চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রসঙ্গ : রোহিঙ্গা ও মক্কা আল মোকাররমা শীর্ষ সম্মেলন

১৩ জুন, ২০১৯ | ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ১৪তম সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা খুবই তাৎপর্যবহ। পবিত্র মক্কা নগরীতে অনুষ্ঠিত ‘মক্কা আল মোকাররমা শীর্ষসম্মেলন : ভবিষ্যতের জন্য একসঙ্গে’ শীর্ষক এই সম্মেলনে তিনি প্রতিকূল অর্থনৈতিক, প্রতিবেশ ও নিরাপত্তার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো লক্ষে ওআইসি সদস্যরাষ্ট্রসমূহকে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়প্রাপ্ত ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মিয়ানমারে সম্মানজনক পুনর্বাসনে ও তাদের আইনগত অধিকার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) মামলা রুজুর বিষয়ে সকলের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, রাজনৈতিকসহ সব ধরনের সহযোগিতা কামনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানে তাৎক্ষণিক সাড়াও মিলেছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওআইসি। এটি আমাদের জন্যে একটি প্রত্যাশিত সুখবর, সন্দেহ নেই। এতে রোহিঙ্গাসমস্যা নিরসনের পথ মসৃণ হবে নিশ্চয়ই।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে দেয়া ভাষণেও মিয়ানমারের রাখাইনে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং রোহিঙ্গাসমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিশ্বসংস্থার ১৯৩টি সদস্যদেশের প্রতিনিধিদের সামনে মাতৃভাষা বাংলায় দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটি ছিল আবেগঘন, একইসঙ্গে রোহিঙ্গাসংকটসহ বিশ্বব্যাপী অভিবাসন ও শরণার্থীসমস্যা মোকাবেলার প্রশ্নে দিকনির্দেশনামূলক। তাঁর ভাষণে বিশ্বের শান্তিকামী মানবতাবাদী মানুষের আকুতিই প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। তিনি রাখাইন রাজ্যে অবিলম্বে সহিংসতা ও রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন নিঃশর্তভাবে বন্ধ করে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে সুনির্দিষ্ট পাঁচদফা প্রস্তাবভিত্তিক একটি রোডম্যাপ পেশ করেছিলেন। প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এই লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলা, রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এসব প্রস্তাবে সারাবিশ্বের বিবেকবান মানুষদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে, সন্দেহ নেই। তবে রোহিঙ্গাসংকট নিরসনে এ রোডম্যাপ অত্যন্ত সময়োপযোগী, বাস্তবানুগ, দুরদর্শী এবং যথার্থ বলে বিবেচিত হলেও দুঃখজনকভাবে এ ব্যাপারে জাতিসংঘের কাক্সিক্ষত তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি।
এবার বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আইনগত অধিকার নিশ্চিত করতে আইসিজে-তে মামলা রুজুর বিষয়ে ৫৭টি মুসলিম সদস্যরাষ্ট্রের সংস্থা ওআইসি’র সহযোগিতা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী। সাড়াও মিলেছে। মামলা রুজু ও পরিচালনার জন্যে তহবিল সংগ্রহ এবং কারিগরি সহযোগিতাসহ নানা বিষয়ে সহযোগিতা করবে ওআইসি। ওআইসি’র সাড়া দেয়ায় জবাবদিহি ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে রোহিঙ্গাদের আইনগত অধিকার নিশ্চিতের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হলো। বলতে দ্বিধা নেই, যখন একটি দেশে জাতিগত নিপীড়ন চলে, তখন জাতিসংঘ, ওআইসিসহ বিশ্বসম্প্রদায় নীরব থাকতে পারে না। বাংলাদেশ মানবিক কারণে নির্যাতিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিশ্বসম্প্রদায়েরও দায়িত্ব আছে। মিয়ানমারের ছলচাতুরি ও অনিহার প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের সম্মান ও মর্যাদার সাথে স্বদেশে ফিরে যেতে বিশ্বসম্প্রদায়ের বলিষ্ঠ ভূমিকার বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের বিষয়টি উঠে এসেছে বিস্তারিতভাবে। জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সেদেশে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ ও বিতাড়নে সেনাবাহিনীর সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ও দায়দায়িত্বের কথা তুলে ধরা হয়েছে। গণহত্যায় সেনাপ্রধানসহ অন্তত ছয়জন জেনারেলকে বিচারের আওতায় আনার কথাও বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অথবা সমমানের কোন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। পাশাপাশি সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়ায় মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর তথা সরকারপ্রধান আউং সান সুচিকেও দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
সংগতকারণে সব তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা দায়ের ও পরিচালিত হলে আশা করা যায় ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযানের শিকার রোহিঙ্গারা ন্যায়বিচার পাবেন। এতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আইনগত ভিত্তি যেমন তৈরি হবে, তেমনি সহিংসতার মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট