চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

জহুর আহমদ চৌধুরী : তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

১ জুলাই, ২০২০ | ৬:৫১ অপরাহ্ণ

আজ জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী। বর্তমান শাসকদল আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম মহানগর শাখা, যার সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মাহতাবউদ্দিন চৌধুরী (তাঁর প্রথম পুত্র ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন) এবং সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছিরউদ্দিন- এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা জহুর আহমদ চৌধুরী এবং প্রথম সাধারণ সম্পাদক তিনি। প্রতিবছর ১ জুলাই তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। কিন্তু তাঁর জীবনচর্চা কী হয় ? তাঁর জীবন থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি?
নিঃস্বার্থ জনসেবা, পরোপকার, রাজনীতির জন্য চূড়ান্ত ত্যাগ, সততা, সত্যবাদিতা, সাহসিকতা এসব শিখতে পারি আমরা তাঁর জীবন থেকে। তাঁর জীবনে এসব বিরল গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছিলো। সহজ-সরল খোলামেলা মানুষ ছিলেন। তাঁর জীবন যেন একটি বইয়ের খোলা পাতা। রাজনীতির কাজকর্ম সেরে স্টেশন রোডের রেস্ট হাউস (বর্তমানে মোটেল সৈকত), যেখানে ছিলো তাঁর রাজনৈতিক দপ্তর, সেখানে ফিরে আসার পর আড্ডা, গল্প-গুজবে মানুষটার প্রাণস্ফূর্তি ঘটতো।
জহুর আহমদ চৌধুরী সম্ভবত একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি একই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতি ও শ্রমিক রাজনীতি করতেন। পরে অবশ্য হান্নান সাহেব এই ধারায় রাজনীতি করেছেন। কিন্তু সে অনেক পরে। ততদিনে জহুর আহমদ চৌধুরী শ্রমিক রাজনীতি প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। কমিউনিস্টদের কথা অবশ্য আলাদা। তাদেরকে শ্রমিক বা কৃষক ফ্রন্টে রাজনীতি করেই কমিউনিস্ট পার্টিতে যেতে হয়। জহুর আহমদ চৌধুরী পাকিস্তান-উত্তরকালে চট্টগ্রামে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পথিকৃৎ।
রাজনীতিক জহুর আহমদ চৌধুরীর আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি জ্ঞানচর্চা করতেন। তিনি বই পড়তে ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রনাথ, আব্রাহাম লিংকন, নেহেরু, জিন্নাহ মওলানা আবুল কালাম আজাদ, রাধাকৃষ্ণ, চার্চিলের বই খুব পড়তেন। চার্চিল আর তাঁর ওয়ার হিরো ছিলেন। বিমানে, ট্রেনে ভ্রমণকালে তিনি বই খুলে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতেন। নতুন বই বের হলে ইদরিস আলমকে (বাগ্মী ও কলামিস্ট) বলতেন খুঁজে নিয়ে আসতো)। তাঁকে বুক ওয়ার্ম বা বইয়ের পোকা বললেও অত্যুক্তি হবে না। উর্দু, ফার্সি সাহিত্যের দিকপাল কবি সাদী, রুমী, জামী, গালিব, ইকবালের কবিতা পড়ে খুব আনন্দ পেতেন। তাঁর চাচা মওলানা তমিজুর রহমান তো ইকবালের শিকওয়া জওয়াবে শিকওয়া অনুবাদ করেছিলেন। পুঁথিসাহিত্যের প্রতি তাঁর বিরাট আকর্ষণ ছিলো। মাঝে মাঝেই রেস্ট হাউসের অলস মধ্যাহ্ন পুঁথি পাঠে মুখর হয়ে উঠতো। বিশেষ করে আলাওলের পদ্মবতী পুঁথি তাঁর প্রিয় ছিলো, সুরেলা গলায় পুঁথি পাঠ করতেন ইদরিস আলম। জহুর আহমদ চৌধুরী ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে, রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি করে বক্তৃতা করতেন।
দারিদ্রের কারণে তিনি লেখাপড়া শিখতে পারেন নি। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক কোন ডিগ্রি ছিলো না। পাহাড়তলী রেলওয়ে হাইস্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নই ছিলো তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দৌড়। কিন্তু নিজের চেষ্টায় বই পড়ে, জ্ঞানীগুণী মানুষের সঙ্গে থেকে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঊনতা পূর্ণ করে নিয়েছিলেন। অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে ও লিখতে পারতেন। শ্রমিক রাজনীতি করার সময় ব্রিটিশ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছন্দে সাহেবদের সঙ্গে ইংরেজিতে বাক্যালাপ করতেন।
স্বাধীনতার পর প্রথম মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নিয়ে একটি মজার ঘটনা ঘটে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠনের পর সংবাদপত্রে মন্ত্রিদের জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশিত হয়। জহুর আহমদ চৌধুরী এই মন্ত্রিসভায় শ্রম, সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাঁর জীবন বৃত্তান্তে শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে কিছু কিছু পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় যে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেছেন। এতে তিনি ভীষণ লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ হন। কারণ তিনি তো জানেন, গ্র্যাজুয়েশন করা দূরে থাক, তিনি কোনদিন কলেজের চৌকাঠই মাড়াননি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেই এক প্রতিবাদলিপি সংশ্লিষ্ট পত্রিকাগুলিতে পাঠিয়ে দেন এই বলে যে, তিনি কখনো ইসলামিয়া কলেজে পড়েন নি এবং তিনি গ্র্যাজুয়েটও নন। পরদিন তা ‘শ্রমমন্ত্রী গ্র্যাজুয়েট নহেন’ এই শিরোনামে বক্স আইটেম হিসেবে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাথে সাথে তিনি তাঁর প্রকৃত শিক্ষার কথাও জানিয়ে দেন। এতে সেদিন ভীষণ হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিলো- মন্ত্রী অষ্টম শ্রেণি পাস সেটা জেনে নয়, বরং মন্ত্রীর সত্যবাদিতায় সবাই চমৎকৃত হন। কতখানি মনের জোর থাকলে কেউ নিজের অষ্টম ক্লাশ পড়া যোগ্যতার কথা অকপটে স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হন না, সেটাই বিস্ময়ের উদ্রেক করে। সত্যটা জেনে এত কম লেখাপড়ার জন্য তাচ্ছিল্য করে মন্ত্রীর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা কারো মনে উদয় হয় নি, বরং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় আপনা থেকেই মাথা নত হয়ে এসেছিলো সবার।
নিজের অল্পবিদ্যার কথা আজ কি কেউ স্বীকার করবেন? ভেবে কূল-কিনারা পাই না। এখন তো জালিয়াতির যুগ। সার্টিফিকেট, মার্কশিট জালিয়াতি বোধ হয় আর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। নৈতিকতার বালাই কবে ঘুচে গেছে। ভুয়া ডিগ্রি দেখিয়ে চাকরি বাগিয়ে নেয়ার ঘটনা আকছারই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। জহুর আহমদ চৌধুরীরা এ যুগে অচলই হয়ে পড়তেন।
শিক্ষার অর্থ যদি হয় জ্ঞানার্জন, তাহলে জহুর আহমদ চৌধুরী সে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি জ্ঞান অর্জন করেছিলেন বই পড়ে, জ্ঞানী গুণীর সংস্পর্শ আর পৃথিবীর পাঠশালা থেকে। শৈশবে পেয়েছেন মহাজ্ঞানী পিতৃব্য মওলানা তমিজুর রহমানের সংস্পর্শ, সে কথা আগেই বলেছি। যৌবনে পেয়েছেন বিসিএল ডিগ্রিধারী ব্যারিস্টার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য, যাঁকে সমকালীন নিখিল ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যবহারজীবী ও বিদ্বান বললে অত্যুক্তি হয় না। বঙ্গীয় রেনেসাঁর সূতিকাগার কলকাতা এবং পূর্ববঙ্গের বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র ঢাকায় বিচরণের সূত্রে ভারত ও বাংলার মনীষার কিছু আঁচ তো পেয়েছেনই। তদুপরি পড়ালেখার জন্য দামপাড়ার বাসভবনে গড়ে তুলেছিলেন একটি লাইব্রেরি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দুর্লভ গ্রন্থ সংগ্রহ করে সজ্জিত করেছিলেন সে লাইব্রেরি। রেস্ট হাউসের ২৩নং রুম, যেখানে তাঁর রাজনৈতিক দপ্তর ছিলো, সেখানেও একটি মিনি লাইব্রেরি বানিয়ে রেখেছিলেন। হযরত মোহাম্মদ (সা), যিশু, আব্রাহাম লিংকন, জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, চার্চিল, জিন্নাহসহ বিশ্ববিখ্যাত মনীষী ও রাজনীতিবিদদের জীবনী চর্চা করতেন। এভাবে তাঁর বিদ্যার ভা-ার পূর্ণ হয়ে উঠেছিলো।
তাই প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরীকে দাপটের সঙ্গে মন্ত্রিগিরি করতে কোনো অসুবিধা হয় নি। একটি দুটি নয়, চার চারটি মন্ত্রণালয় একই সঙ্গে চালিয়েছেন সুনামের সাথে। তখন তো সিএসপি-রাই প্রশাসনের কর্ণধার। তাদেরকে নিয়ে দাপ্তরিক কাজকর্ম করা বেশ কঠিনই বটে। জহুর আহমদ চৌধুরী এই কঠিন কাজটা অতি সহজেই করেছেন। কেননা তাঁর জ্ঞানের কোনো অভাব ছিলো না। বাস্তব জীবন থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা ছিলো তাঁর বাড়তি যোগ্যতা। ফাইল ওয়ার্ক করতেন স্বচ্ছন্দে, ইংরেজিতে অফিস অর্ডার, নোট লিখতেন অনায়াস দক্ষতায়। সিএসপি অফিসার ড. এস.এ সামাদ, যিনি স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামের প্রথম ডিসি ও সবশেষে মুখ্যসচিব ছিলেন, তিনি আমাকে বলেছেন, ‘তিনি ব্যবহারিক ইংরেজি অতি সহজেই লিখতে ও পড়তে পারতেন। ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লেখাতেও তিনি যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন এবং নিজেই সেগুলোর খসড়া তৈরি করতেন। বিদেশিদের সাথে তিনি অনায়াসে ইংরেজি ভাষায় আলাপ আলোচনা করতেন।’
জহুর আহমদ চৌধুরী দরিদ্র ছিলেন, চিত্তের দারিদ্র্য নয়, বিত্তের দারিদ্র্য। এই দারিদ্র্য তাঁর আজীবন ঘোচেনি। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই মৃত্যু পর্যন্ত আড়াই বছর তিনি মন্ত্রী ছিলেন। প্রথম দিকে একসঙ্গে চারটি দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রাম, ঢাকা বা বাংলাদেশের কোথাও তাঁর এক কাঠা জমি নেই, একটি বাড়ি নেই। কেউ মন্ত্রী হয়ে একটি প্লট নেননি বা একটি বাড়ি তৈরি করেন নি এমন কথা ভাবা যায়? তিনি এমপিও ছিলেন তিনবার, একবার তো এমএলএ (১৯৫৪), পৌরসভার কমিশনারও (১৯৫২) ছিলেন। কিন্তু জহুর আহমদ চৌধুরী এইসব পদ-পদবি ব্যবহার করে এক পয়সাও অর্জন করেন নি।
জহুর আহমদ চৌধুরীর কীর্তি অনেক, সংবাদপত্রের সংক্ষিপ্ত পরিসরে তার পরিচয় তুলে ধরা সম্ভব নয়। সমসাময়িক রাজনীতিবিদের মধ্যে তাঁর মতো সাফল্য আর কেউ অর্জন করতে পারেন নি। এখানেই তিনি অনন্য। একজন রাজনীতিকের যত স্বপ্ন, সাধ, আকাক্সক্ষা থাকতে পারে, জহুর আহমদ চৌধুরীর জীবনে সবই পূর্ণ হয়েছিলো, সব একে একে ধরা দিয়েছিলো তাঁর জীবনে। সেই অর্থে তিনি একজন সফলতম রাজনীতিক।
এম এ আজিজ এবং তিনি প্রায়ই একইসঙ্গে রাজনীতি আরম্ভ করেছিলেন। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের দুটি শাখা-জেলা ও শহর আওয়ামী লীগ। দু’জন দু’টি সংগঠনের একচ্ছত্র নেতা ছিলেন। এমএ আজিজ জেলার, জহুর আহমদ চৌধুরী শহর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সাধারণ সম্পাদক।
শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আমীর হোসেন দোভাষ ১৯৬৩ সালে অবসর গ্রহণ করলে জহুর আহমদ চৌধুরী সভাপতি হন। এম এ আজিজের সভাপতি শেখ মোজাফফর আহমদও প্রায় একই সময়ে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু এম এ আজিজ সভাপতি না হয়ে আজীবন সাধারণ সম্পাদকই থেকে যান।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে উভয়ে অংশগ্রহণ করেন। জহুর আহমদ চৌধুরী যুক্তফ্রন্টের টিকিটে ভোট করেন। এমএ আজিজকে অন্যায়ভাবে যুক্তফ্রন্টের টিকিট দেয়া হয়নি। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করে স্বল্প ভোটে হেরে যান। জহুর আহমদ চৌধুরী এমএলএ নির্বাচিত হন। ৭০ সালে উভয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর এমএ আজিজের জীবন থেমে যায়। জহুর আহমদ চৌধুরী বেঁচে থেকে নতুন ইতিহাসের একইসঙ্গে সাক্ষী ও কুশীলবের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
জহুর আহমদ চৌধুরীর জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি হচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনকালে বঙ্গবন্ধু’র নির্দেশে চট্টগ্রাম জেলা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে। তিনি কমিটির আহবায়ক নিযুক্ত হন। এম আর সিদ্দিকী হন যুগ্ম আহবায়ক। সদস্য এমএ হান্নান, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ও এমএ মান্নান।
২৬মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে তা’ দেশে-বিদেশে প্রচারের জন্য চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে পাঠান, তিনি উক্ত ঘোষণা সাইক্লোস্টাইল করে বিলির ব্যবস্থা করেন। রিকসা, ট্যাক্সিতে মাইক লাগিয়ে প্রচারের জন্য দলীয় নেতা, কর্মীদের নিয়োগ করেন। ২৬মার্চ বেতার থেকে প্রচার করা হয়। তাঁর রাজনৈতিক দপ্তর রেস্ট হাউসকে কন্ট্রোল রুমে পরিণত করেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যপ্রাপ্তির জন্য তিনি এম আর সিদ্দিকী, আতাউর রহমান খান কায়সার ও আবদুল্লাহ আল হারুনকে নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ২৮ এপ্রিল আগরতলা যান। সেখানে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানান বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। এই যুদ্ধে ভারতের সাহায্য প্রয়োজন এবং সে ব্যাপারে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের সাহায্য প্রার্থনা করেন। শচীন্দ্রলাল সিংহ দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বললে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের দিল্লি পাঠাতে বলেন। জহুর আহমদ চৌধুরী তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে এম আর সিদ্দিকীকে শচীন্দ্রলাল সিংহের সঙ্গে দিল্লি পাঠান। তাঁরা যখন দিল্লি পৌঁছান, তখন সেখানে তাজউদ্দীনও এসে উপস্থিত হয়েছেন। দলের সেক্রেটারিকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিয়ে এমআর সিদ্দিকী আগরতলা চলে আসেন। জহুর আহমদ চৌধুরী আগরতলায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠনের উদ্যোগ নেন। ১০ এপ্রিল সরকার গঠিত হয়, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করে। জহুর আহমদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আগরতলায় বিভিন্ন প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁকে চেয়ারম্যান করে ইস্টার্ন লিবারেশন কাউন্সিল গঠিত হয়। জহুর আহমদ চৌধুরী কসবায় প্রথম মুক্ত এলাকায় প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি ঢাকায় গিয়ে বেতার চালু করে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ১৯৭২ সালে গঠিত গণপরিষদের সদস্য হিসেবে জহুর আহমদ চৌধুরী সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণ করেন এবং অন্যদের সঙ্গে স্বাক্ষর করেন।
জহুর আহমদ চৌধুরী ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে কোতোয়ালী আসন থেকে অংশগ্রহণ করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অস্থায়ী সরকার দেশে আসার পর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করলে জহুর আহমদ চৌধুরী প্রথম মন্ত্রী নিযুক্ত হন। সেই থেকে ১৯৭৪ সালে ১ জুলাই মৃত্যু পর্যন্ত তিনি একটানা মন্ত্রী ছিলেন। পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর জহুর আহমদ চৌধুরীর ব্রিফকেস, কাপড় চোপড় ঘেঁটে ৩০০ টাকার বেশি পাওয়া যায়নি। এমনই সৎ নেতা ও মন্ত্রী ছিলেন তিনি। তাঁর কীর্তির কথা লিখলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। কিন্তু কীর্তির চেয়ে মানুষটি যে অনেক বড় ও মহৎ ছিলেন কেথাই বারবার মনে পড়ছে। তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট