চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মানবিক মুখ

সমকাল দর্পণ

ড. মাহফুজ পারভেজ

১ জুন, ২০১৯ | ১:৫২ পূর্বাহ্ণ

মানুষের চেহারা থেকে ক্রমেই মানবিক মুখগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে হন্তারক, ধর্ষক, লুটেরা, সন্ত্রাসী, মুনাফাখোরের বীভৎস মুখগুলো।
সামাজিক মানুষের মানবিক মুখগুলোর এই গুণগত অধঃপতন বিরাট শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে বাড়ছে ভীতি, আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা। নাগরিক মানুষের চারপাশে ভিড় করা ভয়াল মুখগুলো নস্যাৎ করে দিচ্ছে শান্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তা।
সামাজিক জীবনে মানবিক মুখের কারণেই পৃথিবীর অগ্রগতি হয়েছে। সভ্যতার বিকাশও ঘটেছে মানবিকতার সূত্র ধরে। যুদ্ধ, দাঙ্গা, সন্ত্রাস, হানাহানির বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েই পৃথিবী আর মানবসভ্যতা এগিয়ে চলেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ মনে হচ্ছে, মানবিকতা থমকে দাঁড়িয়েছে। সু-সভ্যতার জায়গা দখল করেছে নৃশংস বীভৎসতা। মানুষের ক্রমবর্ধমান আর্তির সঙ্গে যেন মিলিত স্বরে আর্তনাদ করছে তাপিত ও পীড়িত পৃথিবী।
কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে – আক্রান্ত মানুষের আর্তি ও উপদ্রুত পৃথিবীর আর্তনাদ। উষ্ণায়ণ বেড়ে যাচ্ছে। পরিবেশের হানি ঘটছে। আবহাওয়া হয়ে যাচ্ছে বিরূপ ও ভয়ঙ্কর। যার, নেপথ্যে কাজ করছে কতিপয় অমানবিক, লোভাতুর ‘মানুষের’ মুখ।
ব্যক্তিমানুষের যন্ত্রণাও সুতীব্র হাহাকারে অতীতের সকল কালো অধ্যায়কে অতিক্রম করতে চলেছে। বিশ্বের পথে পথে আদিঅন্তহীন নগ্ন পদক্ষেপে আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরছে লক্ষ লক্ষ গৃহহীন শরণার্থী-উদ্বাস্তু। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা পর্যন্ত এই নির্মম সত্য স্বীকার করেছে যে, পৃথিবীতে এতো গৃহহীন-রিফিউজির দেখা অতীতেও পাওয়া যায় নি। এমন কি, একাধিক বিশ্বযুদ্ধেও এতো বিপুল মানুষ আক্রান্ত হয়নি – যা হচ্ছে সর্বসাম্প্রতিক বর্তমানকালে।
রাজনৈতিক অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে জাতিগত, ভাষাগত, অঞ্চলগত, সংস্কৃতিগত এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা। মানুষকে হনন করতে ক্রুর হন্তারকরা নাঙ্গা সঙ্গীন হাতে প্রবেশ করছে মসজিদ, মন্দির, গির্জায়। অন্যায় রক্তপাতের মাধ্যমে অপবিত্র ও কলুষিত করা হচ্ছে ধর্মস্থান ও প্রার্থনালয়।
গৃহে, বিদ্যালয়ে, গণপরিবহণে, দপ্তরে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হচ্ছে মানুষ। আঘাতের প্রথম ও প্রধান ধাক্কা গিয়ে পড়ছে সমাজের প্রান্তিক ও দুর্বল সদস্য নারী, শিশু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের উপর। এক প্রচ- মাৎস্যান্যায়ে চরম পরিস্থিতিতে, যে যাকে বাগে পাচ্ছে, হামলে পড়ছে।
ধর্ম, দর্শন, নীতি, নৈতিকতা, আইনকে অবজ্ঞা করে জুলুম, নির্যাতন শুধু সমাজের ক্ষুদ্র ও দুর্বল অংশই নয়, মূলস্রােতকেও বিপন্ন করছে। জাল-জাতিয়াতি, তঞ্চকতা, প্রবঞ্চনা, ফেরেববাজি, শাঠ্য-ষড়যন্ত্র ও প্রতারণার মচ্ছব চলছে। অমানবিক দৈত্যের প্রেত্মারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে।
সভ্যতা ও ইতিহাস এই নারকীয়তা মেনে নিতে পারে ন। কারণ, মানবিকতা মানুষের মূল সত্তা। বীভৎসতা হলো বিকৃত সত্তা। বিকৃতি এখন মূলের জায়গা দখল করেছে।
কারণ, মানবিক মুখের মনুষ্যত্ব পূর্ণ কোনও হৃদয় কী পারে নারী, শিশুদের গৃহহীন করতে? অন্যায় রক্তপাত ঘটাতে? খুন, জখম, ধর্ষণ, বলাৎকার করতে? খাদ্যে ভেজাল দিতে? পচা, নষ্ট, বিপজ্জনক খাবার বিক্রি করতে?
পারে না। তারপরেও তো এসব আকছার হচ্ছে। মানুষের নাম নিয়েই তো এহেন চরম অমানবিক অপকর্ম করা হচ্ছে। মানুষই নিজের হাত ভিজাচ্ছে মানুষের রক্তে। মানুষই অপরাপর মানুষের মৃত্যু ও বিপদের কারণ হচ্ছে।
মানুষের মানবিক মুখের মতে অপসৃত হয়েছে মানবিক বোধ। ‘জীবে দয়া কর’, ‘অন্ধজনে দেহ আলো’, ‘ভোগে নয়, ত্যাগে সুখ’ – মর্মে চিরায়ত কথাগুলো কে আর আজকাল বিশ্বাস করে! সবাই এখন নিজের ভেতরের পশু ও জানোয়ারকে বাইরে বের করতে ব্যস্ত।
এহেন অধঃপতনশীল পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন কলুষিত হচ্ছে। মানুষের সমাজ বিষাক্ত হচ্ছে। তাবৎ পৃথিবী রক্তাক্ত হচ্ছে। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির অবসান না হলে মানুষই পৃথিবীকে মানুষের জন্য বসবাসের অনুপযুক্ত করে ফেলবে।
ফলে, মানুষ, পৃথিবী, সভ্যতা বাঁচাতে ‘মানবিক মুখ’ নিয়ে প্রতিটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মানবিক মুখের মানবিক মানুষেরাই মানবিক পৃথিবী রক্ষা করতে পারবে। মানবিকতা দিয়েই বীভৎসতা নির্মূল করতে হবে। এটাই সভ্যতার ঐতিহাসিক শিক্ষা।

লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও কবি-গল্পকার, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট