চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দাবদাহ : হিটস্ট্রোক ও পীড়া থেকে সাবধান

২৮ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:৫১ পূর্বাহ্ণ

দিনদশেক ধরে তাপদাহের কবলে পড়েছে দেশ। ফলে একদিকে বেড়েছে গরমজনিত দুর্ভোগ, অন্যদিকে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব। দৈনিক পূর্বকোণে বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রামে গরমের তীব্রতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগব্যাধি। আর শিশুরাই প্রধানত এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিদিনই নগরীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে গড়ে শতাধিক শিশুরোগী ভর্তি হচ্ছে। তারা প্রধানত গরমজনিত শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, কলেরা, হেপাটাইটিস, আমাশয় ও টাইফয়েড রোগেই আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিদিন জ্যামিতিক হারেই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। ফলে হাসপাতালগুলোর শয্যা, মেঝেতে এমনকি বারিন্দাও রোগীতে ভরপুর হয়ে গেছে। গরমজনিত রোগ ও রোগীর এই চিত্র খুবই শঙ্কাজনক বলতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের নিশ্চয়তা বিধানে ব্যর্থ হলে এই চিত্র ভয়ঙ্কর পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
উল্লেখ্য, তীব্র তাপপ্রবাহসহ নানা কারণে বাংলাদেশে সাধারণত মধ্য মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ডায়রিয়া পরিস্থিতি বিরাজমান থাকে। এ সময়ে ডায়রিয়া, পেটের পীড়া, আমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিসসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। আবহাওয়ার বিরূপ আচরণের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট, রাস্তার পাশে বিক্রি করা ধুলাবালি মিশ্রিত বরফ, তরমুজ, আনারস এবং কাঁচা আম দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফলের শরবত পানও এ সময়ে ডায়রিয়াসহ নানা গরমজনিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। বাংলাদেশে তীব্র গরমের সময় বিদ্যুতের লোডশেডিংও বাড়ে। লোডশেডিংয়ে কষ্ট ধনীদের স্পর্শ করতে না পারলেও দরিদ্র্যজনদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা দেয়, দুর্বিষহ হয়ে পড়ে দরিদ্র্যপল্লীর জনজীবন। আবার গরমকালে ওয়াসার পাইপ লাইনগুলোতে পানিপ্রবাহ কম হওয়ার কারণে সরবরাহকৃত পানিতে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ থাকে বেশি। তাছাড়া ওয়াসার পাইপ লাইনগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার না হওয়ায় কোনো কোনো স্থানে পানি ও স্যুয়ারেজ লাইন একাকার হয়ে যাওয়ার অভিযোগও আছে। এতে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি মিশে যাচ্ছে ওয়াসার পানিতে। আর এসব পানি ব্যবহার ও পান করে নাগরিকসাধারণ আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগ-ব্যাধিতে। পরিণামে গরম ও পানিবাহিত রোগ পিছু নিচ্ছে নগরবাসীর।
৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রিকে মৃদু, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রিকে মাঝারি ও ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এখন মৃদু ও মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তাপদাহের সময় রোটা ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি ঘটে। ভাইরাসটি সাধারণত ধূলাবালিযুক্ত খোলা খাবার বিশেষ করে শহর-গ্রামে রাস্তার পাশে বিক্রয় করা খোলা খাবার, মশলাদার ও বাসি খাবার এবং দূষিত পানির মাধ্যমে খুব সহজে ঢুকে পড়ে মানবদেহে। আর এই ভাইরাসটিই হচ্ছে ডায়রিয়ার মূল কারণ। আর ডায়রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে ডায়রিয়ায় প্রতি বছর নিহতদের সিংহভাগই শিশু। পানি ও লবণ-শূন্যতার কারণ শিশুদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষ সচেতন হলে এবং শিশুদের প্রতি যত্নশীল হলে শিশুরা ডায়রিয়া থেকে অনেকটাই নিরাপদ থাকবে। প্রসঙ্গত, ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর শরীর থেকে টক্সিন, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য ক্ষতিকর বন্তু বের হয়ে যায়। আর এসব বস্তু বের হয়ে যাওয়ার সময় অন্ত্রের সাময়িক বিপর্যয় ঘটায়। একই সঙ্গে এসব বস্তু বের হয়ে যাওয়ার সময় প্রচুর পানি ইলেকট্রোলাইট তথা সোডিয়াম এবং পটাশিয়াম সমৃদ্ধ লবণও বের হয়ে যায়। আবার বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়ার পাশাপাশি চুলকানি, জন্ডিস ও খোস-পাঁচড়াসহ নানা ধরনের চর্মরোগও দেখা দেয়। এতে যে ইনফেকশন তৈরি হয় তাতে পরবর্তী পর্যায়ে কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার আশংকাও থাকে। চরম উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, শিশুরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডায়রিয়ার পাশাপাশি নানা ধরনের চর্মরোগেরও শিকার হয়। বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্ট ও গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া চর্মরোগীদের প্রায় ৯৫ ভাগেই হয় শিশু।
আমরা মনে করি, তীব্র তাপপ্রবাহের এ সময়ে ডায়রিয়া ও চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগকে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আক্রান্ত রোগীদের সুচিকিৎসা ও ওষুধপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি যেসব কারণে রোটা ভাইরাস ছড়ায় সে সব বিষয়ে সৃষ্টি করতে হবে জনসচেতনতা। নিশ্চিত করতে হবে বিশুদ্ধ পানি ও ভেজালমুক্ত খাবারও। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, ওয়াসার জন্যে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা ও ওয়াসার কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বাড়িঘরের পানির ট্যাংক পরিস্কার রাখা ও পানি ফুটিয়ে খাওয়ার ব্যাপারেও সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে ওরস্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা শিকারে লিপ্তদের বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। ডায়রিয়ার মূল কারণ ও নিরাপদ থাকার উপায় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার যুৎসই কর্মসূচি থাকলে এবং সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যমসহ দেশের সব সংস্থা ও ব্যক্তি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখলে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে। প্রখর দাবদাহে হিটস্ট্রোকের আশঙ্কাও থাকে প্রবল। এ বিষয়েও জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ থাকতে হবে। প্রখর রোদে ছাতা ব্যবহার, প্রচুর পরিমাণ পানি পান করা, তেঁতুল, আনারস, কাঁচা আম, পাতিলেবু, তরমুজ ও বেলের শরবত পান করলে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা কম থাকে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট