিজেনদের ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দিয়ে থাকে।
৩) সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্তি হওয়ার কাছাকাছি। এতোদিন পর্যন্ত বিদেশ থেকে স্বর্ণ আমদানিতে কোন লাইসেন্স বা পারমিট প্রদান করা হয়নি। তাহলে বাংলাদেশে বিভিন্ন মার্কেটে এত সুন্দর সুন্দর স্বর্ণের দোকানে এত স্বর্ণ আসলো কোত্থেকে? এ ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি জরিপ পরিচালনা করি। এতে দেখা যায় সব স্বর্ণ ব্যবসায়ী স্বীকার করেছে যে, স্বর্ণ আমদানির কোন বৈধ অনুমোদন নেই। তাহলে কি আমরা বলতে পারিনা- বাংলাদেশের বাজারে অবস্থানকৃত সব স্বর্ণ অবৈধ পথে আসছে! বর্তমানে স্বর্ণ আমদানি নীতি ঘোষণা করায় এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তবে আমদানিকৃত স্বর্ণ যাতে পাশর্^বর্তী দেশে পাচার হয়ে না যায় তার ব্যবস্থা বাজেটে উল্লেখ থাকতে হবে।
৪) সরকার কর্তৃক বলা হয় যে, ব্যাংকের সুদ এক ডিজিটে আনা উচিত। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তা মানতে রাজি নয়। বর্তমানে কোন কোন ব্যাংকের সুদ ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ ধার্য করা হয়েছে। অথচ ব্যাংকগুলোতে সরকারি ডিপোজিট ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। বাস্তবতায় এ উদ্যোগের সুফল জনগণ ভোগ করতে পারছে না। বাজেটে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট ঘোষণা থাকতে হবে।
৫) উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় বেশি হলে অর্থনীতির ওপর এর ঋণাত্মক প্রভাব পড়ে। রাস্তা নির্মাণে অন্য দেশের তুলনায় ২০ গুণ বেশি ব্যয় হয় বাংলাদেশে। প্রয়োজনবোধে ব্যয় কমানোর জন্য রাস্তা নির্মাণের দায়িত্ব বিদেশী কোন কোম্পানীকে দেয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখতে হবে।
৬) ব্যাংকের তারল্যসংকট নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। বলা হচ্ছে তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারছে না। এ সমস্যার সমাধান বাজেটে প্রতিফলিত হতে হবে।
৭) ভূমি ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে। এ দুর্নীতি কমানোর জন্য ভূমি ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল করতে হবে। বাজেটে এর জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। যদিও এর মধ্যে ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
৮) ব্যাংক সাধারণত সম্পত্তির কাগজপত্র ও দখল ভালভাবে দেখে সেই সম্পত্তির বিনিময়ে (মর্গেজ) ঋণ প্রদান করে। তাতেও আইনের ফাঁকে বা দায়িত্বের অবহেলায় ঋণগ্রহীতারা সুযোগ বুঝে ঋণ খেলাপী হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়মের পরিবর্তন করতে হবে। তাছাড়া করপোরেট গ্যারান্টির বিপরীতে ঋণ প্রদান বন্ধ করতে হবে।
৯) আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাল করতে হবে। এর জন্য বাজেটে অর্থ বরাদ্দ থাকতে হবে।
১০) ব্যাংকের তারল্যসংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে চায় না। চলতি অর্থবছরে ১০ মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২.১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। তারল্যসংকটের একটি সমাধান বাজেটের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।
১১) ২০ মে (২০১৯) আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর না করলে সরকারি আমানতের যোগান দেয়া হবে না। অথচ একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের জন্য সুদ ধার্য করেছে ১৬-১৮ শতাংশ। বাজেটে এই ব্যাপারে একটি স্পষ্ট ঘোষণার প্রয়োজন।
১২) খেলাপী ঋণ পরিশোধ করার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডে সেই দায় পরিশোধ করতে পারবে। যারা ডাউন পেমেন্ট দেবে না সেইসব ঋণখেলাপীদের সম্পর্কে বাজেটে স্পষ্ট ঘোষণা থাকতে হবে।
১৩) জমি বা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতাকে উচ্চমূল্যে তা রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এর ফলে ক্রেতা প্রকৃতমূল্য গোপন করে কম মূল্য দেখায়। ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। রেজিস্ট্রেশন ফি যদি কমানো হয় তবে সরকারি রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
১৪) বাজেটে গ্যাসের দাম বাড়ানোর একটি গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে। এতে আম-জনতা আতংকিত হয়ে পড়ছে। এর ফলে সরকার জনপ্রিয়তা হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে জনগণ আশা করে যাতে গ্যাসের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা হয়।
১৫) বর্তমানে দেশের জিডিপিতে আবাসন খাতের অবদান প্রায় ৭ শতাংশ। এর সাথে প্রায় ৬০ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ জড়িত। আবার অনেক শিল্পও এর সাথে জড়িত আছে। এই খাতে স্থবিরতা চলছে। এ স্থবিরতা কাটিয়ে উঠার জন্য ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের বাজেটে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন।
বাজেট হয় একটি অর্থনীতির জন্য এক বৎসরের আয় ও ব্যয়ের খতিয়ান। এখানে সব বিষয়ের নির্দেশনা থাকে। এত স্বল্পপরিসরে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবুও সরকারের নিকট প্রত্যাশা অন্ততঃ এটুকু বিবেচনায় এনে বাজেটকে গণতান্ত্রিক বাজেটে রূপান্তর করা হোক।

লেখক : ট্রেজারার, বিজিসি ট্রাষ্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট