চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

ঈদ আনন্দ : সেকাল ও একাল

মাহমুদুল হক আনসারী

৪ জুন, ২০১৯ | ১:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ঈদ মানে খুশি। সব জাতি ধর্ম গোত্র সকলের একটি বিশেষ দিনকে খুশি বা ঈদ হিসেবে ব্যবহার করে। পৃথিবীর সবগুলো গোত্র ও ধর্মানুসারীদের আনন্দ বা ঈদ আছে। ইসলাম ধর্মে মুসলমানদের খুশির বড় ঈদ দুটি। একটি হল রমজান মাসের রোজা পালনের পর যে খুশি উদযাপন করা হয়। সেটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর দিবস। এ ঈদ মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে বড় ঈদ বা খুশি। আরেকটি ঈদ হচ্ছে, হজ্বের সময় পশু কোরবানীর ঈদ। এ দুটি ঈদ ছাড়াও ছোট বড় আরো কিছু মুসলমানদের খুশির দিন থাকলেও এগুলো ঈদের পর্যায়ে পড়ে না। সবচেয়ে বড় ঈদ ঈদুল ফিতর। রমজানের রোজার শেষে যে চাঁদ পশ্চিমাকাশে উদিত হয় সেই খুশির ঈদ। এ ঈদকে ঘিরে আনন্দ আর উল্লাসের জন্য মুসলিম বিশ্ব বিভিন্ন কর্মসূচী ও প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে। ঘরে ঘরে পাড়া মহল্লা ও সমাজে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে থাকে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রশাসন জনগণের ধর্মীয় আবেগ ও উল্লাসকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হলেও এখানে সবধরনের মানুষকে সমান সুযোগ-সুবিধা ও সাহায্য সহযোগিতা দেয়া হয়। রাষ্ট্র হিসেবে ধর্ম নিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, সব ধর্ম-গোত্র-মানুষকে সমান সুযোগ প্রদানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সব ধর্মের সবগুলো আয়োজন-অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মনিটরিং রাখা হয়। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচয় হলেও এদেশ উদারপন্থী একটি মুসলিম দেশ। এখানে সুন্নী, খারেজী, রাফেজী যতধরনের গ্রুপ থাকুক না কেন সকলেই তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও স্বাধীনভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে থাকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো গোষ্ঠীকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় না। বাংলাদেশের মানুষ সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেনো, সবাই খুশি-আনন্দে নির্দি¦ধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করে আসছে। এদেশে কেউ কারো ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বা বিরোধিতা-প্রতিবন্ধকতা করার মতো দৃষ্টান্ত নেই বলা যায়। বাংলাদেশ সেকারণে সব ধর্ম ও গোত্রের মানুষের সমান সুযোগ সুবিধার দেশ।
বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হলেও এখানে মুসলমানরা অত্যন্ত উদার ও শান্তিপ্রিয়। তারা অন্যান্য ধর্ম গোত্রের প্রতি সর্বদা সুদৃষ্টি নিরাপত্তা ও ভালোবাসা দিয়ে থাকে। রাষ্ট্র হিসেবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক হলেও অপরাপর ধর্মপালনকারী গোষ্ঠী শতভাগ নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণভাবে এদেশে বাস করছে। কথা হচ্ছিল ঈদ বা খুশি উদযাপন নিয়ে। এদেশে যে কোন ধর্মের খুশির দিনে রাষ্ট্রীয়ভাবে সকলেই একে অপরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ রেখে চলছে। দেশ স্বাধীনের পর হতে আমরা এদেশের সবগুলো খুশি এভাবে দেখে আসছি। ঈদ সেটা যে ধর্মেরই হোক না কেন জাতি হিসেবে বাঙালি জাতি সম্মিলিতভাবে সবগুলো অনুষ্ঠানে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে। হিংসা-বিদ্বেষ কোনো প্রকারের বাধা প্রতিবাধা কখন ছিলো না। কেউ কাউকে ধর্ম-কর্মে বাধা সৃষ্টি করে না। একে অন্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সার্বিক সহযোগিতা করতে এগিয়ে যায়। সাদা মাটা অনুষ্ঠান একসময় সম্মিলিতভাবে হতো। মুসলমানদের ধর্মীয় খুশির সময়ে অন্য ধর্মের অনুসারীদের আসা যাওয়া দেখা যেতো। অন্য ধর্মের অনুষ্ঠান ও খুশিতে মুসলিমরা অংশগ্রহণ করতো। খানা আপ্যায়নে একে অপরের অতিথি হতো। সাহায্যের হাত বাড়াতো একে অন্যকে।
সেদিন ছিল এক মধুর দিন, ছিল না তখন কোনো হিংসা বিদ্বেষ। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পরিবেশ ও চরিত্র সবার মধ্যে তখন দেখা যেতো। আজকালের মতো তখন এতো অধিক ধনী ও অর্থবিত্তশালী মানুষ তখন ছিল না। খেটে খাওয়া শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে এক ধরনের গভীর মায়া-মমতা আর ভালোবাসা দেখা যেতো। একে অপরের সুখে-দুখে ধর্মের ব্যবধান ছেদ করে এগিয়ে যেতো। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি ছিলো গভীর ভালোবাসা। এক ধর্ম আরেক ধর্ম-গোত্রকে বাঁকা চোখে দেখতো না। খুশির সময় সকলেই আনন্দ ও খুশি ভাগাভাগি করে নিতো। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজকের দিনের ঈদের স্মৃতিকাতরতা দেখা দেয়। এখন ঈদের খুশিতে সে আনন্দ পাওয়া যায় নানা মাত্রায়।
কথা ছিলো এক মুসলমান তার অপর ভাইকে খুশি উদযাপন সাহায্য করবে। কিন্তু সে প্রথা সমাজে খুব বেশি চালু করা যায়নি। এখনো যাদের নিকট অট্টালিকা ও অর্থ-সম্পদ পুঞ্জীভূত আছে, তারা আত্মকেন্দ্রিকভাবে ভোগবিলাসে মত্ত। তাদের সম্পদে দুর্বল দুঃস্থ মুসলমানদের অধিকার থাকলেও সে অধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে বিতরণ করতে অনেকে কুণ্ঠিত। অন্য মুসলমান ভাইদের অধিকার দেয়ার কথা থাকলেও তাকে পূর্ণ করতে অনেক করণীয় রয়েছে আমাদের। এখনো দুঃস্থ, দরিদ্র অসংখ্য মানুষ মুসলিম পরিচয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ধনী দেশের স্বাবলম্বী মানুষগুলোকে তাদের পাশে দাঁড়াতে দেখছি না। যে পরিমাণ সাহায্য ও আন্তরিকতা নিয়ে দুঃস্থদের পাশে দাঁড়াবার কথা ছিলো সে ইসলামী বিধান মুসলিম দুনিয়া অনুসরণ করছে না। সত্যিকারভাবে সামর্থ্যবান ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র যদি দরিদ্র ও অভাবী মানুষের পাশে সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে আসতো তাহলে পৃথিবীতে মুসলিম বিশ্বের কোটি কোটি দুঃস্থ মানুষ আহাজারী করতো না।
বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ বার্মার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগণ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। বর্তমানে নির্যাতিত বিতাড়িত মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম নরনারীর প্রায় ১২ লাখের অধিক মানুষ বাংলাদেশে আশ্রিত। সকলেই তারা মুসলমান। নিজ দেশে নির্যাতনের আঘাত সহ্য করতে না পেরে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। এসব মানুষের পাশে মুসলিম দুনিয়ার যেভাবে এগিয়ে আসার দাবি ছিল সে দাবি তাদের পক্ষে পূরণ করা হয়নি। এভাবে পৃথিবীর নানা দেশে অসংখ্য নির্যাতিত মুসলিম নরনারী মানবেতর জীবনযাপন করছে। সামর্থ্যবান ব্যক্তি ও দেশের তাদের পাশে দাঁড়ানো ইসলাম ধর্মের দাবী।
তাই ঈদ আনন্দ সেকাল আর একালের অনেক তফাৎ। তখন মানুষে মানুষে এতো ভেদাভেদ হিংসা আর বিদ্বেষ ছিলো না। এখন সেটার বিপরীত। মানুষ সে যে ধর্মেরই হোক না কেনো আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। বিজ্ঞান ও আধুনিকতায় পৃথিবী এগিয়ে গেলেও মানবতা মানবপ্রেম সেভাবে এগুচ্ছে না। সব মানুষের নিকট ঈদ হয়ে উঠুক সার্বজনীন।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট