চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

সিয়াম সাধনার শেষে মহামিলনের দিন ঈদ উল্ ফিতর

অধ্যাপক আবু তালেব বেলাল

৪ জুন, ২০১৯ | ১:৪৭ পূর্বাহ্ণ

এক.
রমজানের ঐ রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ…। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই গানের সুরে প্রতিটি বাঙালি মুসলিম হৃদয়ের গহীনে শুরু হয় আনন্দের জোয়ার, সুখের নাচন। সিয়াম- সাধনার মাস মাহে রমজানের এক মাস রোজা পালন শেষে ২৯ বা ৩০ তারিখে পশ্চিমা আকাশে বাঁকা চাঁদ উদয়ের সাথে সাথে আনন্দ যেন একসঙ্গে উপচে পড়ে। আর, সাথে সাথে বেতার ও টেলিভিশনগুলোও সরব হয়ে উঠে। শুরু হয় নজরুলের সেই গানটি। আহা! কি আনন্দ, কি সুখ! সমস্ত মুসলমান যেন এ আনন্দে একাকার হয়ে যায়। আকাশ-বাতাস মনে হয় হেসে ওঠে ঈদ আনন্দে।
মুসলমান ধর্মীয় আচারণে ও সংস্কৃতিতে দুইটি ঈদ রয়েছে। ১. ঈদ উল ফিতর। ২. ঈদ উল আজহা। একটি আরবি সন গণনায় শাওয়াল মাসের ১ম তারিখে। অপরটি জিলহজ মাসের ১০ তারিখে। দুইমাস নয় দিনের ব্যবধানে এ উৎসবদ্বয়ের আয়োজনের পেছনে ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। রয়েছে ধর্মীয় তাৎপর্য। প্রথমত: বলা যায় যায়, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার নাম। শুধু বিশেষ কোন বাহ্যিক আচারণে এটি সীমাবদ্ধ নয়। এ ধর্মের আচারণে যেমন জাহিরি ও বাতেনি বিষয় রয়েছে অনুরূপ মানুষের জীবনবোধের নানা অনুষঙ্গ বিষয়ে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ফলে, মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক জীবন গঠনে একজন মুসলমান ইসলামী বিধান থেকে নির্দেশনা লাভ করবে। স্বভাবত এটিই হবে একজন পরিপূর্ণ মুসলমানের চরিত্র।
দ্বিতীয়ত: ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনা মনোয়ারায়, তখন মদিনার অধিবাসীসহ আরবের অনেক রাজ্যে বছরে দুটি উৎসব পালন করত ১, নওরোজ ২. মেহেরজান। এ দুটি উৎসবের মূল পরিচালনায় ছিল পৌত্তলিকরা। উৎসব উপলক্ষে আরববাসী তাদের ধর্ম ও রীতির বাইরে এমন সব অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল যাতে মনুষ্যত্বহীনতার প্রকাশ ঘটতে শুরু করে। এমনকি নও-মুসলমানদের অনেকে এসব উৎসবে অংশগ্রহণ করে অন্যান্য কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মানবতার কা-ারী মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব অপসংস্কৃতি, ভ-ামি দেখে ব্যথিত হন। মুসলমানসহ মদিনাবাসীকে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে আনন্দ ও উৎসব আয়োজন করা এবং একইসাথে ধনী-গরিব সকলই এ উৎসবে যেন অংশগ্রহণ করতে পারে-এমনটি উদ্যোগের কথা জানান।
তিনি ঘোষণা করলেন, এখন থেকে মুসলমানরা আরবের ঐতিহ্য অনুযায়ী দুইটি উৎসব পালন করবে। একটি পবিত্র রমজান শেষে শাওয়ালের প্রথম তারিখ ঈদ উল ফিতর অপরটি জিলকদ মাসের ৯তারিখ পবিত্র হজ সমাপান্তে ১০ জিলকদ পবিত্র ঈদ উল আজহা। ঘটনাটি কখন ঘটেছিল মতভেদ আছে। তবে ৬২৪ বা ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে এ দুই ঈদের সূচনা হয়েছিল বলে কয়েকজন ঐতিহাসিক মত দেন।
নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ঈদের প্রবর্তনের সাথে ২টি বিষয় গরিব ও অসহায়দের জন্য ইসলামী বিধানে যুক্ত করলেন ১. ফিতরা ২. কুরবান পশুর চামড়ামূল্য। ঈদ উৎসবে অংশগ্রহণের পূর্বে ও পরে সমাজের গরিব, অসহায় ও দুঃস্থদের কাছে সামর্থ্যবানদের ফিতরার টাকা ও জবেহকৃত পশুর চামড়ার টাকা দিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় পাপাচারীর দলে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। আরো একটি বিষয়কে করেছেন বাধ্যতামূলক। উৎসব-আনন্দ যাই হোক সকল মুসলমানদের ঈদগাহে বা জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে গিয়ে ইমামের পেছনে জামাত সহকারে দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ পড়তে হবে।
দুই.
বাংলাদেশে ঈদ উৎসবের ব্যাপকতা ও গভীরতা আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় নতুনত্ব নিয়ে এসেছে। সম্প্রতি মূল্যবোধের অবক্ষয়, ঘুষ-দুর্নীতির বিস্তার, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, সন্ত্রাসের সঙ্গে রাজনীতির সখ্য, অশান্তি ও আবিলতার যে সৃষ্টি করেছে- এর ভেতর দিয়েও সমাজ এগোচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে নিরন্তর। এই পরিবর্তনের একটা ধারাবাহিকতাও আছে। ঈদ উৎসবের ধারাবাহিক পরিবর্তনের ধারার উৎস খুঁজতে হলে আমাদের ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাসের গ্রামীণ এবং গড়ে ওঠা সীমিত আকারের নগরজীবন অবলোকন করতে হবে।
প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ঈদ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। কিন্তু ইসলামের আরব বহির্ভুত বিস্তৃতির সাথে এ উৎসবের ধরন ও সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটেছে নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে দ্বাদশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলায় ইসলামের পূর্ণতা প্রকাশ পেলেও প্রায় অর্ধসহস্রাধিক বছর ধরে শাস্ত্রীয় ইসলামের অনুপুঙ্খ অনুসরণ যে হয়েছিল, তেমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ড.সামশুজ্জমান খান এর মতে, সেকালের বাংলায় ঈদ উৎসবেও তেমন কোনো ঘটা দেখা যায় না। এর কারণ হয়তো দুটি-
এক. গ্রামবাংলার মুসলমানরা ছিল দরিদ্র। দুই. মুসলমানের মধ্যে স্বতন্ত্র কমিউনিটির বোধ তখনো তেমন প্রবল হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটা সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর অবস্থাও তখনো সৃষ্টি হয়নি। আর এটা তো জানা কথাই যে, সংহত সামাজিক ভিত্তি ছাড়া কোনো উৎসবই প্রতিষ্ঠা লাভ করে না। তাই বৃহৎ বাংলায় ঈদ উৎসব সপ্তদশ, অষ্টাদশ, এমনকি ঊনবিংশ শতকেও তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। নবাব-বাদশাহরা ঈদ উৎসব করতেন। তবে তা সীমিত ছিল অভিজাত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে। সাধারণ মানুষের কাছে সামাজিক উৎসব হিসেবে ঈদের তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল না। গোটা উনিশ শতক ধরে বাংলাদেশে যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন চলে, এর প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছে নগরজীবন ও গ্রামীণ অর্থবিত্তশালী বা শিক্ষিত সমাজের ওপর। মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাও এই চেতনাকে শক্তিশালী করেছে। ফলে ওই অনুকূল পরিবেশেই ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে এক শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতা কেন্দ্রে রেখে পরিচালিত বাংলাদেশ আন্দোলন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার যে নবরূপায়ণ ঘটেছে, এতে ঈদ উৎসব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে নতুন গুরুত্ব পেয়েছে।
তিন.
ঈদের আনন্দ কি সবসময় একই রকম ছিল। আসলে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় এই উৎসবে আনন্দের কমতি কখনই ছিল না। সেকাল-একাল সবকালেই আনন্দময়। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ত পাল্টে গেছে এই আনন্দ উদযাপনের পদ্ধতি। হয়ত বদলে গেছে আনন্দানুভূতির ধরন-বৈচিত্র্য। তবে সেকাল-একাল যে কালেই হোক না কেনো ঈদের আনন্দ মূলত শিশুদেরই।
কেমন ছিল সেকালের ঈদ? সেকাল তো একালের বড়দের শৈশব কাল। শৈশবের স্মৃতি মানুষকে এমনিতেই আবেগতাড়িত করে। তার ওপর আবার ঈদের স্মৃতি। সে কি ভোলা যায়! তখনকার দিনে এখনকার মতো রেডিমেড গার্মেন্টস ছিল না। তখন থান কাপড় কিনে বানাতে হতো। রোজার প্রথম থেকে ভিড় শুরু হয়ে যেত খলিফা (টেইলর) বাড়িতে। আবার কাপড় যখন-তখন কেনা যেত না। কারণ, হাটবারে হাট ছাড়া কাপড় পাওয়া যেত না। অবশ্য মফস্বল শহরে বা জেলা সদরের নিউমার্কেট থেকে সম্ভ্রান্তরা কিনত। যাই হোক, খলিফা বাড়িতে কাপড় বানাতে গিয়ে ছোটদের আর তর সয় না। মাঝে মধ্যেই ঢুঁ মেরে আসে খলিফা বাড়িতে। তারটা বানাতে আর কত দেরি! কার কার পোশাক বানানো হলো এই সব তথ্য সংগ্রহের জন্য। এই আনাগোনা ও অপেক্ষা ছিল কতই না মধুর।
অবশেষে ঈদের দুই একদিন আগে পেয়ে যেত তার কাক্সিক্ষত পোশাকটি। নতুন পোশাক পেয়ে ঈদ হয়ে যেত রঙিন। ঈদের দিন সকালবেলা ছোট-বড় সকলে দল বেঁধে পুকুরে বা নদীতে গোসল করা। তারপর নতুন পোশাক পরে পায়েস-সেমাই খেয়ে সারিবদ্ধভাবে দূরের কোন ঈদগাহ মাঠে নামাজ পড়তে যাওয়া। মনে হয় মেঠো পথে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপি পরিহিত মানুষের মিছিল মিলিত হয়েছে কোন এক মোহনায়। তখন গ্রামে গ্রামে ঈদগাহ মাঠ ছিল না। কয়েকটি গ্রামের জন্য ছিল একটি ঈদগাহ মাঠ। গ্রামে গ্রামে ঈদগাহ-এর প্রয়োজনীয়তাও মনে করত না। কারণ এই উপলক্ষে ঈদগাহে কয়েকটি গ্রামের লোক একসঙ্গে মিলিত হতে পারত।
নামাজ শেষে পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি করে চলত কুশল বিনিময়। ঈদগাহ থেকে ফেরার পর প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া, সেমাই খাওয়া, মিষ্টি মুখ করা। ছোটরা নতুন জামা কাপড় পরে দল বেধে এ বাড়ি সে বাড়ি বেড়াতে বের হতো। তাদের তো দশ/বার বাড়িতে না যেতে পারলে যেন ঈদের আনন্দ পরিপূর্ণ হতো না। কোন কোন আত্মীয়স্বজন ছোটদেরকে দুই টাকা/পাঁচ টাকা ঈদের সালামি দিত। এই সালামি পেয়ে নিজেদেরকে অনেক সম্পদশালী মনে হতো। এই মূল্যবান সম্পদ আমরা ছোটরা অনেকদিন আগলে রাখতাম। আগের দিনে অনেক এলাকায় গ্রামের লোকজন সাধারণত গরিবদের ফিতরার টাকা না দিয়ে সমপরিমাণ খাবার চাল দিত। ঈদের দিন সকালবেলা ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় পোঁটলা বেঁধে চাল সঙ্গে করে নিয়ে যেত। ঈদগাহ মাঠের চারপাশে ভিখারি ও গরিব লোকজন এই চাল নেয়ার জন্য কাপড় বিছিয়ে রাখত। লোকজন নামাজের পূর্বে সঙ্গে আনা চাল ওই কাপড়ের ওপর ছিটিয়ে দিত। ছোটরা এই কাজটি করতে খুব আনন্দ পেত।
তথ্যপ্রযুক্তির প্রবাহ ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনের প্রভাবে বর্তমানে ঈদ উদযাপনের পদ্ধতিও পাল্টে গেছে। আগে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ঈদকার্ড প্রেরণ বেশ জনপ্রিয় ছিল। বর্তমানে অফিস ও কর্পোরেট জগতে এর প্রচলন থাকলেও ব্যক্তি পর্যায়ে তেমন একটা নেই। এখন ঈদের শুভেচ্ছা জানানো হয় ফেসবুক, ভাইবার, টুইটার, ই-মেইল বা মোবাইলের এসএমএস বা এমএমএস-এর মাধ্যমে। ঈদের আনন্দ আবর্তিত হয় ফ্যাশন ডিজাইন, বিউটি পারলার ও শপিংকে কেন্দ্র করে।
সেকালে মেহেদি লাগানো ছিল অনেক কষ্টকর। তখন এই কষ্টকর কাজটিই ছিল ঈদ আনন্দের প্রধান আকর্ষণ। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে সংগ্রহ করা হতো মেহেদি পাতা। তারপর রাতে একজন শিল-পাটা নিয়ে মেন্দি বাটতে বসত। আর তাকে ঘিরে চারদিকে গোল হয়ে বাকিরা বসত। চলত গল্পগুজব, হাসি-ঠাট্টা-গান। মেহেদি প্রস্তুত হলে একটি ছোট কাঠি দিয়ে হাতে মেহেদির নকশা আঁকা হতো বা চুন দিয়ে নকশা একে হাতের তালুতে মেহেদি ছাপ মেরে রাখা হতো। পরে দেখা যেত হাত লাল-সাদা নকশা হয়েছে। নিজের, চাচাত-ফুফাত, প্রতিবেশী ভাই-বোনদের সঙ্গে মেহেদি লাগানোর সেই সময়টুকু যে কি মধুর ছিল!
ঈদের জন্য সেই যে আয়োজন, বর্তমানে কি আগের দিনের মতো আনন্দ হয়? ঈদের দিনে দল ধরে প্রতিবেশীদের বাড়ি বেড়ানো গ্রামে কিছুটা থাকলেও শহরে এখন নেই বললেই চলে। সারাদিন অলস সময় কাটানোর পর বিকেলে বা সন্ধ্যায় শিশু পার্ক, এ্যামিউজমেন্ট পার্ক বা আত্মীয়স্বজনদের বাসায় বেড়াতে বের হয় কেউ কেউ। ঈদের মাঠের আনন্দও সীমিত হয়ে গেছে।
আমরা চাই, ঈদের অনুষ্ঠান বা আনুষ্ঠানিকতা যাই থাকুক না কেন, ঈদের আনন্দ থাক প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে, ধর্মীয় অনুভূতিতে। এই আনন্দে ছোট-বড়, ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একাকার হয়ে যায়। এটাই ঈদের বড় মহিমা।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট