চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

আবু আলী হোসাইন ইবনে সীনা

১৩ জুন, ২০১৯ | ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ

যারা জ্ঞান সাধনার সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেন। তারা দেশ, কল ও ধর্মেও গর্ডির বহু উর্ধ্বে-মানুষ মাত্রেই তাদেও আপনজন ভেনে গর্ববোধ করে। প্রায় এক হাজার বছর আগে এমনই এক অসামান্য জ্ঞান সাধক ধরাধামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আজ তাকে ইরানী ও তুর্কীরা, আফগানী ও বলশেভিকরা আপন আপন জাতীয় বীর হিসেবে দারী করছে। কিন্তু আমরা বলি, এ ধরনের মহামনীষীর কোন বিশেষ নাগরিকত্বেও ছাপ নেই। তারা যেখানেই ভূমিষ্ঠ হোন না কেন মানবকুল মাত্রেই তাদের অনন্ত উত্তরাধিকার। আবু আলী হোসাইন ইবনে সীনা ছিলেন সেই বিশ্ববরেণ্য জ্ঞানবীর। আরবীতে ‘শেখ’ শব্দে অভিজ্ঞ ও দূরদর্শী জ্ঞানবৃদ্ধকে বুঝায়। ইবনে সীনাকে ‘আশ্ শায়খ-আর রঈস’ বা জ্ঞানীকুল শিরোমণি বলাহয়। অতএব জগতের জ্ঞান সাধকদেও মধ্যে ইবনে সীনার স্থান কতো ঊর্ধ্বে তা সহজেই অনুমেয়।
‘তারীখূল হুকামা’ নামক দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদেও জীবনীমূলক গ্রন্থে ইবনে সীনার ২১ খানি সুবৃহৎ ও ২৪ টি ক্ষুদ্র গ্রন্থের বিশদ বর্ণনা আছে। তাছাড়া আরো পুস্তিকার সংখ্যা একত্র করলে ইবনে সীনার গ্রন্থসংখ্যা ৯৯টি হবে। তিনি দর্শন বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতিষ, অলংকার শাস্ত্র, ভাষা তত্ত্ব, সংগীত-প্রভৃতি বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে আঠারো খন্ডে সম্পাদিত ‘কিতাবুশ শিফা’ বা রোগ নিরাময়, আন্-নাজাহ’ বা মুক্তি লাভ, উয়ুনুল হিকমত বা দর্শনশাস্ত্রেও চক্ষুরাজি, এবং ‘কানুন-ফি-ত্ত্বিব’ নামক সুবৃহৎ চিকিৎসা বিজ্ঞান তার শ্রেষ্ঠ অবদান। এক কথায় তার ‘কানুন’ যেমন তাকে অসামান্য চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্টিত করেছে তেমনি তার ‘শিফা’ তাকে বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর দার্শনিকের মর্যদা দান করেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী কালস্রােত মিশে যাচ্ছে, কিন্তু গ্রন্থ দু’টি ইবনে সীনার অক্ষয় কীর্তি হিসেবে তাকে অমর করে রেখেছে।
তিনি ছিলেন সুগভীর জ্ঞান ও উদার চিন্তার অধিকারী। তার দার্শনিক মতবাদেও ব্যাখ্যার প্রাঞ্জলতা ও পূর্ণতার কাছে আল ফারবীর মতো শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের খ্যাতিও ম্নান হয়ে যায়। এরিস্টোটলের মতবাদকে সুসংঘবদ্ধ করে তার চিন্তাধারায় ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির (আল্লাহ ও মানুষের) মধ্যকার শূন্যতাকে ইবনে সীনা তার ‘মাফলাত’ বা সৃষ্টিমন্ডলের জ্ঞানের বৈজ্ঞানিক ধারণা শক্তি দিয়ে পূরণ করেন। তিনি কেবল প্রাক্তন দার্শনিকদেও মতবাদেরই পূর্ণ ব্যাখ্যা করেননি, গ্রীসের সমস্ত দার্শনিক চিন্তাধারকে নিজের জ্ঞানের আলোকে সুশৃংখলভাবে সাজিয়ে তিনি সভ্য জগতের সম্মুখে তুলে ধরেন এবং অধ্যাপক হিট্টির ভাষায় ঃ ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে গ্রীক দর্শনের সামঞ্জস্য বিধানের যে সূচনা আল্কিন্দি করেছিলেন ইবনে সীনা পাকা ওস্তাদের মত তা সূচারুরূপে সম্পন্ন করেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে তিনি ছিলেন এরিস্টোটলের সঙ্গে ইসলামী ভাবধারার মিলন সেতু এবং গ্রীক দর্শনের সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষ্যকার।
এ মহান মনীষীর জন্ম হিজরী ৩৭০ খৃষ্টাব্দ ৯৮০ সালে, রাশিয়ার আফসানা নামক এক পল্লীতে। তার বাবা আবদুল্লাহ ছিলেন একজন রাজকর্মচারী। এ সুবাদে বাল্যকাল হতেই তিনি, অনুকূলে পরিবেশে যোগ্য শিক্ষক মন্ডলীর তত্ত্বাবধানে দ্বীনি ইলম ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী হয়ে উঠেন। আঠার বছর বয়স পর্যন্ত তিনি দিবারাত্র লেখা-পড়ায় ব্যাপৃত থাকেন। এমনকি নিদ্রাকর্ষণ যাতে তার লেখা-পড়ায় কোন রকম ব্যাঘাত ঘটাতে না পাওে এ জন্য নিদ্রা প্রতিরোধক কিছু পান করতেন। ইবনে সীনার বয়স তখন ষোলে হতে আঠারোর কোঠায়। সে সময় কুখারার শাসনকর্তা নুহ ইবনে মানসুর কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। কিছুতেই আরোগ্য লাভ করেননি। পরিশেষে ইবনে সীনার হাতেই তিনি সুস্থতা ফিরে পেয়েছিলেন। তার সফল চিকিৎসায় মুগ্ধ হয়ে বাদশাহ তাকে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য! তার এ সুখের দিন বেশী সময় দীর্ঘ হয়নি। তার পিতা ও বাদশাহ নুহ মৃত্যুবরণ করলে রাজ্যে চরম বিশৃংখলা দেখা দেয়। যদ্দরুণ তিনিও দেশ ত্যাগে বাধ্য হন।
১০০১ খৃষ্টাব্দে তিনি খাওয়ারিযম পৌছেন। সেখানে তিনি আলী ইবনে মামুনের দরবারে মহাজ্ঞানী আল বিরুনী, আবু নসর, আবুল খায়ের প্রমুখ আলিম ও সুফীর সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ লাভ করেন। কিছুদিন খাওয়ারিযমে অবস্থান করার পর তিনি ইরাকে আযমের দিকে রওনা হন। কিন্তু প্রচলিত ধর্মীয় মতের বিপরীত মত প্রকাশের কারণে তিনি গজনীর সুলতান মাহমুদের ভয়ে এখানেও বেশীদিন অবস্থান করেননি, জুরজানায় প্রস্থান করেন। সেখানেও তিনি সংকটমুক্ত থাকতে পারেনি। ১০১৫ খ্রিস্টাব্দ জুরজান হতে ‘রায়’ এ যাত্রাকালে ‘দায়লামে’ বুয়াইহী রাজত্বের অবসানে সে সমস্ত ছোট ছোট রাজ্যের উৎপত্তি হয়েছিল – সে অঞ্চলে অনেক কষ্ট ভোগ করেন। এ সময় তিনি কখনো মন্ত্রী, কখনো দার্শনিক, কখনো চিকিৎসক, কখনো বা উপদেষ্টার কাজ করতেন, আবার কখনো তাকে রাজনীতিমূলক অপরাধীরূপে গণ্য করা হত।
১০২২ খ্রি তিনি আমীর আলাউদ দৌল্লাহর সাহায্য লাভ করেন। ইনি স্বাধীন চিন্তা ও মতবাদের পোষক এবং জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। ইবনে সীনাকে তিনি সর্বদা নিজের কাছে কাছে রাখতেন এবং তারই সংস্পর্শে থাকাকালে ১০৩৭/৪২৮ সালের ৪ রমজান আল্লামা ইবনে সীনা ইন্তেকাল করেন। হামাদানে তার মাজার অবস্থিত।

লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট