চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

যাকাতের উদ্দেশ্য ও যাকাত ব্যবস্থা

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

৩১ মে, ২০১৯ | ১:৫২ পূর্বাহ্ণ

যাকাত ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। যাকাত নামাযের মতই ফরজ ইবাদত। হিজরতের দ্বিতীয় বছর যাকাতের বিধান অবতীর্ণ হয়। পবিত্র কুরআনের যেখানেই নামাযের কথা বলা হয়েছে প্রায় সব জায়গায় যাকাতের কথা বলা হয়েছে। নামায কায়িক ইবাদত। আর, যাকাত হলো আর্থিক। কারো শারীরিক যোগ্যতা না থাকলে সে কায়িক ইবাদত করতে পারবে না। শারীরিক যোগ্যতার জন্য প্রয়োজন আর্থিক সঙ্গতি। কারো পেটে খাবার থাকলে তথা শরীরে শক্তি থাকলে সে কায়িক ইবাদত করতে পারবে। প্রসঙ্গে প্রবাদ আছে “পেটে দিলে পিঠে সয়”। মূলত দারিদ্র বিমোচন, বিপদগ্রস্তকে সাহায্যকরণ, ঋণগ্রস্থকে ঋণমুক্তকরণ, দাসপ্রথা বিলুপ্তি, ভিনদেশীকে সাহায্যকরণ, মানুষে মানুষে বৈষম্য দূরীকরণ, আর্ত-পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, দুর্বলপ্রকৃতির বিশ্বাসীকে পূর্ণ ইমানদার বানানোর ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধকরণ, দরিদ্র মুজাহিদকে সহযোগিতা প্রদান, সর্বোপরি আর্ত-পীড়িত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন ইত্যাদি লক্ষ্য অর্জন করতে ইসলামি শরিয়ায় যাকাতকে বিধৃত করা হয়েছে। কোন মুসলিম নারী-পুরুষ শরিয়ত নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে এবং চান্দ্র-বছরের পূর্ণ বছর তার নিকট উক্ত সম্পদ স্থিত থাকলে তাহলে তাকে সঞ্চিত সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হয়।
যাকাত প্রদানের উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি। গ্রহীতার নিকট থেকে দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান কোন বিনিময় নেয়া যাবে না। খাত হতে হবে শরিয়ত নির্ধারিত। অন্য কোন খাতে ব্যয় করলে যাকাত আদায় হবে না। পদ্ধতিও হতে হবে শরিয়ত সম্মত। নবীবংশের কাউকে যাকাত দেয়া যাবে না। যা দেওয়া হবে গ্রহীতাকে সেগুলোর শতভাগ মালিক করে দিতে হবে। অতএব শরিয়ত নির্ধারিত খাতের যে কোন খাতে বা একাধিক খাতে ইবাদতের নিয়তে কোন বিনিময় গ্রহণ ছাড়া নবীবংশের লোক ব্যতীত চন্দ্রবছরে একবার নির্ধারিত খাতকে সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগের মালিক করে দেয়াকে যাকাত বলা হয়।
নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদ বলতে এখানে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজন মেটানোর পর কোন মুসলিম নর-নারীর নিকট সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা রুপার মূল্য সমপরিমাণ নগদ টাকা অথবা সোনারুপা উভয়টি মিলে একটির পরিমাণ পূর্ণ হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। উল্লেখ্য যে, যাকাত শুধু সোনারুপা বা নগদ টাকার ওপর ফরজ নয়, বরং পশুসম্পদ, খনিজসম্পদ, উৎপাদিত ফসলাদি, ব্যবসায়িক পণ্য ইত্যাদিতেও যাকাত আছে।
যাকাত গরিবের অধিকার, তার প্রতি করুণা নয়। বরং যাকাত প্রদানকারী তার সম্পদকে পবিত্র করা, সম্পদে বরকত আনা এবং আল্লাহ তায়ালার হুকুম পালন করার সুযোগটা লাভ করেন উক্ত দরিদ্র ব্যক্তিকে আশ্রয় করে। তাই যাকাত প্রদান করে প্রতিদান দেখানোর যেমন কোন অবকাশ নেই, তেমনি অবকাশ নেই বিনিময় গ্রহণ বা লৌকিকতার। তবে যাকাত প্রদান করতে হবে যথাযথ খাতে। যেমন পবিত্র কুরআনে যাকাতের আটটি খাত নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আবার যাকাত দিয়ে দিলেই যাকাতের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে না, বরং যথাযথ পদ্ধতিতেই দিতে হবে। তাহলে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে এবং আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে। দারিদ্র বিমোচন হয়ে মানুষে মানুষে বৈষম্য হ্রাস পাবে আর প্রতিষ্ঠিত হবে সম্প্রীতির কাঙ্খিত সমাজ।
যাকাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, “আর (হে নবী) আপনি তাদের ধন-সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করে তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধির পথে এগিয়ে দিন (সুরা আত-তাওবা: ১০৩)। আরো বলা হয়েছে, “তারা আমার প্রদত্ত জীবিকা থেকে কিছু ব্যয় করে” (সুরা বাকারা: ২)। এক হাদিসে যাকাতকে জান্নাতে প্রবেশ করার মাধ্যম বলা হয়েছে। আরেক হাদিসে ইসলামের সেতু বলা হয়েছে। সুতরাং ইসলামি বিশ্বাসের একটি মৌলিক বিষয় হলো, সৃষ্টির সব কিছুর মালিকানা আল্লাহ তায়ালার। তিনিই সব কিছুর মূল মালিক। তবে সাময়িক ও রূপক অর্থে তিনি তার বান্দাকে কোন কিছুর মালিকানা দিয়ে থাকেন। সেই মালিকানার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য যাকাত, ছাদকা, ফিতরা ইত্যাদি প্রদান করতে হয়। বান্দাকে মনে রাখতে হয় যে, আমার সব কিছু আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত। সুতরাং তিনি যেভাবে নির্দেশ করেছেন সেভাবেই ব্যয় করতে হবে।
তাই যাকাত প্রদান করলে বাহ্যত সম্পদ কমছে মনে হলেও মূলত এর দ্বারা সম্পদ বৃদ্ধি পায়, বাকি সম্পদ পবিত্র হয়, দাতার পাপ মোচন হয়, অন্তর পরিষ্কার হয়, জীবন ও জীবিকায় বরকত হয়, বিপদমুক্ত হয়, পাপ ও কবর আযাব মাফ হয়, আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় ইত্যাদি। অপরদিকে সম্পদের হাত বদল হওয়ার কারণে মালিকশ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এর মাধ্যমে মানুষে মানুষে যে প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়- তা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আনে। পক্ষান্তরে অবহেলা বা কৃপণতা বশত যাকাত প্রদান না করলে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “যারা সোনরুপা জমিয়ে পুঞ্জীভূত করে এবং আল্লাহর পথে তা ব্যয় করা থেকে বিরত থাকে, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। যেদিন এই পুঞ্জীভূত সোনারুপা জাহান্নামের গনগনে আগুনে গরম করা হবে এবং তা দিয়ে কপালে, পাশে ও পিঠে ছ্যাঁকা দেয়া হবে, (বলা হবে) এই সেই সম্পদ, যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করেছিলে। এবার সঞ্চয়ের স্বাদ পুরোপুরি গ্রহণ কর” (সুরা আত-তাওবা : ৩৪-৩৫)।
যাকাতের খাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, “যাকাত তো শুধু দরিদ্র, নিঃস্ব, যাকাত ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মচারী, যাদের মন জয় করা প্রয়োজন, মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্ত অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসফিরের জন্য ব্যয় করা যাবে। যাকাতের অর্থ ব্যয়ে এটাই আল্লাহর বিধান। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় (সুরা আত-তাওবা : ৬০)। উল্লেখিত আয়াতে আটটি খাতের উল্লেখ হয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত খাতের কয়েকটি অধিক প্রযোজ্য। যেমন, দরিদ্র, নিঃস্ব, ঋণগ্রস্ত এবং আল্লাহর পথ। এখানে দরিদ্র বলতে যার কিছু সম্পদ বা উপায়-উপকরণ আছে, কিন্তু সে তা দিয়ে ভালভাবে চলতে পারে না। নিঃস্ব বলতে যার কোন কিছু নেই তথা একেবারে অসহায়, ছিন্নমূল, ভাসমান জনগোষ্ঠী জাতীয় ব্যক্তিবর্গকে বুঝানো হয়েছে। ঋণগ্রস্ত বলতে যার ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ সাধারণ ঋণী।
যারা মিল-কারখানা বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নিয়ে থাকে তাদের ঋণের বিপরীতে সম্পদ থাকে- এখানে তারা উদ্দেশ্য নয়। আল্লাহর পথে বলতে যারা আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদ, কিন্তু তার আর্থিক সঙ্গতি নেই- এমন লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে। তবে “ফি সাবিলিল্লাহ” বা আল্লাহ পথে বিষয়টি যেহেতু ব্যাপক অর্থবোধক তাই ইসলামি প-িতগণ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জনকল্যাণমূলক কাজ ইত্যাদির খাতকেও এর অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। সুতরাং দরিদ্র শ্রেণিকে স্বাবলম্বী করা, নিঃস্ব মানুষকে সহায়তা দেয়া, ঋণী ব্যক্তিকে ঋণ মুক্ত করা এবং আল্লাহর পথের দরিদ্র মুজাহিদ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, এতিমখানা, আশ্রয়কেন্দ্র, শরণার্থীশিবির, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।
যথাযথ যাকাত উসুল ও বণ্টনের কারণে আরবের দারিদ্র বিমোচন হয়েছিল। হযরত ওমর র.-এর আমলে ইয়েমেনে যাকাত গ্রহণের মত লোক পাওয়া না যাওয়ায় যাকাতের সমুদয় অর্থ মদিনায় পাঠিয়ে দিতে হয়েছিল। ইসলামের এমন একটি ফরজ ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত চরমভাবে অবহেলিত। কারণ, যাকাত অনেকেই আদায় করে না। আবার যারা আদায় করেন তাদের অধিকাংশের আদায়পদ্ধতি যথাযথ নয়। তাই যাকাতের মূল উদ্দেশ্যই সাধিত হয় না। এমনকি অনেক সময় এটি হাসির খোরাকে পরিণত হয়। অব্যবস্থাপনার কারণে যাকাত গ্রহীতা মারা পড়ে, যাকাতের টাকা দিয়ে শিশুরা লজেঞ্চ খায় ইত্যাদি।
অথচ যাকাতের মূললক্ষ্য হলো দারিদ্র বিমোচন। অর্থাৎ এক বছর যাকাতের টাকা গ্রহণ করলেও পরবর্তী বছর যেন গ্রহীতা স্বাবলম্বী হয়ে যায় অথবা নিজেই যাকাত দিতে পারে- সেই রকম মহৎ উদ্দেশ্যেই যাকাতের বিধান দেয়া হয়েছে। সাহাবিগণ র. রমজানের পূর্বে এমনভাবে যাকাত দিতেন যেন দারিদ্রের কারণে কাউকে রোজা থেকে বিরত থাকতে না হয়। যাকাতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, “আল্লাহ এ জনপদ থেকে তাঁর রাসুলকে গণিমত হিসেবে যা দিয়েছেন তা আল্লাহর, তাঁর রাসুলের, রাসুলের আত্মীয়-স্বজনদের, এতিমদের, অভাবীদের ও মুসাফিরদের-যাতে করে তোমাদের বিত্তবানদের মধ্যে ধন-সম্পত্তি আবর্তিত না হয়” (সুরা আল-হাশর : ৭)।
অধিকাংশ যাকাতদাতা বা প্রতিষ্ঠান যাকাত প্রদান করেই দায়িত্ব শেষ করেন। যে কারণে গরিব বরাবরের মতই গরিব থেকে যায়, যাকাতের লক্ষ্য অর্জন হয় না। যাকাতের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত নিরাপদ, স্বচ্ছ, আমানতদার প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, যা ধনীদের থেকে যাকাত-ফিতরা, ছাদকা ইত্যাদি সংগ্রহপূর্বক তা শরিয়তের বিধানালোকে যথাযথ খাতে প্রদান করবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক কর্মকা- পরিচালনা করবে। ভ্যান গাড়ি, রিক্সা, সিএনজি, সেলাই মেশিন, গাভী ইত্যাদি ক্রয় করে দিয়ে গ্রহীতা যেন আগামী দিনে যাকাত খেতে না হয়- তার টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং তদারকি ও নজরদারির মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনে সহযোগিতা করবে। সম্মিলিত এমন পদ্ধতিতে গ্রহীতা যেমন বেশি উপকৃত হবে তেমনি ছাওয়াবও হবে বেশি। সাধিত হবে যাকাত প্রদানের কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট